18/08/2025
আজ ১লা ভাদ্র, লালগোলার রূপকার মহারাজা রাও শ্রী যোগীন্দ্র নারায়ন রায় এর তিরোধান দিবস। রাজা মহেশ নারায়ণ রায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে অসুস্থ হবার পর, তার মানসিক ইচ্ছে জাগে যে তিনি তীর্থে বেরোবেন। রাজা মহেশ নারায়ণ তার গুনি সঙ্গ নিয়ে তীর্থে বেরোন। মহেশ নারায়ণ নিসন্তান ছিলেন। তীর্থ ভ্রমন কালে উত্তরপ্রদেশ এর গাজীপুর জেলার কাছে নদী পেরোনোর সময় তার তৃষ্ণা পায়। তৃষ্ণার্ত রাজার জন্য একটি ব্রাহ্মণ্ বালক পানীয় জল নিয়ে আসেন। রাজার বিচক্ষণ সঙ্গ রাজাকে জানান, এই ব্রাহ্মণ্ বালক তার উত্তরসুরী হতে পারে। রাজা মহেশ নারায়ণ আর দেরী না করে ব্রাহ্মণ্ বালক টিকে লালগোলা তে নিয়ে আসেন। পরবর্তিতে রাজা মহেশ নারায়ণ এর মৃত্যু ঘটলে সেই ব্রাহ্মণ্ বালক কে লালগোলার রাজা বলে মান্যতা দেওয়া হয়। কিন্তু মহেশ নারায়ণ রায় এর পত্নী তা মানতে চান না, পত্নীর ইচ্ছে তার ভাই দের মধ্যে কোনো এক জন কে লালগোলার রাজা করা হোক। এই রকম অবস্থায় কোর্ট এ মামলা হয়, এবং সেই ব্রাহ্মণ্ বালক এর পক্ষে রায় প্রদান করে ইংরেজ দের তত্তাবধানে থাকা আদালত। এই ব্রাহ্মণ্ বালক শ্রী যোগীন্দ্র নারায়ন রায় তখন যৌবনে পদার্পণ করেছে। এই মামলায় জয়লাভ করেও তিনি রানী মাকে বলেন, রানী মা তার ইচ্ছে মত রাজা নির্বাচিত করতে পারেন। রানী মা ও তখন যোগীন্দ্র নারায়ন রায় কে রাজা হিসেবে মেনে নেন। লালগোলা পায় এই দানবীর রাজাকে।
লালগোলা তে পানীয় জলের কষ্ট ছিল। সেটির উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জায়গায় জায়গায় পাত কুয়ো খননের ব্যবস্থা করেন মহারাজা। এখনো লালগোলার বিভিন্ন প্রান্তে সেই পাত কুয়ো গুলোকে জরাজীর্ণ অবস্থায় দেখা যায়। এই জলকষ্ট নিবারণের পর মহারাজা রাও শ্রী যোগীন্দ্র নারায়ন রায় এর নাম হয় "পানিপাঁড়ে"। নামটি সম্ভবত দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পন্ডিত দিয়েছিলেন। লালগোলার পঠন পঠন এর কথা মাথায় রেখে মহারাজা প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যালয়। তার পিতা মহেশ নারায়ণ এর নাম এ বিদ্যালয়ের নাম হয় "লালগোলা মহেশ নারায়ণ বিদ্যামন্দির"। এই বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র তার পুত্র ধীরেন্দ্র নারায়ন রায়। এই বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক যোগীপুরুষ শ্রী বরদা চরণ মজুমদার। শুধু বিদ্যালয় নয়, বিদ্যালয় সংলগ্ন ছাত্রাবাসও নির্মান করেন মহারাজা। লালগোলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা ছাত্ররা যাতে থেকে পঠন-পাঠন করতে পারেন, তার জন্য এই ছাত্রাবাস নির্মানের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন মহারাজা। লালগোলা তে একটি শতাধিক বছর পুরনো গ্রন্থাগার আছে, সেটারও প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা। মহারাজা, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর সহযোগিতায় "লালগোলা মহেশ নারায়ণ বিদ্যামন্দির গ্রন্থাগার" নির্মান করেন। এই গ্রন্থাগারের প্রথম বইগুলি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এর সংগ্রহ। বিদ্যাসাগর এর নাতির কাছ থেকে মহারাজা, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর সহযোগিতায় পাঁচ হাজার টাকা মূল্যে বই গুলি ক্রয় করেন। অর্ধেক বই যায় কান্দির জেমো রাজবাড়ির গ্রন্থাগার এ, এবং এর অর্ধেক লালগোলা মহেশ নারায়ণ বিদ্যামন্দিরের গ্রন্থাগার এ জায়গা করে।
মহারাজা লালগোলা কে নগর উন্নয়নের পরিকল্পনায় রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। করেছিলেন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়। বসিয়েছিলেন বাজার ও অফিস। লালগোলা তে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে আনাচে কানাচে পুকুর, এই পুকুর গুলো মহারাজার পরিকল্পনায় খনন করা। আসলে নগর গড়ার পরিকল্পনায় ও নাগরিক দের সুষ্ঠ পরিছন্ন পরিবেশের কথা মাথায় রেখে জল নিকাশির জন্য এই পুকুর খনন। কিন্তু হাই রে মহারাজার নগর উন্নয়নের পরিকল্পনা - এই নাগরিকরা এখন পুকুর বুজিয়ে বসবাসযোগ্য ইমারত তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করছে। তাই লালগোলার এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদী ও আর এক প্রান্ত দিয়ে ভাগীরথী নদী বয়ে যাওয়া সত্বেও লালগোলার পুকুরগুলো মরুভূমির আকার ধারণ করেছে। মহারাজার পরিকল্পনায় খনন করা কোনো কুয়ো সংস্কার না হওয়ার ফলে, কুয়ো গুলো মৃতপ্রায়। আর আমাদের বিষাক্ত আর্সেনিক থেকে বাঁচাতে পারে এই পাত কুয়ো, কারণ থিতানো জলে আর্সেনিক থাকে না। এই থিতানো জল কে ফিল্টার দ্বারা পরিস্রুত করলেই বিশুদ্ধ পানীয় জল পাওয়া যাবে। মহারাজা তার নাগরিক দের জন্য যা পূর্বেই করে গেছেন। একটু বৃষ্টিতেই লালগোলা "কাদাগোলা" তে পরিনত হয়। লালগোলা তে জল জমে, প্রশাসন নাজেহাল। শুধু মহারাজ পরিকল্পনায় খনন করা পুকুর বা ডোবা গুলোকে জীবিত করলেই মুস্কিল আসান হতে পারে। মহারাজা ও মহারাজার কাজ কে নজরদারি করলেই লালগোলার ভালো। কারণ তিনি লালগোলার রূপকার।
শুধু লালগোলা নয়, দানবীর মহারাজার দান পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য "বহরমপুর মাতৃসদন হাসপাতাল", "বহরমপুর গ্রান্ট হল", "কাশিমবাজার বিষ্ণুপুর কালিবাড়ি", "বহরমপুর লালদীঘি". এমনকি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর কে শান্তিনিকেতন এর জন্য আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। লালগোলা মহারাজা রাও শ্রী যোগীন্দ্র নারায়ন রায় এর দান অপরিসীম।
লালগোলার মহারাজা ১১০ বছর জীবিত ছিলেন. মহারাজার শেষ জীবন বর্তমান শৈলজা মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল এ কাটে। তখন সেটি স্কুল হয় নি। ওই বাড়িতে প্রতিটি ঘরের সঙ্গে যে সুবিস্তীর্ণ বারান্দা আছে তাতে কোনো চৌকাঠ নেই, তার কারণ হুইল চেয়ার এ বসিয়ে মহারাজা কে ঘোরানো হত।
প্রণাম লালগোলার রাজা দানবীর রাও যোগীন্দ্র নারায়ণ রায় কে। লালগোলা পেজের তরফ থেকে সশ্রদ্ধ প্রণাম।