11/12/2025
মা সারদার জন্মতিথি আজ। সেই উপলক্ষে পাঠকের জন্য রইলো অনির্বাণের দিনলিপি 'বিচিত্রা' থেকে 'ভরা ঘট' লেখাটি। (শ্রীমৎ অনির্বাণের দিনলিপি-সংগ্রহ 'আলোকমঞ্জরী' প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৫)
ভরা ঘট
*******
তিনটা দিন ঝড়ের মতো উড়ে গেল।
খুশী হইনি নিজের 'পরে। মাথার উপর ঐ অতন্দ্র আকাশ। দিনের আলোয়, রাতের আঁধারে সমানে চোখ মেলে চেয়ে আছে। ঝড়ে দোলে না, বৃষ্টিতে গলে না, বজ্র আর বিদ্যুতের হানায় কিছুতেই ওর ধ্যান ভাঙে না।
এ-ই মৃত্যু। তাকে যদি জীবনের গভীরে কেউ না পায়, তাকে নিউরোটিক হতেই হবে। কতকগুলি দ্বন্দ্বকে অবিরাম বহন করে চলার কী সার্থকতা আছে? অথচ পুরুষ এখানে নিরুপায়। আকাশ তার সত্তার মূলে। কিন্তু সে-আকাশ কত দূরে। আজকার সভ্যতায় আকাশের নৈঃশব্দ্য আর ব্যাপ্তির স্থান কোথায়? পায়ের তলায় মূক পৃথিবী, পৌরুষে প্রাণ সঞ্চার করছে নিঃশব্দে, পুরুষ তাকেই-বা পেল কোথায়?
একটা কথাই দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে চেতনায়: 'পুরুষ ছাড়িয়া প্রকৃতি হবি।' এই আমাদের নিয়তি।
ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, যখন কথাগুলি ভাবি। পৃথিবীর সমস্ত দ্বন্দ্ব উত্তাল হয়ে ওঠে বুকের মধ্যে। কিন্তু কী করতে পারি?--- কিছুই না। নিঃশব্দে শুধু চেয়ে থাকতে পারি ঐ আকাশের মতো, এই পৃথিবীর মতো। দ্যাবাপৃথিবী- আদি জনক আর জননী। নিঝুম হয়ে চোখ বুজে জড়িয়ে আছে পরস্পরকে। দুটি হৃদয়ের মোহানায় যে প্রাণের সমুদ্র উথলে উঠছে, তার প্রতি কি তাদের ভ্রূক্ষেপ নাই?
বুঝতে পারছি না। থাক আজ আর নয়।
তারপর আরেকটা দিন।
আমার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা পাহাড়--- দৈত্যের মতো। ওকে লংঘন করতে হবে, তা-ই নয় শুধু। ওকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে।
একদিনে হবে না। সারা জীবনেই হবে কিনা, কে জানে।
ঐ চম্পার মতো সরল জীবন যদি হত। আকাশ ভেঙে পড়েছে ওর মাথার উপর। তবুও প্রতিদিন সকালে উঠে হেঁসেলে যেতে হয়। চা-পর্ব, ছেলেদের নাস্তা শেষ হলে পর আছে স্কুল-কলেজের ডাল-রুটি পাকানো, শাশুড়ীর পূজার আয়োজন, গো-সেবা, সংসারের কত কি খুঁটিনাটি।...
'এরই মধ্যে তোমার কথামতো জপ করে চলি। মাঝে-মাঝে ভুল হয়ে যায়। চারদিকে কত ঝঞ্ঝাট, সে তো দেখতেই পাচ্ছ। বাপ চলে যাওৱার পর থেকে মেজছেলেটার মেজাজ বিগড়েছে। থাকে-থাকে, আগুন হয়ে ওঠে। তখন জিনিষপত্র ভেঙে তছনছ করে। বোঝো না, আবদার রাখবার আজ-আর কেউ নাই। বড় ছেলের মাথায় বিশ-মন পাথরের বোঝা। কী-ই বা বয়স, আজও পৈতা হয়নি। তবুও সংসারের ভাবনায় চোখের কোলে কালি মেড়ে যাচ্ছে দিন-দিন। একেকবার আমার কাছে আসে। চারদিক চেয়ে দেখে কেউ নাই। তখন আমার গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে বলে, "কিছু ভেবো না মা। দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। জান না তোমায় কত ভালবাসি।" মায়ায় জড়িয়ে পড়ি। ঠাকুরের নাম ভুল হয়ে যায়। যখন মনে পড়ে, দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বলি, অপরাধ নিও না, ঠাকুর। যখন সময় ছিল তখন তোমায় ডাকিনি। আজ সমস্ত অহংকার ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছ, এসেছ দুঃখের ঠাকুর হয়ে। তবুও তুমি ছাড়া আপন বলতে কেউ তো নাই। যত দুঃখই দাও, সব সইব--- শুধু অপরাধ নিও না...'
দুঃখে চম্পার জীবনের পাত্র কাণায় কাণায় ভরে উঠেছে আজ। তবুও ওরই মাঝে একটা সান্ত্বনা আছে, স্বাদ আছে, তা বুঝি। আসল কথা, জীবন ওর নীরন্ধ্র, একটি মুহূর্ত ফাঁক নাই যে তার মধ্যে ব্যথার বিলাপের একটুখানি ঠাঁই হবে।
এমনি হাজার-হাজার চম্পার জীবন। কোথাও ফাঁক নাই। মাটির বুক থেকে মুখ তুলে আকাশের পানে কোনওদিন ওরা তাকায় না, তাকাবার অবসর নাই।
আর আমার? অফুরন্ত অবসর আমার জীবনে। কোনও দায় ছিল না, তবুও দায় সৃষ্টি করেছি। প্রতিটি মুহূর্ত কাজে ভরাট করে তোলবার চেষ্টায় গলদঘর্ম হচ্ছি। সংসারকে আমি ফাঁকি দিতে চাই না। ঐ চম্পার ভাগ্যের সঙ্গে আমার ভাগ্যকে গেঁথে নিতে চাই। ও খেটে মরবে, আর আমি ওর ক্ষুধার অন্নে ভাগ বসিয়ে শিবনেত্র হয়ে আলোর সন্ধান করব আকাশের ওপারে--- এ আমি পারব না।
'য়ঃ সর্বো ভূত্বা সর্বমাবিবেশ'--- যে সব হয়ে সবার মাঝে আবিষ্ট হল। ঠিক এই কথা। যেখানে আছি, ইচ্ছা করে সেখান থেকে নড়ব না। জীবনে সুখ-দুঃখ যা পেয়েছি, কিছুর জন্য স্বস্তি বা ক্ষোভ কিছুই আমার নাই। শুধু এইটুকু জানি, চম্পার আকাশ নাই, আমার আকাশ আছে। আকাশ আছে শুধু আমার একার জন্য নয়, চম্পার জন্যও আছে।
সারদার কথা মনে পড়ে। জীবনস্রোত বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা হয়ে, মানে কোথাও বাধা মানেনি। জয়রামবাটিতে ভাইএর সংসারে বাস--- তা-ই সই। একটু অবসর মিলল কলকাতায় এসে: দুপুরে একটু বিশ্রাম, একটু ধর্মকথা, একটু রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী শোনা--- আচ্ছা, তা-ই সই। সারাদিন ছুটি যদি না থাকে, দুঃখ নাই: 'আমার বুকে ভরাঘট রয়েছে যে!' একটুখানি ফাঁক ভোরবেলাতে। বেশী সময়ের জন্য নয়, আধ ঘণ্টা বা কোনদিন বড় জোর একঘণ্টা। তখন একটুক্ষণ মালা-ফেরানো। মেয়েরা প্রশ্ন করে, 'মা তোমার আবার মালাজপ কেন?' 'আমার কত ছেলেমেয়ে একবারও তাঁর নাম নিতে ফুরসুত পার না, তাদেরটা করে রাখি।'
কী আশ্চর্য। সমুদ্র নয়, হিল্লোল নয়, কল্লোল নয়। চোদ্দবছরের কিশোরীর বুকে একটি ভরা ঘট। জল ছলকে ওঠে, কিন্তু তুফান জাগে না। কারও ভরাডুবি হয় না ওর পাকে পড়ে।
কী করে হয়? কত তপস্যায়? জানি না। পুরীর সমুদ্র দেখেছি। পৃথিবীর কূলে উতলা ঢেউএর আছাড়িপিছাড়ি। কিন্তু দূর সমুদ্র নীল পারার মতো টলটলে। আলোর ছোঁয়ায় চিকচিক করছে। আর ছাইমাখা ধূসর আকাশ তার শিয়রে বসে স্তব্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মুখের পানে...
সারদা ঐ আকাশকে স্পষ্ট দেখেছে, ওর আলো গায়ে মেখেছে। আর চম্পা আভাসে বুঝেছে শুধু। এইখানে দু'জনার তফাত।
কী করে আকাশকে পেল ও, তার রহস্য কেউ কোনদিন জানবে না। সর্বংসহা পৃথিবীর মৌনকে কেউ বোঝে না। কী করে সকালের রৌদ্র সোনা ঢেলে দেয় তার বুকে, সন্ধ্যার কাজলছায়া কী করে নিঃশব্দে গভীর হয় ওর ললাটে শান্তির চুমায়, কী করে রাতের ভালবাসা মৃত্যুর আঁধার হয়ে নামে ওর বুকের অতলে--- কেউ জানে না।
চৌদ্দবছরের গ্রামের মেয়ে। মাটির বুক ফুঁড়ে উঠেছে ভূঁইচাঁপার মতো। আকাশ নুয়ে পড়েছে সেই স্বপ্নের 'পরে। আলতো ছোঁয়ায় শিউরে দিয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। বসন্তের বর্ণে গন্ধে মধুতে ফুলের বুক ভরে উঠেছে।
তারপর ধীরে ধীরে সত্য হয়েছে উপনিষদের ঋষির সেই কথা: 'যদস্মিন্ হৃদয়ে দহরং পুণ্ডরীকং বেশ্ম, তস্মিন্ য় আকাশো জ্যায়ান্ দিবো জ্যায়ন্ পৃথিব্যাঃ'--- এই যে হৃদয়ে ছোট্ট কমলের ঘরখানি, তার মাঝে বন্দী করেছি যে-আকাশকে, সে এই ভূলোকের চাইতে বড়, ঐ দ্যুলোকের চাইতেও বিপুল....
আকাশ আর ফুল--- এই সত্য। দু'য়ের মাঝে সেতুবন্ধন করেছে ঐ দিবোদুহিতা অহনার কচি ঠোঁটের রাঙা হাসিটুকু।
চেয়ে দেখি, সামনের পাহাড়টা গুঁড়িয়ে যায়নি, মেঘ-বাষ্পের মতন কখন যে মিলিয়ে গেছে, জানি না।।