04/11/2025
"ছবি লোকে দেখে। ছবি দেখানোর সুযোগ যতদিন খোলা থাকবে, ততদিন মানুষকে দেখাতে আর নিজের পেটের ভাতের জন্য ছবি করে যাব। প্রতিবাদ করা শিল্পীর প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। শিল্প ফাজলামি নয়। যারা প্রতিবাদ করছে না তারা অন্যায় করছে। শিল্প দায়িত্ব। আমার অধিকার নেই সে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার। শিল্পী সমাজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। সে সমাজের দাস। এই দাসত্ব যদি স্বীকার করে তবে সে ছবি করবে।’' -- এই কথাগুলো আজকের মেরুদণ্ডহীণ বুদ্ধিজীবীদের দেখে যেন আরো বেশি করে প্রয়োজনীয় মনে হয়। যাইহোক সেসব নিয়ে বলার জন্য এই লেখা নয়। উপরের লাইন কটা যাঁর, আজ তাঁর জন্মদিন। চলচ্চিত্রকার হিসেবে আজও অবিস্মরণীয় তিনি। তবে চলচ্চিত্রে আসার কথা ছিল না তাঁর, কেননা তাঁর স্বপ্নের সমস্তটা জুড়ে ছিল নাটক। হ্যাঁ উপরের কথাগুলো কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের। তিনি সিনেমাতে এসেছিলেন একটাই কারণে, কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন সিনেমা একসাথে বহু মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। আর তিনি সর্বদাই সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাঁর চলচ্চিত্রকে। আজ এই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বর জন্মদিবস। ১৯২৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর ঢাকার জিন্দাবাজারে হৃষিকেশ দাশ লেনের এক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হলেও কবিতা ও নাটক লিখতেন। মা ইন্দুবালা দেবী। বাবা-মায়ের এগারোতম এবং কনিষ্ঠ সন্তান তিনি। রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ. এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় তাঁরা চলে আসেন অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম.এ. কোর্স শেষ করে পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। তাঁর বড় ভাই ওই সময়ের খ্যাতিমান এবং ভিন্ন ধারার লেখক মনীশ ঘটক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী। আইপিটিএ থিয়েটার মুভমেন্ট এবং তেভাগা আন্দোলনে মনীশ ঘটক সম্পৃক্ত ছিলেন। মনীশ ঘটকের কন্যা মহাশ্বেতা দেবী সমাজচিন্তক। যিনি পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছিলেন।
ঋত্বিকের সৃজনশীলতার শুরু কবি এবং গল্পলেখক হিসেবে। এরপর তিনি মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হন আর তারপর চলে যান গণনাট্যের দিকে। কিন্তু এখানে এসেও থিতু হননি তিনি। চলে গেছেন সেলুলয়েডের হাতছানিতে চলচ্চিত্রের দিকে। তাঁর যুক্তি ছিল "একসঙ্গে লক্ষ মানুষের কাছে নিজের কথা এখুনি বলতে চলচ্চিত্রই একমাত্র মাধ্যম।" ঋত্বিকের ভাষ্যমতে তিনি সিনেমার প্রেমে পড়েননি কোনোদিন, তাঁর বলার কথাগুলো কত কম সময়ে কত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, সেই মাধ্যমটাই খুঁজে গেছেন। সিনেমার চেয়ে ভালো কোনো মাধ্যম খুঁজে পেলে সিনেমাকে "লাথি মেরে" চলে যেতেও পিছপা হতেন না তিনি।
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঋত্বিকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের চিত্রনাট্য,পরিচালনা ও প্রযোজনায় নির্মিত ছবিতে নিজেরই চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
‘নাগরিক’ তাঁর প্রথম সিনেমা হলেও প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নয়। ‘নাগরিক’ বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের টানাপোড়নের গল্প। যে গল্প, যে জীবনবোধ, যে তিক্ততা ঋত্বিক দেখেছেন, কোনো ভণিতা না করেই তা বলে গেছেন নাগরিকে। পুরো সিনেমার কাজ শেষ করেও পরে অর্থাভাবে সিনেমাটি আর মুক্তি পায় না (১৯৫২ সালে)। সাতাশ বছরের ঋত্বিকের প্রথম সিনেমা ‘নাগরিক’ মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পরে, ১৯৭৭ সালে। ১৯৫৫ সালে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা নিয়ে তৈরি করলেন ডকুমেন্টারি ছবি ‘ওঁরাও’।
১৯৫৮ সালে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা ‘অযান্ত্রিক’। ছবিটির নির্মাণের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন ঋত্বিক। ছয় থেকে সাতবার কেবল স্ক্রিপ্টই বদলেছিলেন। তাঁর এতো পরিশ্রম বৃথা যায়নি। বাংলা সিনেমার জগতে এটি এখনো এক অবিস্মরনীয় সিনেমা। ‘অযান্ত্রিক’ এক অন্যরকম গল্পের নাম। মানুষ এবং যন্ত্রের ভালোবাসার গল্প এটি। বিমল এবং তার ট্যাক্সি ‘জগদ্দল’ সিনেমার নায়ক-নায়িকা। বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি বললেন এক পরাবাস্তব গল্প। ঋত্বিক বাঙালিকে এক নতুন ঘরানার সিনেমা উপহার দিলেন। নাগরিকের ব্যর্থতার পর মুষড়ে যাওয়া ঋত্বিককে খ্যাতি এনে দিল অযান্ত্রিক। অযান্ত্রিকের বিষয়বস্তু নির্ধারণে তিনি দেখিয়েছেন অতুলনীয় সাহস। জগদ্দলকে অনুভূতিপ্রবণ এক সত্তা হিসেবে কল্পনা করে, তার মধ্যে মানুষিক প্রতিক্রিয়া আরোপ করে সে যুগের দর্শকের কাছে উপস্থাপনের সাহস দেখিয়েছেন ঋত্বিক। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। বাড়ি থেকে পালানো এক ছেলের চোখে শহরকে দেখার গল্প। নাকি ঋত্বিকের গল্পই এটি? তিনি নিজেও তো কয়েকবার পালিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। সে যাই হোক, এটি তাঁর গল্প না হলেও নিজের বাড়ি থেকে পালানোর অভিজ্ঞতার যথার্থ ব্যবহার করেছেন এই সিনেমায়। এরপর একে একে মুক্তি পায় ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ইত্যাদি। এগুলোর প্রথম তিনটি সিনেমাকে ত্রয়ী বলা হয়। দেশভাগের ফলে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে যে শরণার্থী সমস্যা তৈরি হয় তাই-ই ছিল ত্রয়ীর মূল বিষয়বস্তু। ঋত্বিক দেখিয়েছেন দেশভাগ কি করে কোটি কোটি পরিবারকে উদ্বাস্তু করেছে।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এই সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। মূল চরিত্র একজন মাতাল বুদ্ধিজীবী নীলকণ্ঠ বাগচী, যে তার বন্ধুদের মত সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে নিজেকে বিক্রি করে দেয়নি। নীলকণ্ঠ চরিত্রে অভিনয় করেন ঋত্বিক স্বয়ং। সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক হলেও এটা ১৯৪৭ এর দেশভাগ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আর নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সময়ের একটি নির্মোহ-নির্মম সমালোচনাও বটে। সুশীল লেখক সত্যজিৎ বসু যখন তাকে বলছেন বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা,নীলকণ্ঠ বাগচীর কণ্ঠে তখন চরম উপহাসের সেই অবিস্মরনীয় ডায়ালোগ, "ভাবো,ভাবো,ভাবা প্র্যাক্টিস করো।”
ঋত্বিক ঘটক বাম ঘরানার রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর সিনেমাতে সে আদর্শের ছাপ স্পষ্ট। মানুষের জীবনের অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যতার চরম রূপ বার বার ধরা দিয়েছে তাঁর ক্যামেরায়। এত বিস্তৃতভাবে নীচুতলার মানুষের গল্প বাঙলা সেলুলয়েডের ফিতায় আজ অব্দি আর কেউ বলেননি।
ঋত্বিক বাঙালির চিত্রপরিচালক ছিলেন। তাঁর ক্যামেরায় উঠে এসেছে বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি,বাঙালির ধর্মবিশ্বাস,আচার-অনুষ্ঠান,সর্বোপরি বাঙালির জীবনবোধ। শুধু বাঙালিরই নয়,আদিবাসীদের যাপন চিত্রও ফুটে উঠেছে তাঁর সিনেমায়। সত্যজিৎ রায় ঋত্বিকের ‘বাঙালি’ পরিচয়কে তাঁর সবচাইতে ‘গুরুত্বপূর্ণ দিক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল,বাঙালি শিল্পী ছিল– আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় এবং সেইটেই তার সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।"
ঋত্বিক কতটা তীব্রভাবে বাঙালি ছিলেন, ঋত্বিক কতখানি নিবিড়ভাবে বাংলার মানুষের ছিলেন তার সবচাইতে বড় প্রমাণ সত্যজিৎ রায়ের এই অকপট সাক্ষ্য।
মূলত পরিচালক হিসেবে খ্যাত হলেও সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ। ঋত্বিক ঘটকের গল্পসংগ্রহ'-- যেখানে ঋত্বিক কুমার ঘটকের লেখা ছোটগল্পগুলি সংকলিত আছে। এটি কবি প্রকাশনী ও গ্রন্থিক প্রকাশন সহ বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং এতে তাঁর লেখা বিভিন্ন গল্প রয়েছে। এছাড়া তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে 'মানুষ এবং আরও কিছু' (১৯৭৬), 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' (১৯৭৭), 'জ্বালা' (নাটক) এবং 'দলিল' (১৯২৫)। এই বইটি বিভিন্ন অনলাইন ও অফলাইন বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়, যেমন গ্রন্থিক প্রকাশন।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মর্মবেদনা নিয়ে শরণার্থী হয়ে কলকাতায় চলে আসা — এসব ঘটনা প্রবাহ ঋত্বিকের জীবন দর্শনকে বহুল প্রভাবিত করে। সমাজের বিদ্যমান এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে তৈরি হয় তাঁর বিদ্রোহী মন। পরবর্তীকালে তাঁর শিল্প সৃষ্টিতেও প্রভাব ফেলে এই অনুভূতিগুলো।
দেশ ভাগের বিষয়টা কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি তিনি।একসময় চিৎকার করে বলেছিলেন, “মাতামাতি! বাংলাকে ভেঙে চুরমার করে দিল, আর মাতামাতি! বিক্ষুব্ধ সময়ে মুজরো করব? এটা বদমাইসি! চাই, খুব বেশি করে চাই দুই বাংলার সংস্কৃতিকে এক ফ্রেমে আঁটতে। প্রতিবাদ করাটা দরকার। কিন্তু শালা বুঝল না কেউ।”
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ঋত্বিক কাউকেই কাছে পাননি, মৃত্যুর সময় স্ত্রী সুরমাও ছিলেন বহু দূরে। বিশৃঙ্খল আর বেপরোয়া জীবন আস্তে আস্তে তাঁকে শেষ করে দিচ্ছিলো। ঋত্বিকের শেষ সময়গুলোর সাক্ষী ছিলেন আরেক প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। তাঁর ভাষায়, “শেষ ক-টা বছর ঋত্বিকের বেঁচে থাকাটাই একটা বিরাট অঘটন।” অসুখে ধুঁকে ধুঁকে ১৯৭৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি রাত ১১.০৫ এ মারা যান আজন্ম ভবঘুরে ভবা। মৃণাল সেন সুরমা ঘটককে খবর পাঠালেন, ‘Ritwik Ghatak expired’। কিন্তু... এক্সপায়ার্ড ঋত্বিক ঘটক তাঁর সৃষ্টির অমরত্বের মহিমায় আজও বাঙালিকে ভাবার প্র্যাকটিস করাচ্ছেন। ক্রমাগত বলেই চলেছেন, “ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো...”