11/07/2025
একটা পাহাড়ি গ্রামের নাম কেউ জানে না।
গুগল ম্যাপেও হয়তো তার লোকেশন ঠিকঠাক দেখায় না,
পথ চিনিয়ে দিতে পারেনা কোন লোকাল বাস,
এমনই দুরবস্থা,
সাইনবোর্ডেও তার ঠাঁই মেলেনা,
নামটি জানেন সেই গ্রামের?
জিলিংসেরেং, শোনেননি তো?
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের কোলঘেঁষে,
যেখানে লাল মাটির ধুলোর উপরেই সকাল নামে,
আর সন্ধ্যা নামে বিকেলের মধ্যেই।
সেই গ্রামে শিশুরা স্কুলের ঘণ্টা শোনে না,
শোনে গ্রামের নিস্তব্ধতা।
আর শেখে জীবনের পাঠ।
সেই গ্রামে মায়েরা হাঁড়ি চড়ান আগুনে,
আর মেয়েরা শিখে যায় নীরব থাকা, স্বপ্ন না দেখতে শেখা।
এমনই এক গ্রামে,
একজন তরুণী পা রেখেছিলেন ২০১৯ সালে,
বিয়ের পর নতুন সংসারে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
নাম তাঁর মালতী মুর্মু।
আর এখানেই শুরু হয় গল্পের বাঁক...
মালতী তখনও জানতেন না,
একদিন নিজের হাতেই তুলবেন গুটিকয়েক শিশুর ভবিষ্যৎ। গড়ে তুলবেন এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত।
তবে চারপাশ দেখে তিনি বুঝেছিলেন,
এই নীরবতার নিচে জমে আছে অজস্র অপূর্ণতা।
শুধু উচ্চমাধ্যমিক পাশ মেয়েটি
দেখলেন এই গ্রামের শিশুরা স্কুলে যায় না।
যদিও আছে একটা বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুল,
কিন্তু সাঁওতাল শিশুদের মাতৃভাষা অলচিকি সেখানে নেই,
শিক্ষার্থীরা শব্দ বোঝে না, বইয়ের পাতায় নতুন ভাষা খুঁজে পায় না।
তিনি ভাবলেন,
“আমার ঘরই তো হতে পারে তাদের প্রথম বিদ্যালয়।”
তারপর যা করলেন, তা ইতিহাস নয়, তৈরি হল ভবিষ্যতের ভিত্তি।
নিজের মাটির ঘরের উঠোনে,
স্বামী বাঁকা মুর্মুর পাশে নিয়ে,
তিনি শুরু করলেন এক অলিখিত পাঠশালা।
কোনো সরকারি সাহায্য ছিল না।
না মিড ডে মিল, না ছাতা দেওয়া অনুদান, না বই পাঠানো দফতর।
তবু, একটা মন, এটকুখানি ইচ্ছা, আর কয়েকটি ছোট মুখই ছিল যথেষ্ট।
আজ সেই পাঠশালায় প্রায় ৪৫টি শিশু আসে,
প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে।
মালতী দেবী পড়ান, অলচিকি, বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক।
গান শেখান, গল্প বলেন, ছড়া শোনান।
তার দেড় মাসের ছোট বাচ্চা আর চার বছরের ছেলের দেখভালের ফাঁকেই তিনি ছড়িয়ে দেন আলোর অক্ষর।
গ্রামের মানুষ পাশে এসে দাঁড়ায়। মাটির দেয়াল তুলে দেয়, ঝুপড়ি ঘরটি হয়ে ওঠে ছোট্ট স্কুলঘর।
স্বামী বাঁকা মুর্মু বলেন,
"পঞ্চম শ্রেণির পর ১২ কিলোমিটার দূরে স্কুল,
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গিয়ে কতজন বা যেতে পারে?"
তাই নিজের টাকায় বই কিনে আনেন তারা ঝাড়গ্রাম থেকে।
জানেন কেন?
“যেন এই শিশুগুলো অন্তত নিজের ভাষাটাকে চিনতে শেখে।”
আর এখানেই আসে আমাদের প্রশ্ন,
আমরা যারা আলোয় থাকি,
তারা কি কেবল বাহবা দিতেই শিখি? নাকি কোনো দিন দাঁড়াতে পারি এই আলোর মশালধারীর পাশে?
জানেন কি?
আজও সেই পাঠশালায় নেই পর্যাপ্ত খাতা–কলম,
নেই আলো, নেই সোলার ল্যাম্প, নেই চেয়ারের ব্যবস্থা।
একটা পেনসিল, একটা পুরোনো বই,
একটা ব্যাটারিচালিত লাইট,
সেগুলোর পিছনেও লড়াই করেন মালতী মুর্মু স্বয়ং।
লকডাউনের সময়েও বন্ধ হয়নি তার ক্লাস।
যখন গোটা দেশ ঘরে আটকেছিল,
তখন মালতীর উঠোনে খোলা ছিল ভবিষ্যতের দরজা।
আমরা যারা সভ্যতার আলোতে বাস করি,
তারা কি শুধু গল্প শুনেই থেমে যাবো?
না কি কোনোভাবে সেই গল্পের পাশে দাঁড়িয়ে
একটুখানি আশার রং লাগাতে পারি?
না, আপনাকে মাঠে নামতে হবে না,
আপনাকে গ্রামে গিয়ে স্কুল করতে হবে না।
শুধু একটুখানি সাড়া দিলেই হয়।
একটা পুরোনো বই,
একটা খাতা–কলমের সেট,
একটি সোলার ল্যাম্প কারও পক্ষে পাঠানো হয়তো সহজ।
কিংবা শুধু এই গল্পটা অন্য কাউকে জানানো, মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
কোনো পত্রিকা, কোনো সংগঠন,
কোনো সাহায্যপ্রবণ মানুষ অথবা প্রতিষ্ঠানের কানে পৌঁছে দেওয়া,
তাতেও শুরু হতে পারে বদলের ঢেউ।
সব কাজ আমাদের একার নয়,
কিন্তু একটা ছোট কাজও অনেক কিছু বদলে দিতে পারে,
যদি আমরা তা একসাথে করি।
আমাদের সম্মিলিত ভরসাই একদিন হয়ে উঠতে পারে
একটি বিকল্প শিক্ষা এবং বিপ্লবের ভিত।
মালতী মুর্মু,
আপনি শুধু একজন গৃহবধূ নন,
আপনি এই সময়ের নীরব শিক্ষানায়িকা।
আপনি প্রমাণ করেছেন
আলো, তখনই আলোকিত হয়
যখন তা অন্যের অন্ধকার ভেদ করে পথ দেখানোর ক্ষমতা রাখে।
🔖 #মালতীমুর্মু
🔖
🔖
🔖 #পাহাড়েরপাঠশালা
🔖
🔖
🔖
🔖
🔖 #অলচিকিকথা
🔖