22/07/2025
বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পলেখক। তিনি ১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে একটি জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা প্রভাবতী দেবী। বাল্যকালেই পিতাকে হারান তিনি এবং তারপর মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন।
লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে তিনি ১৯১৬ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। তারপর প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং পরে সাউথ সুবার্বন কলেজ অধুনা আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। সেই সময়কালে সারা দেশ জুড়ে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন দানা বাঁধে। তিনি সেই আন্দোলনে যোগ দেন এবং ফলস্বরূপ ১৯২১ সালে এক বছর অন্তরীণ থাকতে হয় তাঁকে। ফলে তাঁর প্রথাগত শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে।
এরপর তিনি পুরোপুরিভাবে কংগ্রেস দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এইকারণে ১৯৩০ সালে তাঁকে প্রায় এক বছর কারাবরণ করতে হয়। একবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। সালটা ১৯৩২ তিনি প্রথমবার শান্তি নিকেতনে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে। এরপরেই তাঁর অভিমুখ বদলে গেল, তিনি নিজের গ্রামে চলে গেলেন এবং সম্পূর্ণরূপে সাহিত্যসাধনায় আত্ম নিয়োগ করলেন। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালি ঘূর্ণি’।
সালটা ১৯৪০-৪১ সারা বিশ্বজুড়ে বেজে চলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। সেইসময় তিনি কলকাতার বাগবাজার চলে যান এবং বছরখানেক পরে চলে যান বরানগর। ১৯৪২ সালে বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনে তাঁকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি মনোনীত করা হয়। এরপর ১৯৪৪ সালে তিনি কানপুরে বসবাসকারী বাঙালীদের দ্বারা আয়োজিত ‘কানপুর বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’-এও সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। এই সম্মলনের উদ্বোধন করেন তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায়।
১৯৫৭ সালে আমন্ত্রণ আসে চীন থেকে।এরপরের বছরই সোভিয়েত ইউনিয়নে সংঘটিত হয় এফ্রো-এশিয়ান লেখক সঙ্ঘের কমিটি গঠনের প্রস্তুতিমূলক সভা। সেই সভায় যোগদান করেন তিনি। তারপর তাসখন্দে অনুষ্ঠিত হয় এই এফ্রো-এশিয়ান লেখক সম্মেলন। সেই সম্মেলনে তিনি ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এরই মাঝে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবন বলতে কিছুকাল কলকাতায় কয়লার ব্যবসা এবং কিছুকাল কানপুরে চাকরি।
চার দশকের বেশিসময় ধরে সাহিত্য সাধনা করে গেছেন তারাশঙ্কর। তাঁর রচনাকালে তিনি প্রায় ২০০ গ্রন্থ রচনা করেন। এরমধ্যে ৬৫ টি উপন্যাস, ৫৩ টি গল্পের বই, ১২ টি নাটক, ৪ টি প্রবন্ধের বই, ৪ টি আত্মজীবনী এবং ২ টি ভ্রমণ কাহিনী, ১ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি প্রহসন।
তারাশঙ্করের রচিত প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল-এ প্রকাশিত হয়। এছাড়া কালি কলম, বঙ্গশ্রী, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী, পরিচয় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও মূলত কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্কর খ্যাতিলাভ করেন। ‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের একটি কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু তৎকালীন হিন্দু সমাজের রূপ ও আচার, প্রেম, জীবনসংগ্রাম, মানুষের মনের বিভিন্ন দিক ইত্যাদি। ‘ডাক হরকরা’ তারাশঙ্করের আরেকটি সেরা গ্রন্থ।
তাঁর রচনার বিষয়বস্তু এবং সৃষ্ট চরিত্রগুলোর দিক থেকে বিচার করলে তাঁর সমগ্র রচনাকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটা হল গ্রাম্যজীবন ভিত্তিক নিম্নবিত্ত সমাজের ব্রাত্যজনদের সুখ-দুঃখের কাহিনী, আর দ্বিতীয়টা হল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা কাহিনী। একটা ভাগ ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ পর্যন্ত। আর একটা ভাগ ‘মন্বন্তর’ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ তারাশঙ্করের রচনার দুটি ভাগের মধ্যে প্রথমভাগের শেষ পর্বের মহাকাব্যিক উপন্যাস। তাঁর জীবনে প্রথম থেকেই রাজনীতির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি। আর সেই কারণেই তিনি তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাস ত্রয় রাজনৈতিক মহাকাব্যিক অনুষঙ্গে লিখতে সমর্থ হন । তাঁর লেখায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে জন্মভূমি বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু। মানবচরিত্রের নানান জটিলতা ও তার নিগূঢ় রহস্য তাঁর উপন্যাসে জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে। শরৎচন্দ্রের পরে কথাসাহিত্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বাংলা ছোটগল্পেরও অন্যতম প্রধান কারিগর ও নির্মাতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্প রচনায় হাত না দিলে হয়তো তারাশঙ্করই হতেন বাংলা ছোটগল্পের জনক।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের বহু রচনা অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে ‘জলসাঘর’ ও ‘অভিযান’ ছবিটি পরিচালনা করেছেন প্রখ্যাত চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায়।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৭), ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৬), আরোগ্য নিকেতনের জন্য ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৫৫), একই উপন্যাসের জন্য ‘সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার’ (১৯৫৬), ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ (১৯৬৭) এবং ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬২) ও ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৬৮) উপাধি লাভ করেন।
১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এই মহান কথাসাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।।