22/06/2025
কি এই অম্বুবাচী, অম্বুবাচী মেলা কেন পালন করা হয়?
প্রথমেই বলি, অম্বুবাচী সম্পর্কে সনাতন ধর্মীয় বৈদিক শাস্ত্রসমূহতে কোন কিছুই পাওয়া যায়না। তবে প্রকৃতিকে মাতৃস্বরূপা বলা হয়েছে সেই বৈদিক যুগ থেকেই। আমরা প্রকৃতির গর্ভে অবস্থান করি। আর স্বাভাবিক ভাবেই আমরা জানি গর্ভধারণ করতে হলে কোন নারীর যে প্রসেসের মাধ্যমে যেতে হয়- তার নাম রজস্বলা বা পিরিয়ড, অর্থাৎ প্রাপ্তযৌবনা কন্যার ঋতুস্রাব শুরু হলেই সে গর্ভধারণ করতে পারে। একই ভাবে পৌরাণিক গল্পগুলোতে প্রকৃতিকে একই সাদৃশ্য দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অম্বুবাচীতে প্রকৃতি মাতার ঋতুস্রাব শুরু হয়।
‘অম্বুবাচী’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘অম্বু’ বা জল সূচনা। এ ছাড়াও বলা হয় ‘রজোযুকক্ষ্মাম্বুবাচী’। আষাঢ় মাসের শুরুতে পৃথিবী যখন বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ওঠে তখন তাকে ঋতুমতী বলে মনে করা হয়। আষাঢ় মাসের প্রথম ছ’দিন চল্লিশ দণ্ডে মৃগশিরা নক্ষত্রের শেষ দুই পাদে সূর্যের ভোগ হয়। তার পরে যে তিন দিন বিশ দণ্ড পর্যন্ত সূর্য আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে থাকেন, তা-ই অম্বুবাচী। সূর্যের দক্ষিণায়নের দিন থেকে তিন দিন অর্থাৎ, আষাঢ় মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত দিনগুলিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রেও বলা রয়েছে, সূর্য যে বারের যে সময়ে মিথুন রাশিতে গমন করে তার পরবর্তী সে বারের সে সময়ে অম্বুবাচী হয়। এই সময় থেকেই বর্ষার সূচনা। এ ক্ষেত্রে উর্বরতাকেন্দ্রিক ভাবনায় নারী এবং ধরিত্রী যেন সমার্থক হয়ে ওঠে। অম্বুবাচীর আগের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী প্রবৃত্তি’। তিন দিনের পরের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী নিবৃত্তি’। এর পরেই চাষিরা আবার চাষাবাদ শুরু করতে পারেন। বর্ষার পর মানুষ নতুন ধারণ রোপন করে, ফসল ফলায়। এটিই মূলত অম্বুবাচী।
এখন পশ্ন আসতে পারে যে, তাহলে কার্জকর্ম থেকে বিরত থাকতে হয় কেন? এর উত্তরও পৌরাণিক গ্রন্থ গুলোই দিবে। কারণ শ্রুতিতে নারীদের পিরিয়ড নিয়ে কোন কথা নেই। এর কারণ হচ্ছে, বৈদিক যুগে নারী পুরুষগন এটিকে শরীরের স্বাভাবিক ক্রিয়া মনে করতেন। তাই আলাদা ভাবে আলোচনার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু পৌরাণিক দৃষ্টিতে পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে নারীদের অশুচি মনে করা হয়। আর অশুচি থাকাকালীন মেয়েরা সাবান, শ্যাম্পু, নখ কাটা, চুল কাটা ইত্যাদি কাজগুলো করতে দেওয়া হয়না। ঠিক তেমন ভাবেই অম্বুবাচী চলাকালীন সময়ে জমিতে লাঙ্গল দেওয়া হয়না। কাপর কাচাকাচিও করা হয়না। এমন কি ধরিত্রীর বুকে আগুনও ধরানো হয়না। রজস্বলা নারীদেরকে যেভাবে পূজা দিতে বাধা দেওয়া হয়, তেমনি অম্বুবাচীতে কোন দেবদেবীর মন্ত্র উচ্চারণ করে পূজার্চনা হয়না। যদিও এগুলো পৌরাণিক প্রথা, বৈদিক শাস্ত্র এবং বিজ্ঞান বিরুদ্ধ। অসমের কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচী প্রথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়। নীলাচল পর্বতের শীর্ষে কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচীর সময়ে যে মেলা বসে, সেটিই পূর্ব ভারতের বৃহত্তম ধর্মীয় জমায়েত (biggest religious congregation)। এই বছর শুধুমাত্র পুরোহিতেরা অম্বুবাচীর প্রথা (Ambubachi Rituals) পালন করছেন। গর্ভগৃহের বাইরে থেকে দেবীকে শুধুমাত্র ফল দিয়ে উপাসনা করবেন পুরোহিতরা।
গৌহাটি শহরে নীল পর্বতে অবস্থিত দেবীর এই শক্তিপীঠ। ভগবতী সতী দেবীর যোনি পীঠ এই নীল পর্বতে পতিত হয়। দেবীর নাম কামাখ্যা আর ভৈরব হলেন উমানন্দ। ভারতবর্ষে এই তীর্থ বহু প্রাচীন। বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণে এই শক্তিপীঠের নাম পাওয়া যায়। কামাখ্যা দেবী হলেন মহাষোড়শী।
দেবী কামাখ্যার পঞ্চ মূর্তি ও অষ্টযোগিনী আছে। পঞ্চ মূর্তি হল- কামাখ্যা, কামেশ্বরী, ত্রিপুরা, সারদা, মহোৎসহা।
অষ্টযোগিনীরা হলেন- কটীশ্বরী, গুপ্তকাশী, শ্রীকামা, বিন্ধ্যবাসিনী, পাদদুর্গা, দীর্ঘেশ্বরী, ধনস্থা ও প্রজটা। কামাখ্যা ধামে অম্বুবাচী কে কেন্দ্র করে বিশাল মেলা বসে। এই সময় বহু সাধু সন্তদের আগমন হয়।
🌺 শ্রী শ্রী কামাখ্যা ধ্যানম্ 🌺
রবিশশিয়ুতকর্ণা কুংকুমাপীতবর্ণা
মণিকনকবিচিত্রা লোলজিহ্বা ত্রিনেত্রা ।
অভয়বরদহস্তা সাক্ষসূত্রপ্রহস্তা
প্রণতসুরনরেশা সিদ্ধকামেশ্বরী সা ॥ ১॥
অরুণকমলসংস্থা রক্তপদ্মাসনস্থা
নবতরুণশরীরা মুক্তকেশী সুহারা ।
শবহৃদি পৃথুতুঙ্গা স্বাঙ্ঘ্রিয়ুগ্মা মনোজ্ঞা
শিশুরবিসমবস্ত্রা সর্বকামেশ্বরী সা ॥ ২॥
বিপুলবিভবদাত্রী স্মেরবক্ত্রা সুকেশী
দলিতকরকদন্তা সামিচন্দ্রাবতংসা ।
মনসিজ-দৃশদিস্থা য়োনিমুদ্রালসন্তী
পবনগগনসক্তা সংশ্রুতস্থানভাগা ।
চিন্তা চৈবং দীপ্যদগ্নিপ্রকাশা
ধর্মার্থাদ্যৈঃ সাধকৈর্বাঞ্ছিতার্থা ॥৩
পুরান মতে-স্বামীর অপমান সইতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করলেন। প্রিয় স্ত্রীকে হারিয়ে, তাঁর দেহ নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করলেন মহাদেব। চারিদিক তখন তোলপাড়। শিবের নৃত্যে সব ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এই জগতকে রক্ষা করতে দেবতাদের অনুরোধে ভগবান বিষ্ণু ভগবান শিবের ক্রোধ দমন করার পন্থা বেছে নেন। বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। ৫১টি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে শরীরের এক একটি অঙ্গ। যা আজ ৫১টি পীঠস্থান। কামাখ্যা মন্দির সেই ৫১টি পীঠস্থানের একটি। সেখানে নাকি ছিটকে পড়েছিল সতীর যৌনাঙ্গ। তাই সেখানে দেবীর মূর্তি পুজিত হয় না।অসমের কামাখ্যা মন্দির, ধার্মিক কারণে তো বটেই, সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেও জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রত্যেক বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করে এই মন্দিরে। বিশেষ করে অম্বুবাচী মেলার সময় ভিড় হয় চোখে পড়ার মতো। সেই সময় পুজিত ভূগর্ভস্থ এলাকা লাল হয়ে থাকে। মন্দিরের নালা দিয়ে বেয়ে যায় লাল জল। এই ঘটনাকে মায়ের ঋতুস্রাব বলে অনেকেই মনে করেন। এই সময় নাকি দেবী ঋতুমতী হন। তিনদিন ধরে এমনটা চলতে থাকে। মন্দিরের মূল কক্ষে তখন কারও প্রবেশে অনুমতি থাকে না। মা নাকি এই সময় কারোর সঙ্গে দেখা করেন না, এমনটাই বিশ্বাস অনেকের। এসবকেই মায়ের লীলা বলে মনে করা হয়। যদিও বিজ্ঞান অন্য কথা বলছে। ওই এলাকায় আয়রন অক্সাইডের প্রভাবের কারণেই ভূগর্ভস্থ এলাকা লাল হয়ে থাকে।
মাটি ৮০০ মিটার উঁচুতে রয়েছে এই মন্দিরটি। নিলাচল পর্বতের পশ্চিমাংশে গুয়াহাটি শহরে রয়েছে এই মন্দিরটি। এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা নিয়ে জড়িয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। ইতিহাস বলছে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা হয়। পাল বংশের রাজারাই নাকি ছিলেন কামাখ্যা মায়ে আদি ভক্ত। পরবর্তীকালে পালবংশের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর মন্দিরটিরও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা শোনা যায়। কামরূপের শাসন ভার আসে কোচবিহারের রাজ পরিবারের হাতে। বিশ্বসিংহ নামে কোচ বংশীয় রাজা পুনরায় ওই মন্দিরটির পুনর্নিমাণ করেন। এমনই বহু ইতিহাস রয়েছে এই মন্দিরের স্থাপত্যকে ঘিরে।এই মন্দিরে রয়েছে চারটি কক্ষ। একটি গর্ভগৃহ ও তিনটি মন্দির। গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে সরু সিঁড়ি দিয়ে কক্ষের নীচে নেমে যেতে হয়। পৌরাণিক কাহিনি আজও মানুষকে ডেকে আনে এই মন্দিরের দর্শন করতে....
জয় মা কামরূপ কামাখ্যা কি জয়.......
লোকবিশ্বাস মতে, আষাঢ় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মা ঋতুমতী হন। আর সেই সময়তেই পালন করা হয়ে থাকে অম্বুবাচী।
পড়ছে অম্বুবাচী অর্থাৎ, বাংলা ক্যালেন্ডার মতে ৭ আষাঢ়। দুপুর ২.০৭ মিনিট থেকে অম্বুবাচী শুরু হচ্ছে। টানা তিনদিন ধরে চলবে এই পার্বণ। অম্বুবাচী তিথি শেষ হচ্ছে ২৫ জুন। অর্থাৎ ১০ আষাঢ়। সেদিন রাত ২:৩০ মিনিটে ছাড়ছে অম্বুবাচী। শাস্ত্রমতে অম্বুবাচীর এই ৩ দিন সব ধরনের মাঙ্গলিক এবং শুভকাজ, যেমন বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, গৃহ প্রবেশ, গৃহ আরম্ভ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিত। কৃষিকার্য সংক্রান্ত কোনও কাজও এই সময় করা হয় না।
তবে এবছর করোনা বিধি মেনে অম্বুবাচী মেলা বন্ধ রাখা হয়েছে। মন্দিরের ইতিহাসে সতেরো শতকের পর থেকে এই প্রথম অম্বুবাচী মেলা বন্ধ রাখা হলো করোনা সংক্রমণ আটকাতে। আগামী ৩০ শে জুন পর্যন্ত মন্দির বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মন্দির কতৃপক্ষ
তথ্য সমূহ সংগৃহীত