27/09/2023
ছেলেবেলায় ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরলেই প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলের খোঁজ নিতেন। একবার গ্রামের একটি বাড়িতে গিয়ে দেখলেন একটি ৬-৭ বছরের মেয়ে কান্নাকাটি করছে। বিদ্যাসাগর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন যে মেয়েটি বাল্যবিধবা। একাদশীর ব্রত চলছে কিন্তু মেয়েটি খিদের জ্বালায় থাকতে না পেরে কান্নাকাটি করছে। সামাজিক বিধানকে অমান্য করার ভয়ে বাড়ির লোকজন তাকে খেতেও দিচ্ছে না। ঘটনা দেখে বিদ্যাসাগরের চোখে জল এলো। এরকম বহু বাল্যবিধবার জীবনের করুণ পরিণতিই বিদ্যাসাগরকে এই নিষ্ঠুর সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। তিনি হুগলী জেলার ১৩৩ জন ব্রাহ্মণের বিবাহের সংখ্যার একটি তালিকা তৈরী করে দেখান কিভাবে হিন্দুসমাজের কুলীন ব্রাহ্মণরা সমাজের কৌলিন্য প্রথাকে হীনস্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেওয়া হল। ভোলানাথ বন্দোপাধ্যায়, বয়স ৫৫. স্ত্রীর সংখ্যা ৮০; ভগবান চট্টোপাধ্যায়, বয়স ৬৪, স্ত্রীর সংখ্যা ৭২, পূর্ণ মুখোপাধ্যায় বয়স ৫৫, স্ত্রীর সংখ্যা ৬২; মধুসূদন মুখোপাধ্যায়, বয়স ৪০, স্ত্রার সংখ্যা ৫৬। বিধবাদের জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল পুরুষের স্ত্রী মারা গেলে যদি বিবাহ করাটা শাস্ত্রসম্মত হয় তাহলে নারীদের ক্ষেত্রে তা হবে না কেন? পাশাপাশি বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন শুধু যুক্তির নিরিখে, আইন পাশ করালেই বিধবা বিবাহ কার্যকরী হয়ে যাবে না, শাস্ত্রসম্মত ব্যাখ্যাও চাই। তাই রাতের পর রাত জেগে কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে সমস্ত শাস্ত্রে তিনি পড়তে শুরু করলেন। বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন- 'তিনি (বিদ্যাসাগর) রাত্রে ঘুমাইতে পারিতেন না। তিনি দিন দিন এই চিন্তায় এতদূর নিমগ্ন হইলেন যে, আহার নিদ্রা ভুলিয়া গেলেন। সে সময় তাঁহার পরিশ্রম যাহারা দেখিয়াছেন তাঁহাদের মুখে শুনিতে পাই যে, তিনি সংস্কৃত কলেজের পুস্তকালয়েতে বাসা করিয়া ফেলিয়াছিলেন।' অবশেষে শাস্ত্র ঘেঁটে বার করলেন বিধবাদের দ্বিতীয়বার বিয়ের বিধান। প্রবল উৎসাহের সঙ্গে শাস্ত্রীয় বিধানকে হাতিয়ার করে বিধবা বিবাহের পক্ষে প্রচার শুরু করলেন। বিধবা বিবাহ উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' নামে বইতে লিখলেন 'দুর্ভাগ্যক্রমে বাল্যকালে যাহারা বিধবা হইয়া থাকে, তাহারা যাবজ্জীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা, যাঁহাদের কন্যা, ভগিনী, পুত্রবধূ প্রভৃতি অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছেন, তাঁহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন।' বিধবা বিবাহের পক্ষে একটি আইন চালু করার জন্য একটি আবেদনপত্র লিখে বিদ্যাসাগর নিজে বিশিষ্টজনদের কাছে ঘুরে ঘুরে এবং সমর্থকদের দিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করলেন। এই ভাবে ৯৮৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর পরিচিতদের অনেকে সমাজপতিদের ভয়ে বিধবা বিবাহ চালুর পক্ষে মত দিলেও স্বাক্ষর করার সাহস পাননি। বিদ্যাসাগর তাদেরও বুঝিয়ে বিধবা বিবাহ চালুর পক্ষে কিভাবে নিয়ে আসা যায় তার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে গোঁড়ামী, অন্ধতা, কুসংস্কারে পূর্ণ মনকে বুঝিয়ে বিধবা বিবাহের পক্ষে আনাটা অতটা সহজ ছিলনা।
বিদ্যাসাগর শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের সভা ডেকে বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ দেখিয়ে বললেন- 'শাস্ত্রীয় প্রমাণ আমি যা জানি দেখাইয়াছি, তা মানা না মানা আপনাদের হচ্ছে। তাছাড়া শাস্ত্রে আছে এই আমার প্রধান যুক্তি নয়। আমার আবেদন আপনাদের হৃদয়ের কাছে, বুদ্ধির কাছে।'
সমাজপতিরা পাল্টা যুক্তি তুলে বললেন- 'আপনার কথা ঠিক, কিন্তু প্রত্যেক লোক যদি হৃদয়ের উচ্ছ্বাস বা বুদ্ধির কৌশল অনুসারে চলে, তাহলে তো সমাজ দুদিনে উচ্ছন্নে যাবে। এই জন্যই শাস্ত্র, যা শাসন করে।'
বিদ্যাসাগর বললেন – 'শাস্ত্রও যুগে যুগে বদলেছে। কারণ শাস্ত্রের চেয়ে মানুষ বড়।' কিন্তু কোনমতেই তারা মানতে রাজী নয়। বিদ্যাসাগর মশাই যাতে কোনভাবেই এই আইন চালু করতে না পারেন তার জন্য বিরুদ্ধবাদীরা অতিসক্রিয় হয়ে উঠলেন। চারিদিকে তাঁর নামে কুৎসা, নিন্দা, ব্যঙ্গ করে ছড়া লেখা এমনকি প্রাণে মেরে ফেলারও চক্রান্ত হল। কিন্তু বিদ্যাসাগর ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
এই প্রসঙ্গে 'হিতবাদী' পত্রিকায় ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু লিখেছিলেন – বিদ্যাসাগর পথে বাহির হইলে চারিদিক হইতে লোকে আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিত, কেহ পরিহাস করিত, কেহ গালি দিত। কেহ কেহ তাঁহাকে প্রহার করিবার এমনকি মারিয়া ফেলিবারও ভয় দেখাইত। বিদ্যাসাগর এ সকলে ভ্রুক্ষেপও করিতেন না। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৬ সালে ২৬শে জুলাই ‘বিধবা বিবাহ আইন' চালু হল। তখন বিদ্যাসাগরের বয়স ৩৬ বছর। রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী এ প্রসঙ্গে বলেছেন – বিদ্যাসাগরের হৃদয় ছিল একদিকে কুসুমের মতো কোমল, অন্যদিকে বজ্রের মতো কঠোর। অসহায় নারীর দুঃখে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ত, আবার এদের রক্ষার জন্য কুপ্রথা দূর করার আন্দোলনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা।' আইন চালু হলেও বিধবা বিবাহ কার্যকরী করতে গোঁড়া সমাজপতিরা প্রবল বাধা দিল। অনেক দৃঢ়তার সাথে সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে কাউকে বিধবা বিবাহে রাজী করানো হলে তাকে বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখানো হত। এমনকি সমাজে একঘরে করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হত। বিদ্যাসাগর এই সমস্ত বাধার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পাত্র পাত্রী ঠিক করে, বিয়ের সমস্ত খরচ নিজে বহন করে বিধবা বিবাহ দিতে শুরু করলেন। এমনকি বিয়ের পর অনেকের সংসার চালানোর খরচও তিনি বহন করেছেন। একাজ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, দেনায় ডুবে গেছেন, সমাজে একঘরে হয়েছেন কিন্তু প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসেননি। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে অনেকেই বিদ্যাসাগরকে উৎসাহ দিয়েছেন, সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন, বিদ্যাসাগর সকলকে বিশ্বাস করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধিকাংশই কথা রাখেনি।
#বিদ্যাসাগর #মহান_শিক্ষা