14/10/2025
সন্ন্যাসের পর থেকে তিনদিন বাইরে ভিক্ষা করে খেতে হয়। ধুতি ও সুতির চাদর ছাড়া আর কিছু পরা চলবে না, আগুনের ব্যাবহারও নিষেধ।
সকাল ন’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম ভিক্ষায়। দু’জন করে সন্ন্যাসীর গ্রুপ। এক-এক গ্রুপ একেক দিকে যাবে। একই বাড়িতে একাধিক সন্ন্যাসী ভিক্ষা করবে না। তিন বা পাঁচ বাড়ির বেশি থেকে ভিক্ষা নেয়া যাবে না। শুধু রান্না করা খাবার নেয়া যাবে, ফলও, কিন্তু টাকা-পয়সা নয়। গেরুয়া কাপড়ের একাংশ ছিঁড়ে ঝোলা তৈরী করলাম (বৈষ্ণবদের সাপুই)। ওটাই ভিক্ষার ঝুলি। দুপুর বারোটার মধ্যে সবাইকে ফিরে আসতে হবে----রথীন মহারাজ বলে দিলেন।
মঠের মেন গেটের কাছে অনেক মহিলা ও পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন খাবার নিয়ে। নবীন সন্ন্যাসীদের ভিক্ষা দেবেন। আমরা কয়েকজন তাই পেছনের গেট দিয়ে লুকিয়ে চলে গেলাম। ইচ্ছা ছিল সেই অঞ্চলে যাব যেখানে কেউ আমাদের চেনে না।
প্রায় মাইল খানিক হেঁটে আমরা দু’জন একটা পাড়ায় ঢুকলাম। সঙ্গী গেল একদিকে, আমি অন্যদিকে। এক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই উপরের বারান্দা থেকে একজন প্রৌঢ়া মহিলা বললেন ---এসেছো বাবা? একটু দাঁড়াও। আমি আসছি। তিনি নিচে নেমে আমার ঝুলির মধ্যে ঢেলে দিলেন ভাত, আলু ও পটল ভাজা, ফুলকপির তরকারি। ডালের বাটি দিতে গেলে বললাম—ডাল ভেতরেই ঢেলে দিন। তিনি অবাক হলেন --- সে কি বাবা? চুঁইয়ে-চুঁইয়ে পড়বে যে নীচে দিয়ে। বললাম— এভাবেই ভিক্ষা নেয়ার নিয়ম আমাদের। সব মাখামাখি হয়ে যাবে, তা যাক।
ওখান থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে অন্য এলাকায় গেলাম। জবরদস্ত অভিজ্ঞতা হলো। দরজা খুলে এক ভদ্রলক জিজ্ঞেস করলেন— আপনি কোন আশ্রমের? বললাম— বেলুড়মঠের। শুনেই তিনি চোখ গোল গোল করে বিস্ময় প্রকাশ করলেন— সে কি? মঠের সাধু হয়ে ভিক্ষা করছেন? বেলুড়মঠের আর্থিক অবস্থা এতো খারাপ যে সাধুরা রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছেন? ওগো শুনছো— স্ত্রীকে ডাক দিলেন তিনি— মঠের সাধুরা পথে পথে বেরিয়ে ভিক্ষা চাইছে। তাঁর স্ত্রী এসে দাঁড়ালেন। ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। পরে স্বামীকে বললেন — আমার সন্দেহ হচ্ছে। কালই তো বেলুড়মঠে খিচুড়ি প্রসাদ খেয়েছি। একদিনেই অবস্থা এতো খারাপ? না আমার মনে হয় এই সাধু ঠগ। বেলুড়মঠের নাম করে ভিক্ষা চাইছে। ওদিকে পাড়ার কয়েকজন এসে আমায় ঘিরে ধরেছে। ভদ্রলোক চেঁচাচ্ছেন --- “চোর-টোর নয় তো! গেরুয়ার ছদ্মবেশে এসেছে। এই, আপনারা একে ধরে রাখুন। আমি পুলিশে ফোন করছি।” আমি তো নার্ভাস।
সন্ন্যাস নিতে-না-নিতেই এমন বিপত্তি! তাদের বুঝিয়ে বললাম— “আমি বেলুড়মঠের ফোন নাম্বার দিচ্ছি। আপনারা ফোন করে জেনে নিন আমার বিষয়ে।” এভাবেই রক্ষা পেয়েছিলাম সেদিন। ভিক্ষা তো দিলই না, উল্টে পুলিশের হুমকি!
দ্বিতীয় দিন এক মুসলমান বস্তিতে গেলাম। একটা বাড়ির বারান্দায় দু’জন মহিলা কথা বলছিলেন। সেখানে গিয়ে ভিক্ষা চাইলাম। এক ভদ্রমহিলা “আসছি বাবা” বলে ভেতরে ঢুকে বেরিয়ে এলেন খালি হাতে। এসেই গল্প করতে শুরু করলেন। কোথায় থাকি, বাড়ি কোথায় ছিল, কতদূর পড়াশোনা ইত্যাদি। ১০-১২ মিনিট ধরে তিনি গল্প চালিয়ে যেতে লাগলেন। আমি ভাবছি — ভিক্ষা না দিলে বলে দিলেই হয়! এতো প্রশ্ন কেন? এমন সময় একটি বাচ্চা ছেলে বাইরে থেকে এলো। হাতে ঠোঙা। তাকে নিয়ে ভদ্রমহিলা ভেতরে গেলেন। পরে এক বাটিতে মুড়ি এনে আমায় ভিক্ষে দিলেন। জানলাম যে বাড়িতে খাবার নেই। স্বামী রিকশা চালান। বারোটা নাগাদ চাল-ডাল নিয়ে আসবেন, তখন রান্না হবে। তাই ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন বাজার থেকে মুড়ি নিয়ে আসতে। এজন্যই গল্প করে আমায় ব্যস্ত রেখেছিলেন এতক্ষণ। সন্ন্যাসী ভিক্ষা চাইতে এসেছেন। খালি হাতে বিদায় করতে নেই।
মজা হয়েছিল ললিত মহারাজকে নিয়ে। বেলুড় অঞ্চলে যুবকদের মধ্যে তিনি খুব জনপ্রিয়। এক পাড়ায় ঢুকতেই ৮-১০ জন ছেলে তাঁকে ঘেরাও করে বসলো — আমাদের ক্লাবে চলুন, ভিক্ষা দেবো। মহারাজ আপত্তি করলেন, কি করছিস তোরা? বাড়ি থেকে ভিক্ষা নেয়ার নিয়ম। ছেলেরা কথা শুনবে না। জোর করে নিয়ে গেল ক্লাবে। চেয়ারে বসিয়ে গলায় মালা দিল। বলল— মহারাজ, আজ আমাদের পুণ্য অর্জন করতে দিন। প্রচুর ফল কিনে রেখেছে ক্লাবের সদস্যেরা। কোল্ড ড্রিংস খেতে দিল। ইতিমধ্যে একজন গিয়ে এক সাইকেল-রিকশা ডেকে এনেছে। চাঙ্গাড়ি ভর্তি ফল। কমলা, আপেল, কলা, সন্দেশ। ৫-৬ টা বড় বড় ঝুড়ি। মহারাজের সীটে বসিয়ে দিল তারা। পায়ের কাছে, সীটে, হাতের পাশে ফলের ঝুড়ি। “কি করছিস বল তো তোরা!” মহারাজ ধমকে দিলেও ছেলেরা পাত্তা দিল না। সীটের এককোণায় মহারাজ কোনরকমে বসলে তারা মহারাজের হাতে কয়েকটা ডাব ধরিয়ে দিল। আর রিকশাওয়ালাকে পাঁচটাকা দিয়ে বলল--- “সোজা বেলুড়মঠে যাও। মাঝপথে মহারাজকে নামতে দেবে না।”
এক বাড়িতে ভিক্ষা নিচ্ছি। ভদ্রমহিলা রুটি আর আলুর তরকারি দিচ্ছেন। পাশেই তাঁর বাচ্চা ছেলে। চকোলেট খাচ্ছিল, মাকে দেখলো কিছুক্ষণ। পড়ে আমার দিকে তাকালো। হঠাৎ ছুটে এসে পকেট থেকে একটা চকোলেট দিল আমার ঝুলিতে। ভদ্রমহিলা “কি করছো” বলে চেঁচিয়ে উঠতেই বাচ্চাটি অম্লান বদনে বললো— আমিও ভিক্ষা দিচ্ছি।
তার দিকে তাকিয়ে আমি হাসিমুখে “থ্যাংকিউ” বলতে বাচ্চাটি হতভম্ব হয়ে আমাকে দেখলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর মা’র উদ্দেশ্যে বলল— মামমি ভিখারী ইংরেজি বলছে। মা লজ্জিত।
একদিন ভিক্ষার শেষে বেলুড়মঠে ফিরে আসছি। একটা গলিতে ঢুকতেই একজন ভদ্রমহিলা থামালেন আমাকে। বললেন— একটু দাঁড়ান, ভিক্ষা দেব। তাঁকে বললাম যে আজ আর ভিক্ষা নিতে পারবো না, পাঁচ বাড়ি হয়ে গেছে। তিনি করুণ মুখে বল্লেন---দু’ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করে আছি, আপনারা কেউ এলে ভিক্ষা দেবো। কেউ না আসায় ভগবানের কাছে খুব প্রার্থনা করছিলাম যেন কেউ আসেন। আপনি এলেন, আর আমার ভিক্ষা নেবেন না? তিনি প্রায় কেঁদে ফেললেন। আমি অপ্রস্তুত। বললাম— নেবো, ভিক্ষা নিয়ে আসুন।
মঠে যখন ফিরলাম ভিক্ষার শেষে তখন ঝোলার অবস্থা খুবই খারাপ। ডাল চুঁইয়ে পড়ছে। ভেতরে ফুলকপির ঝোলে মিশে বেগুনভাজা নিস্তেজ। রুটিগুলির একপাশে দই লেগে আছে, অন্যপাশে চাটনী। খিচুড়ি আর পায়েস একসাথে মিশে গিয়ে অদ্ভুদ অবস্থা। শুক্তোর ঝোলে জিলিপি পড়ে ভেঙ্গে গেছে।
বারোটা নাগাদ আমরা সবাই ফিরে এলাম ভিক্ষা থেকে। মঠে লেগেট হাউসের কাছে বিশ্রাম করতে লাগলাম। তিনদিন ফাঁকা জায়গায় বসেই খেতে হবে, কোনো ঘরে নয়। সবার ঝুলি থেকে ভিক্ষান্ন নিয়ে একসঙ্গে রাখা হলো বিশাল গামলায়। সবকিছু মাখামাখি হয়ে একাকার। সেদ্ধ চাল, বাসমতী, আতপ চালের ভাত, মুগ-ছোলা-মুসুরী ডাল, ঝোল-চচ্চড়ি-শাক- সেদ্ধ-ভাজা, সন্দেশ-আচার-শুক্তো-পায়েস — সব মিলে মিশে মহাপ্রসাদ। হাতা দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে দেয়া হল সব।
হ্যাঁ, এর নাম মহাপ্রসাদই। খাবার ঘরে সাধুরা বসে অপেক্ষা করছেন। মহাপ্রসাদ আগে খেয়ে পরে দৈনন্দিনের খাবার। প্রেসিডেন্ট মহারাজ, অন্যান্য প্রধান মহারাজরা, সবাই অপেক্ষা করছেন এর জন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন — ভিক্ষার অন্ন শুদ্ধ অন্ন।
বাইরে গাছের নীচে লাইন করে আমরা নবীন সন্ন্যাসীরা, বসে গেলাম। শালপাতায় পরিবেশন করা হলো মহাপ্রসাদ। আমরা ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। তাড়াতাড়ি খাওয়া শুরু করলাম। কি খাচ্ছি, কেমন স্বাদ, কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। খিদে লাগলে সবই অমৃত।
— স্বামী সোমেশ্বরানন্দ
("আমার সন্ন্যাস-জীবন ও বেলুড়মঠ")
লেখাটা যতবার পড়ি ততবার মন ছুঁয়ে যায়,, তাই আবার সকলের সঙ্গে ভালোলাগাটা ভাগ করে নিলাম। (পুরনো একটি পোস্ট থেকে)
ছবি-- স্বামী শোভাত্মানন্দ মহারাজ। বেলুড় মঠ
দেব দ্যুতি এর পাতা থেকে সংগৃহিত।