22/09/2025
জেনে নিন মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়ার ইতি-উতি
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৩৮ সালে পাঁশকুড়াতে এসেছিলেন। না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি এসেছিলেন পাঁশকুড়াতে। পাঁশকুড়ার পূণ্য ভূমি তাঁর পদচিহ্নের ইতিহাস বহন করে চলেছে। বর্তমান থেকে অতীতের ইতিহাসের সরণী বেয়ে পাঁশকুড়ার দুই ব্লকের ইতি-উতি এই রকম নানান ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করলাম।
পাঁশকুড়া নামকরণ ও ইতিবৃত্ত :
পাঁশকুড়ার নামকরণ ও ইতিবৃত্ত নিয়ে ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে নানারকম মতামত রয়েছে। বেশ কৌতুহলপূর্ণ সেই জানা-অজানা ইতিহাস গুলি।
১. তথ্যসূত্র অনুসারে, পাঁশকুড়া নামে কোনও গ্রাম অতীতে ছিলনা। কংসাবতীর নদীর দুই তীরে গড়ে উঠে ছিল কাশীজোড়া পরগনা। সেই কাশীজোড়া পরগনাই আজকের পাঁশকুড়া। এই কাশীজোড়া নাম এসেছে জোড়া কাঁসাই থেকে। খ্রিষ্টীয় আটারো শতকে বর্তমান কাঁসাই নদীর একটি শাখা গড়-পুরুষোত্তমপুর, প্রতাপপুর, রঘুনাথবাড়ি ইত্যাদি গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়নে মিশেছে। এখনও এই নদী খাতটির অবস্থান স্পষ্ট বোঝা যায়। উপগ্রহ চিত্রে চোখ বোলালে তার প্রমান মেলে। এই নদী খাতটিকে ‘ওল্ড বেড অফ কসাই’ বলা হয়। এই নদীটি কপিশা নদী বা গাঙ্গুড়্যা নদী নামে পরিচিত ছিল। নদীটির সক্রিয়তা আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে ছিল। বর্তমানে এই নদীটির অবস্থান মজে যাওয়া নানান নিকাশি নালা থেকে বোঝা যায়। এই অঞ্চলে মাটির কয়েক ফুট নিচেই রসালো বালির স্তর দেখা যায়। এই জোড়া কাঁসাই বিবর্তনের ধারায় হয়েছে কাঁসাইজোড়া- কাঁসিজোড়া- কাশীজোড়া।
২. অন্য একটি তথ্যসূত্র অনুসারে, পশংগড়া থেকে পাঁশকুড়া নাম এসেছে। কারণ অতীতে জলসেচের সুবিধার্থে মেদিনীপুর ক্যানেলের এই এলাকায় লকগেট বা পশং তৈরি করা হয়েছিল। লকগেট সংলগ্ন স্থানকে বলা হত ‘পশংগোড়া’। এই ‘পশংগোড়া’ থেকেই পাঁশকুড়া নামটি এসেছে।
৩. আরো একটি তথ্যসূত্র অনুসারে, পাঁশকুড়া নামটি ‘পঞ্চকুড়্যা’ শব্দ থেকেই এসেছে বলে মনে করা হয়। কাশিজোড়ার রাজা একবার কোলাঘাটের কানাইচকের কবি নিত্যানন্দ চক্রবর্তীকে দীক্ষার সময় কিছু জমি দান করেছিলেন। ‘শীতলা মঙ্গলে’ তার প্রমান পাওয়া যায়- ‘পঞ্চকুড়্যা জমি দিল কর্যা ব্রহ্মোত্তর।' ‘পঞ্চ’ শব্দের অর্থ পাঁচ আর ‘কুড়্যা’ শব্দের অর্থ জমির পরিমান।’। এই ‘পঞ্চকুড়্যা’ থেকেই বিবর্তনের ধারায় পাঁশকুড়া নাম এসেছে।
৪. ‘ইস্ট ইন্ডিয়া ইরিগেশন অ্যান্ড ক্যানাল কোম্পানি’ ১৮৫২ সাল নাগাদ হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া থেকে মেদিনীপুরের মোহনপুর পর্যন্ত কৃষকদের চাষ, যোগাযোগ ও বাণিজ্যের সুবিধের জন্য মেদিনীপুর ক্যানেল খনন করেছিল। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক শ্যামল বেরার মত অনুসারে, “মেদিনীপুর ক্যানেল দিয়ে যাতায়াত করা স্টিমারগুলি কংসাবতীর তীরের (বর্তমানে দক্ষিণ গোপালপুর মৌজা) কাছে এসে এক জায়গায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত তুষের বর্জ্য ছাই (পাঁশ) ফেলত। সেই থেকেই ওই এলাকার নামকরণ পাঁশকুড়া হয়েছে বলে মনে হয়।”
৫. পাঁশকুড়ার সদরঘাটে ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় 'পাঁশকুড়া মিডল ইংলিশ স্কুল'। পরবর্তীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় ব্রাডলি বার্ট হাইস্কুল। এই স্কুলের দারোয়ানদের ব্যাজে ইংরাজিতে ‘Punchcoora School’ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া, ব্রিটিশ আমলে মেদিনীপুরের কালেক্টর বেইলি সাহেব ১৮৫২ সালে তাঁর লিখিত ‘মেমোরান্ডা অফ মিডনাপুর’-এ কংসাবতী তীরবর্তী এলাকার কথা বলেছেন। এই এলাকাকে ‘পাঁচকুড়া ঘাট’ (Panchkoora Ghat ) বলে উল্লেখ করেছেন। পরে সমগ্র কাশীজোড়া পরগণার নাম পরিবর্তিত হয়ে পাঁশকুড়া নাম হয়। পাঁশকুড়া ঘাট-এর অস্তিত্ব এখন আর নেই। তবে এখনও পাঁশকুড়া থানার অফিসের সংলগ্ন সেচ দফতরের তৈরি মেদিনীপুর ক্যানেলের মুখে ১৮৯৬ সালে তৈরি লকগেট ও তাঁর সংলগ্ন এলাকা এখনও সদর ঘাট নামেই পরিচিত। সেই সদরঘাট এলাকাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল বর্তমানের পাঁশকুড়া পুরাতন বাজার
নেতাজীর সাথে পাঁশকুড়ার যোগ :
তথ্যসূত্র অনুসারে, জনসংযোগের উদ্যেশে সুভাষ চন্দ্র বসুর ১৯৩৮ সালের ১১ এপ্রিল মঙ্গলবার তমলুকে একটি জনসভা করার কথা ছিল। ঐ দিন সকালে তিনি হাওড়া থেকে রেলের তৃতীয় শ্রেণির কামরায় যাত্রা শুরু করেন। সঙ্গে ছিলেন বহু কংগ্রেস কর্মী। কোলাঘাট রেল স্টেশনে জেলাবাসীর পক্ষ থেকে সুভাষ চন্দ্রকে প্রথম অভিনন্দন জানায় জেলার এক আইন সভার সদস্য শ্রী গোবিন্দ ভৌমিক। ট্রেন পাঁশকুড়া স্টেশনে পৌঁছলে সেখানে সুভাষ চন্দ্রকে তমলুক মহকুমা কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে শ্রী সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী মাল্যদান করেন। এরপর পাঁশকুড়া থেকে সুভাষ চন্দ্রের গাড়ি তমলুকের দিকে এগিয়ে চলে। পথের দু’দিকে বিপুল জনসমাগম। ‘জোড়াপুকুরে’ তার পথ আটকানো হয়। বিপুল জনতার আবদারে জনসমাগমে তিনি ভাষন দেন। এরপর তমলুকের উদ্যেশে রওনা হয়ে যান
সৌজন্য : শ্রী রূপেশ কুমার সামন্ত