28/08/2025
৭ম বর্ষ পদার্পণ উপলক্ষে বিশেষ গল্প আয়োজনের তৃতীয় গল্প-
||ইলুর সংসার||
লেখা- আব্দুল্লাহ নূর রবি
____________________
(উৎসর্গ :- ইলেনিয়া।
আমি সবচাইতে বেশি ঝগড়া করি যার সাথে সে হলো এই ইলু, অর্থাৎ লেখক ইলেনিয়া। অথচ সর্বান্তে দেখা যায় ও-ই হলো আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু/ শত্রু। ওর হাত ধরেই আমরা সেই গত ২০২০ সাল হতে এই পেইজটিকে এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। আমার নিজেকে লেখক হিসেবে মনে হয় না, অথচ এই ইলুই সবসময় আমার লেখনীর এত সুন্দর পর্যালোচনা করে যে মনে হয়, আমি কত বড় লেখক। আজকের এই গল্প পুরোটাই ওকে উৎসর্গ করে আর ওকে নিয়েই লেখা। যদিও বাস্তবের সাথে এই গল্পের কোনো মিল নেই।)
১. ঢাকার এক পুরনো পাড়ার ভেতর, নাগরিক কোলাহল থেকে একটু আড়ালে, এক নিভৃত ভগ্নদশা সরু গলি নীরবে বেঁচে আছে, নাম ভূতের গলি। নামটা শুনলেই যেন বুকের ভেতর কাঁপুনির সৃষ্টি হয় অনেকের, অথচ বাস্তবে এখানে আছে সাদামাটা জীবনের জোড়া জোড়া কিছু পদচিহ্ন। গলির দুপাশে মাথা নুয়ে থাকা কিছু বাদামি রঙপড়া টিনের চালাঘর, দেয়ালের ফাটলে বুনো বট অশ্বথের গাছ মাথা তুলেছে বহু আগেই। স্থানে স্থানে স্ট্রিট ল্যাম্পের ভঙ্গুর মরচে ধরা খুটি, তার পুরোনো বাতির কটকটে ধিমিধিমি আলোয় এখানে আজও সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে। সন্ধ্যের শঙ্খধ্বনি কিংবা আযানের সাথে সাথেই বাতাসে ভেসে আসে এ বাড়ি ও বাড়ির রান্নার আর লঙ্কা পোড়ার তীব্র ঝাঁঝালো কটু গন্ধ, আর রাত বাড়তেই বাসি শিউলি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ মিইয়ে গিয়ে পাশের বাগান থেকে সদ্য ফোটা নতুন হাসনাহেনার ঘ্রাণে ঘরের কোণ থেকে গলিময় পথ চনমনে হয়ে ওঠে।
এই গলির এক কোণেই আছে মোগল আমলের পুরাতন ক্ষয়ধরা কালচে ইটের এক দ্বিতল ভবন, যেথায় আমরা গত ছয়টি মাস যাবত সংসার পেতে বসেছি। খুবই ছোট্ট আমাদের সংসারটি। আমরা বলতে, আমি ইলু মিয়া, হাসনাহেনার মতোই সদ্য কৈশর পেরুনো যুবক এ বাড়ির ক্ষুদ্র এক ভাড়াটিয়া এবং আরেক ভাড়াটিয়া মধ্যবয়সী ছিপছিপে চেহারার সংগীত শিক্ষক মোনায়েম আকন্দ চাচা, যিনি এ বাড়ির অন্যতম প্রধান সদস্য। এছাড়াও আছে দুই গৃহকর্মী তথা তোরাব মিয়া আর জয়ের মা হাসিনা বেগম ওরফে হাসু আপা। তোরাব মিয়ার বয়স আমার চায়তে সামান্য বেশি, তবে গঠনবঠনে একেবারে লিকলিকে হ্যাংলা পাতলা কালো করে দেখতে। আমার চায়তেও কমবয়সী লাগে। সে এ বাড়ির রোজকার বাজার সদাই থেকে শুরু করে ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া, বাগানে পানি দেওয়া, আর এ বাড়ি প্রহরা দেওয়ার মতো টুকরো টুকরো করে সব ধরনেরই কাজই করে থাকে। কি জানি এত কাজের পরেও মালিক কত টাকা বেতন ধার্য করেছে তার। জয়ের মা হাসিনা আপা হুলস্থুল চেহারার মধ্যবয়সী রাগিসাগি এক মহিলা। তারও চেহারায় অস্বচ্ছলতার স্পষ্ট ছাপ, চোখগুলো নির্ঘুম, চেহারায় নিরেট রুক্ষতা। একসময় সেই এই বাড়ির রান্নাসহ ঘরকন্নার কাজ করতো, কিন্তু এখন রান্নাবাদে তোরাবের সাথে ঘরকুনোর বাকি সব কাজেই হাত লাগাতে হয় তার। আর এজন্য আমার উপর তিনি বেজায় ক্ষীপ্ত। কারণ তার রান্নার দায়িত্ব এখন আমার উপরেই অর্পিত। আমি মোটামুটি ভালোই রান্না করতে পারি, ক্যাম্পাসে সেদিনও ভালোই সুনাম ছিলো, আর তারই সুবাদে এ বাড়ির মালিক তথা জালাল চাচা আমায় ক্যাম্পাস থেকে তুলে এনে তার এ নিবাসের স্থায়ী আশ্রিত করে দিলেন৷ শর্ত হলো আমায় প্রতিদিন তার একমাত্র সুপুত্রের জন্য, মোনায়েম চাচা আর তার নিজের জন্য রান্না করতে হবে, আর এর দরুন আমার মাসিক ভাড়া তো লাগবেই না বরঞ্চ তিনবেলার খাবারও পাবো সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই। এ যেন মেঘ না চায়তেই জল কিংবা হঠাৎ করেই অভাগার অমৃতলাভের মতো ব্যাপার হলো।
আমি পাশেরই একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের একজন ছাত্র হিসেবে এই মাত্র অল্প কয়েক বৎসর যাবত এ শহরে এসেছি। ঠিকঠাক মতো এখনও কিছুই চিনি না শহরের। বাবা সামর্থ্য মতো টাকা পাঠান, আর বাকিটা আমি টিউশনি করিয়ে জমাই। তবে হঠাৎ করেই সময়ের সাথে তাল মেলাতে না পারায় কয়েকটা টিউশনে বিরতি দিয়েছিলাম। তাই আর্থিক অবস্থাও ছিলো সঙ্গিন। মেসের ভাড়াও জমে গিয়েছিলো কয়েক মাসের, হাতে ছিলো না হাত খরচ এমনকি খাবার কেনার পয়সাটুকুও। ভার্সিটির বন্ধু বান্ধবরা দয়াপরবশ হয়ে তাদের ক্যাম্পাসে লুকিয়ে বাঁচিয়ে আশ্রয়ে রেখেছিলো কিছুদিন। ঠিক সেই সময়েই জালাল চাচা প্রদীপের জ্বীনের মতো হাজির হয়ে বললেন, বৎস, মাঙো, তোমার তিন তিনটি ইচ্ছে??
আর আমিও যেন সোনার হরিণ হাতছাড়া হবার ভয়ে ইতস্তত করে তৎক্ষনাৎই চেয়ে বসলাম, খাদ্য, বাসস্থান এবং নিরাপত্তা।" ওমনি তিনি কোলে করে আমায় তাদের বাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে এলেন। আসলে ব্যাপারটা ঠিক সেভাবে না হলেও, তিনি কার কাছে যেন আমার কথা শুনেছিলেন। তখন এক দুপুরে তিনি এসে বললেন, ভূতের গলিতে আমাগো ফ্ল্যাট আছে একটা। ফ্ল্যাট বললে ভুলই হবে। বাসাবাড়িই কয়তে পারো, সামনে ওঠান এবং বাগানও আছে বিশাল একটা। আমাগো তোরাব মিয়া সুযোগ পায়লেই ফল ফলাদির গাছ লাগায়, সবজি চাষ করে। যাই হোক, আসল কথা হয়লো আমার পোলাডায় একা একাই থাকে এই বাড়িতে। সেও তোমাগো এই ভার্সিটিরই একজন ছাত্র আর খুব নামকরা ছাত্রও বটে। রেজাল্ট যেমন তেমনই হোক সাংঘাতিক ক্রিকেট খেলে, প্রত্যেক বারই ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়। ভাবছি পড়ালেখার না করলে তারে ক্রিকেটারই বানামু। আচ্ছা থাক ওসব কথা, কথা হয়লো ঐ বাড়িতে একজন রাঁধুনি খালাও আছে। তার হাতের রান্না আমাগো সবার ভালো লাগলেও আমার পোলাডার নাকি ভালো লাগে না, ঘিন্না করে। তাই সে বাড়িতে খাবার খায় না৷ কি জানি কোথায় ঘুরে ঘুরে কাকের মতন কোন অখাদ্য কুখাদ্য গিলে। শুনলাম তুমি খুব ভালো রাঁধতে জানো। আবার তোমার নাকি থাকা খাওয়ারও ব্যাপক সমস্যা চলতাছে। তাই, ভাবলাম তোমার জন্য প্রস্তাবটা উপযুক্ত হয়বো। আমাগো বাসায় রাঁধতে পারবা? মাস শেষে সামান্য কিছু হাত খরচও পায়বা, আর থাকাখাওয়ার খরচও সম্পূর্ণ ফ্রি। এহন কও, প্রস্তাবটা কেমন লাগলো, রাজি আছো তো??
প্রস্তাবটা যেন আমার নিকট সোনার হরিণ প্রাপ্তির মতোই মনে হলো। তাই আর একবিন্দুও সংকোচ না করে তারপর দিনই এ বাড়িতে এসে ওঠলাম। তারপরেই একেক করে পরিচয় ঘটলো সবার সাথে৷ সেই তোরাব ভাই, জয়ের মা অথবা মোনায়েম চাচা। আর একজন সদস্যও যে এই বাড়িতে থাকতো প্রথম পনেরোদিন তাকে এক নজরের জন্যেও দৃষ্টিসীমার আওতায় নাগাল পাইনি। এরপর একদিন হঠাৎ করেই সকালে এরওর ঘর গুছাতে গিয়ে নজরে পড়লো দ্বিতীয় তলার সবচায়তে পশ্চিম কোণের ঘরে কে যেন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। সময় তখন নয়টা কি সাড়ে নয়টা। আমি কোনো কথাবার্তা না বলেই তার রুমের মেঝে আর খাটের তলায় ঝাঁট দিচ্ছিলাম। তবে যেই খাটের তলা থেকে মাথা বের করে দাড়িয়ে একবার ফের খাটের দিকে দৃষ্টি দিলাম, ওমনি আমার চক্ষু বিস্ফোরিত হবার অবস্থা। লোকটি গায়ের কম্বলটি পাশে ঠেলে দিয়ে সম্পূর্ণ দিগম্বর শরীরে হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙছিলো।। সে ভাবতেই পারেনি হঠাৎ করে তার রুমে কেউ এভাবে চলে আসবে, অতএব প্রথমবার আমায় দেখে সে ছিটকেই ওঠাটাই স্বাভাবিক। সে ছিটকেও ওঠলো ভীষণরকমের। তারপর পাশের কম্বল টেনে শরীরের লজ্জাস্থানগুলোকে যতটা সম্ভব আড়াল করে আড়ষ্ট গলায় বলে ওঠলো, এই এই, আমার রুমে কি করছো তুমি?? তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না! কে তুমি? বলা নেই কওয়া নেই আমার রুমে ঢুকেছো কেন? শুনেছি এ বাড়িতে নতুন একটা বাবুর্চি ছেলে এসেছে, তুমিই কি সে??
আমি তখনও কিছুটা লজ্জায় আর কিছুটা সংকোচে আনত হয়ে ছিলাম। তবুও লজ্জা ভেঙে জবাব দিলাম, জ্বি। আমিই সে। আমার নাম ইলেনিয়া। সবাই ডাকে ইলু মিয়া। আপনাদের ভার্সিটিতে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি।
সে অনাগ্রহ দেখিয়ে বললো, আচ্ছা আচ্ছা থাক। আর বলতে হবে না। তুমি এখন যাও। আর শুনো পরের বার থেকে না বলে কয়ে আমার রুমে ঢুকবে না, প্রায় সময়ই আমার শরীরে কোনো কাপড় টাপড় থাকে না।। পরে নিজেও লজ্জায় পড়বে আর আমাকেও লজ্জায় ফেলবে। বুঝলে, মনে থাকবে তো? আর হ্যা, তুমি না বাবুর্চি, তো তোমার হাতে ঝাঁটা কেন?? এসব কাজের জন্য তো তোরাব আছে, ও কই?
আমি মেকি হেসে বললাম, আজ তো ছুটির দিন। তাই ভাবলাম বাড়িটাকে ঝাড়পোঁছ করি। তোরাব ভাই মনে হয় ঠিক মতো কাজকর্ম করে না। কেমন ধূলোময়লা আর মাকড়শার জাল দিয়ে বাড়িটা ভুতুরে হয়ে আছে। মনে হয় যেন সত্যিই কোনো ভূত টুত থাকে এ বাড়িতে।
লোকটি রহস্যের হাসি হেসে বললো, থাকতেই পারে। সন্দেহ আছে কোনো?? শুনো রাত বারোটার পর এ বাড়িতে ভূতেরা টহল দিয়ে বেড়ায়৷ তাই একা একা যখন তখন বাইরে বেড়িও না কেমন!
বলেই লোকটি খিটমিট করে হেসে ফেটে পড়লো। এরপর হাসি থামিয়ে বললো, শুনো। তোমার হাতের রান্না কিন্তু খুব ভালো হয়। এতদিন আমি বাসায় খেতাম না, কাল রাতেই প্রথম খেয়েছি। খুব ভালো লেগেছে। ভাবছি এখন থেকে রোজ বাড়িতেই খাবো। আজ সকালে কি রেঁধেছ শুনি? খিদে খিদে লাগছে কেমন, কিছু খাবার হবে কি?
আমার খাবার রান্না করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিলো। যেদিন যা রাধতাম তাই সবাই খেতো, কেউ কিছুটি বলতো না বারণ করতো না। তাই আজ সকালেও নিজের মর্জি মতো খিচুরি রেধেছিলাম। আর তাই তাকে এনে খেতে দিলাম। সে খুব আয়েশ করে খেলো। খাওয়া শেষে এক গাদা প্রশংসাও করলো। তবে তখনও তার বিস্তারিত পরিচয় এমনকি নামখানাও বললো না মুখ ফসকে । অবশ্য পরে এক রাতে গানের বৈঠকে বসে জালাল চাচার কাছ থেকে জেনেছিলাম তার নাম হলো ইমন বকশি। মোহাম্মদ জালাল বকশির একমাত্র সুপুত্র মো. ইমন বকশি। সেই ছোটোবেলায় মা হারিয়ে ছেলেটা কেমন ঘরছাড়া চোরের মতো স্থানে স্থানে ঘুরে বেড়ায়। আগে চেহারায় কেমন লাবন্য ছিলো, আকর্ষণ ছিলো, বড় হয়ে যে পিতার মতোই পৌরুষ খেলবে শরীরে সে ভাবনা সবারই ছিলো। কিন্তু ছেলেটা কারো ভাবনাকেই সাকার করতে পারেনি। বরং দিনদিন কেমন শুকিয়ে রোগা পাতলা হয়ে যাচ্ছে আরও। যেন ঝড় এলেই উড়িয়ে নিয়ে যাবে সাথে। আমি মনে মনে ভাবতাম, এই ছেলেই নাকি ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন?? তবে এটাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ছেলেটা আসলেই ভীষণ সহজ সরল উদার প্রাণের মানুষ। প্রথমদিনেই কেমন রসিকতা শুরু করে দিয়েছিলো আমার সাথে। তবে এরপর মাঝে অনেকদিন সময় চলে গেলেও সকাল কিংবা রাতে ইমনের সাথে আর আমার দেখা হবার সৌভাগ্য হয়নি।
বিষয়টি কেমন গোলমেলে বা অদ্ভুত লাগতো। বাড়ির ছেলে কেমন করে এমন ভবঘুরে জীবন কাটাতে পারে? সেকি গৃহস্থ নাকি মরুর বেদুইন? আমি কয়েকদিন গভীর রাত পর্যন্তও জেগে থেকেছি, এমনকি ঐ ভূতের ভয় উপেক্ষা করেও রাত বারোটা পার করে ফেলেছি। কিন্তু ইমনের দেখা আর পাইনি। এই নিয়েই সেদিন রাতের বৈঠকে আলাপচারিতা হচ্ছিলো। সংগীতশিল্পী মোনায়েম চাচা প্রায় প্রতি রাতেই হারমোনিয়াম বাজান, গভীর রাত পর্যন্ত সারগাম চর্চা করেন। মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর গানও বাঁধেন। আর তখনই জালাল চাচা তার কক্ষে গিয়ে বসেন, কিছুক্ষণ পান চিবুতে চিবুতে চুপটি করে তার মায়াবী কন্ঠের আবহে হারিয়ে যেতে থাকন। এক পর্যায়ে নিরবতা ভেঙে তিনিও গেয়ে ওঠেন তার পরিপক্ব তবে ভগ্নপ্রায় গলায় বিরহের গান। তাদের এ সুরের যুদ্ধ আমাকেও প্রচুর আকর্ষণ করে, তখন আমিও চলে যাই সেখানে৷ মাঝে মাঝে তারা আমাকেও গান ধরতে বলেন। তখন উপায় না পেয়ে আমিও গেয়ে যাই প্রাণের কোনো গান।......
আমার ভাঙা ঘরে, ভাঙা চালা, ভাঙা বেড়ার ফাঁকে।অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে, হাত বাড়াইয়া ডাকে। অথবা, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, বন্ধুয়ারে কইরো তোমার মনে যাহা লয়.....!!
এই সমস্ত গানগুলি গায়তে আমার কেমন জানি ভালো লাগে। পরিচিত এক প্রশান্তিতে তানমন জুরিয়ে ওঠে। তারাও কেমন তন্ময় হয়ে শুনে আমার কন্ঠধ্বনি। মোনায়েম চাচা সুর ধরে ধরে হারমোনি বাজান, আর জালাল চাচা খঞ্জনি ধরেন। মাঝে মধ্যে তোরাব মিয়াও চলে আসেন নিচ তলা থেকে। তারপর সেও গানের ধুনো ধরে সজোরে টান দিতে দিতে হঠাৎই ফ্যাঁত করে কেঁদে ফেলে।
গান শেষে ইমনের কথা তুলে জালাল চাচা বহুক্ষণ আফসোস করলেন, কেঁদে বুক ভাসালেন। আমি কেমন যেন স্থির হয়ে গেলাম তার কথাগুলো শুনে। মানুষের কষ্ট কেন যে আমায় এমনভাবে কাতর করে তুলে, জানিনা।
________________
২.
সে রাতে গান শেষে দ্বিতলার বেলকনি ধরে আমার শোবার ঘরে ফিরছিলাম। আমার কক্ষটি মূলত প্রথমতলার সিঁড়ির সাথেই লাগোয়া। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আমি যখন নিচে নামছিলাম, আচমকা কারো ছায়া আমার শরীর স্পর্শ করে গেলো যেন মনে হলো। কি জানি কি মনে করে শরীর জেগে ওঠলো হঠাৎ করেই। লোমগুলি পর্যন্ত দাড়িয়ে গেলো তীক্ষ্ম তীরের ফলার মতো। তবুও ভয়কে শান্ত করে জোরস্বরে শ্বাস ফেলে আমি আরও কয়েক পা বাড়ালাম। ওমনি আরও একবার শব্দ হলো কিছুর। তখন মনে পড়লো ইমনের সেই সকালের গল্পের কথা। আসলেই ভূত টুত নেই তো এ বাড়িতে? এমন পুরাতন মরচে ধরা ভূতুরে বাড়ি, থাকতেই পারে কিছু একটা। নয়লে এমন বিনামূল্যে কাউকে কেউ থাকতে দেয় এমন করে? নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল আছে বৈকি।
এসব ভেবে যেই আরও একটু অগ্রসর হলাম, সামনে থেকে কালো করে কিছু একটা এসে জোরস্বরে 'হাউ' করে ওঠতেই যেন আমার পিলে চমকে ওঠলো। জোরালো আতঙ্কে শরীর সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে আমি সিড়িঁতে বসে পড়লাম, ওমনি নজরে আসলো সেটা ইমন ছিলো আসলে। আমার এমন অবস্থা দেখে সে হেসেও কুল পাচ্ছিলো না, আবার চিন্তিত না হয়েও পারছিলো না। শেষমেশ হাসি থামিয়ে, দুঃখপ্রকাশ করে সেও সিঁড়ি ঘেঁষে আমার পাশেই এসে বসে পড়লো। তারপর দুহাতে আমার সম্পূর্ণ বাহু টাইট করে জড়িয়ে ধরে বললো, আরে বোকা ছেলে। ছেলে মানুষদের এত ভয় পেতে হয় নাকি? ভূতটুত বলে আদৌ কিছু আছে নাকি? তুমি দেখি একেবারে ভীতু। ভয় পেয়ে একেবারে ঘেমে নেয়ে ওঠেছো। এদিকে আসো দেখি, থুথু দিয়ে দেই বুকে।।
বলেই সে আমার শার্ট টেনে বোতাম খুলে ভেতরে তলপেটের উপর থুথু ছিটিয়ে দিলো। তারপর বুকের বামপাশে হার্ট বরাবর হাত রেখে ধীরে ধীরে পুশ করতে করতে বললো, এবার ধীরে ধীরে শ্বাস নাও। ধুকপুকানি কমে যাবে। তুমি যে এমন দুর্বল হৃদয়ের পুরুষ আগে কি জানতাম আমি? তাহলে কি আর এমনটা করতাম??
আচ্ছা, চলো ওপাশটাতে গিয়ে বসি। অতঃপর সে আমায় টেনে তুলে পাশের রেলিংয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে নিজেও রেলিং এ চড়ে বসলো। আমার বুকটা তখনও ধপধপ করে কাঁপছিলো। তবুও দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। পরিবেশও যেন আমার সঙ্গ দিলো। চারিপাশ হতে মৃদু হাওয়া বইতে শুরু করলো, রেলিংএর পাশেই ঝুলে থাকা বাগান বিলাশের ফুলের গোছা কেমন মিটিমিটি হাসতে লাগলো যেন আমায় দেখে। ইমন আমায় স্বাভাবিক করার জন্য প্রথমত একটা গান ধরলো। আমি মনোযোগ ঢেলে শুনলাম, তার গলার আওয়াজ সুনিপুন এবং মাধুর্যপূর্ণ। শুনে যেন আমার কান আর মস্তিষ্ক প্রশান্তি পেলো। তবে তার গানের গীতিমাল্য শুনে না হেসে পারলাম না, বুঝি আমায় হাসাতেই সে ভুল করে বললো কি না। দেবের সেই পাগলু সিনেমার গানখানা, মন বেবাগী, মন বেবাগী.....
তবে সে গায়তে লাগলো, মন দে মা*গী, মন দে মা*গী!!
আমার ভয় কমে গেলো, তবে মনটা স্বাভাবিক হতে পারলো না। বরং হাসিতে হাসিতে পুনরায় উত্তেজিত হয়ে ওঠলো। হাসি শুনে সে গান থামিয়ে বললো, কি ব্যাপার, হাসছো যে?? আমার গলায় বুঝি খুব বাজে লাগছে গানটা? কি আর করি বলো তো৷ আল্লাহ যেমন কন্ঠ দিয়েছেন, তেমনই তো গায়বো তাই নয় কি??
আমি থাকে থামিয়ে বললাম, আরে। কে বললো আপনার গলা মন্দ? বরং আমার তো ইচ্ছে হলো, রাতভর আপনার গলায় গান শুনতে থাকি। এত কোমল কন্ঠ যে মানুষের কি করে হয়? তবে, আমি হাসছিলাম, কারণ আপনি ভুল লিরিক্স গায়ছিলেন। ওটা মন দে-মাগী হবে না ভাইসাহেব, মন বিবাগী হবে!!
সে মুচকি হেসে মুখ ভেচকি কেটে বললো, তাইনি! আমরা তো এভাবেই গেয়ে আসছি আদ্দিকাল থেকে। যাই হোক, নতুন জিনিস শিখলাম। (একটু থেমে ফের বললেন) যাই হোক, এবার কি ভয় কমেছে??
আমি মাথা নাড়লাম। এরপর সে নিজে থেকেই একেক করে নিজের জীবনচরিত সবিস্তারে বর্ণনা করতে লাগলো। কোন কলেজ কোন ডিপার্টমেন্ট কোন ইয়ার, এরপর বন্ধুদের নাম, শত্রুদের নাম, টিচারদের নাম৷ কার কার সাথে ঝামেলা হয়েছে সেই কাহিনী। কোথায় কোথায় সে ক্রিকেট খেলেছে, কোথায় জিতেছে কোথায় হেরেছে তার গল্প। গল্প যেন আর ফুরোয় না। তবে আমার গল্পগুলো যেন আমার জীবনটার মতোই ক্ষুদ্র আর গুরুত্বহীন, অতএব তার কথার মাঝে মাঝে আমার গল্পগুলো পারদের মতোই কোনো এক ছিদ্র টপকে কোথায় যে বেড়িয়ে গেলো সেদিকে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপই হলো না। যাই হোক, তবুও তার সবিস্তর আর আমার সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় এটা জানতে পারলাম আর জানতে পেরে আমরা দুজনেই এতটা আশ্চর্য হলাম যে কতক্ষণ দুজন দুজনার মুখপানে চাওয়াচাওয়ি করে স্তব্ধ রইলাম, আমরা এতদিন একই কলেজে পড়েছি, পাশাপাশি থেকেছি, অথচ কেউ কাউকে চিনতাম না জানতাম না।
এরইমাঝে আমি হঠাৎ কথার ফাঁদে জড়িয়ে তাকে গত দুই রাতের অনুপস্থিতির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে হাস্যমুখে জবাব দিলো, ডে- নাইটের সিক্সার সাইট টুর্নামেন্ট ছিলো একটা। সারারাত সারাদিন খেলাধুলার পর এতটাই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে ওখানেই এক বন্ধুর বাসায় আরও একদিন বেশি থেকে এলাম। তবে দূর্ভাগ্যবশত এবারের ম্যাচে আমরা গোহারা হেরেছি।
বলেই তিনি কাতর হাসি হাসলেন। তার করুণ চোখের চাওনিতে আমার হৃদয় যেন মোমের মতো গলে গেলো। তবুও আমি কন্ঠের শঠতা বজায় রেখে তাকে আরও কিছু বললাম, আসলে জানি না আমার এসব বলার অধিকার আছে কি না। তবুও আপনাদের আমি এখন নিজের পরিবার নিজের সংসারের লোক বলেই মনে করি তো। তাই বলার সাহস করছি, শুনুন। আমি জানি আপনার আম্মা মারা গেছেন বহু বৎসর আগেই। আপনার কোনো ভাই বোনও নেই আর। তার মানে আপনি আপনাদের পরিবারের অন্যতম একজন সদস্য। আপনার আব্বার বয়স হয়েছে। আপনি যেমন আপনার মায়ের ভালোবাসা থেকে এতদিন বঞ্চিত থেকেছেন, আপনার আব্বাও একইভাবে তার স্ত্রীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। আপনার এখন যেমন একটু কেয়ার একটু ভালোবাসা দরকার, তারও কিন্তু সেটাই দরকার। অথচ আপনি যেন ভূতের গলির ভূতের মতোই এই উদয় হয়ে আবার নিমিষেই গায়েব হয়ে যান। আপনার আব্বা কেমন আছেন, কি করছেন, কি খেয়েছেন, তার কি কোনো খোঁজ খবর রেখেছেন আপনি? জানেন, প্রতি রাতে আপনার চিন্তায় ঘুমুতে পারেন না তিনি! গভীর রাত পর্যন্ত আপনার জন্য দরজার পানে চেয়ে নির্ঘুম রাত কাটান। আমিও তো এই গত রাত আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু আপনি আসেননি। কবে আসবেন সেটাও কারো জানা ছিলো না। এবার আপনিই বলুন তো, এইভাবে কি একটা স্বচ্ছ পরিবার গঠিত হয়? একটা সংসার সুন্দর সুশৃঙ্খল থাকে? সেই পরিবারে কোনো আনন্দ কোনো হাসিখুশি থাকে? আর এখন তো আমিও এই পরিবারের সদস্য। ইলেনিয়ার পরিবার এমন একটা অসুখী অসম্পূর্ণ পরিবার এটা কি মেনে নেওয়া যায়?
আমার কথাগুলো যেন পরিবেশে একটা গুমোট নিম্নচাপের সৃষ্টি করে ফেললো। সবকিছু হঠাৎ করেই এতটা নিশ্চুপ হয়ে গেলো যে আমি কিছুটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। তারপর ধপ করেই তিনি ওঠে দাড়ালেন, আর কোনোকিছু না বলেই হনহন করে কি জানি কোথায় মিলিয়ে গেলেন।
_______________
৩. আজ সকালে ততটা তাড়া ছিলো না। তাই চুলায় ভাত চড়িয়ে কষা করে মুরগির ঝাল, লাউশাক আর মুগডাল রাঁধলাম। এরপর সবার ঘরে ঘরে গিয়ে খাবার দেওয়ার পর কিচেনে ঢুকতেই দেখি ইমন ভাই হাসি হাসি মুখ করে দাড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখতেই তিনি মুখটাকে বিষন্ন করে বলে ওঠলেন, কি ব্যাপার বাকি সবাই কোথায়?? ভাবলাম এখন থেকে রোজ সবার সাথে বসে সকালের ব্রেক ফাস্ট আর রাতের ডিনার করবো। কিন্তু কান্ডটা হলো কি? কেউ দেখছি নেই। তার মানে আজও কি আমায় একা একাই খেতে হবে??
তার মুখের কথা যেন আমার কান বিশ্বাস করতে পারলো না। তবুও তাকে কিচেনের পাশের ডাইনিং রুমে বসিয়ে রেখে আমি চললাম সবাইকে নিচে ডাকতে। কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারলো না, তবুও সবাই একবার পরখ করতে সবার থালা সমেতই নিচে আসলো। আর এতদিন পর সাক্ষাৎ ইমনকে দেখে অবাক কিংবা আবেগাপ্লুত হয়েও পড়লো। জালাল চাচাও যেন আনন্দে কেঁদে ফেললেন প্রায়। তারপর সবাই অর্থাৎ জালাল চাচা, মোনায়েম চাচা, হাসু আপা, তোরাব ভাই সবাই ইমনের সাথে হেসে খেলে গল্প করতে করতে সকালের নাস্তা করতে লাগলো। অবশ্য আমি বাদ পড়লাম, কারণ একজনকে তো খাবার সার্ভ করতেই হবে। খাওয়া শেষে আজ সবাই বহুক্ষণ টেবিলেই বসে রইলো, বহু ধরনের গল্পগুজব করলো।
সবশেষে জালাল চাচা আমায় ডেকে বললেন, কি ব্যাপার বাপ? এই আশ্চর্য কান্ডটা হয়লো কেমন কইরা?
সেদিন ইমন ভাই সারাদিনই বাড়ি রইলো। কি জানি কি কারণে সারাটা সময়ই সে আমার সাথে বিড়ালের মতোই গা ঘেঁষে ঘেঁষে রইলো আর তার জীবনচরিত থেকে বাকি পড়া সমস্ত অনুচ্ছেদগুলো আমায় পুনরায় বিশ্লেষন করে শুনাতে লাগলো৷ আমি একটু চোখের আড়াল হয়েছি কি ওমনি তার ডাকাডাকি শুরু। বহুদিন পর আমার মতো এমন একজন নিরীহ নিরব শ্রোতা পেয়ে সে যেন অমূল্য কোনো রতন পেয়েছে বলেই মনে হলো। এদিকে তার বকরবকর শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা আর মাথা ব্যাথায় চিনচিন করতে লাগলো। রাতে ভাবলাম একটু বিশ্রাম নিবো, কিন্তু তা আর হলো কই? তিনি আমায় ডেকে তার শয়নকক্ষে নিয়ে গেলো। আর যেন আদেশের মতোই বললো বসলো, সারাক্ষণ বন্ধু বান্ধবের সাথে থাকি তো, একা একা থাকতে আর ভালো লাগে না। শুনো তোমার কথায় যেমন আমি বাড়িতে থাকার মতে সম্মত হয়েছি, তবে আজ হতে কিন্তু তোমাকেও আমার একটা কথা রাখতে হবে। আজ হতে তুমিও আমার রুমে আমার সাথেই থাকবে। রাতেও থাকবে আর দিনেও থাকবে। আর তাহলেই কিন্তু বাড়িতে আমার মন বসবে, নতুবা আমার দ্বারা সম্ভব না। এখন তুমি কি বলো? থাকবে? যদি রাজি হও তাহলে চলো, এক্ষুণি তোমার সব জিনিসপত্র এ রুমে চালান করতে থাকি। আর রাজি না হলে চলে যাও, যদি মন বসে তাহলে বাড়িতেই থাকার চেষ্টা করবো।
আমার কোনো যৌক্তিক কারণ দর্শানোর উপায় ছিলো না নিষেধ করার মতো। আর যেহেতু এখন হতে এটা আমারই পরিবার, আমার সংসার, অতএব টিকাতে হলে নিজের একটু কষ্ট স্বীকার করতেই হবে। অতএব আমি সারাদিন সারারাত তার বকরবকর শোনার আবদারে সম্মতি দিয়ে নিজের ঘরের সকল মাল সামানা এনে তার রুমেই তুললাম। সেও আমায় সাহায্য করলো সব রকমের। অতঃপর ক্লান্ত দেহে এলিয়ে পড়লাম তার খাটের উপর তার পিঠ ঘেঁষে। কি জানি কখন ঘুমে দুচোখ জোড়া লেগে গেলো আর হুশই রইলো না কোনো। পরে যখন গভীর রাতে চেতনা ফিরলো দেখলাম আমি তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। শুধু তাই নয়, লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে গেলো যখন দেখলাম আমি আর ইমন ভাই তার পরনের লুঙ্গিখানা গায়ে দিয়ে আছি শীত নিবারণের জন্য।
______________
আগে যেমন ইমন ভাইকে ঘরে আবদ্ধ করা যেতো বা, এখন বিষয়টা তার উল্টো হয়ে গেলো। সে এখন সারাদিনেও বাহিরে যেতে চায় না। সকালের অধিকাংশ সময়টুকু সে আমার পিছনে ব্যয় করে। আমি রান্না করি, আর সে আমার সাথে সবজি কেটে ধুয়ে দেয়, মাঝে মাঝে উনুনের তরকারিটুকুও দেখে। আর এরপর যখন আমি গোসলে যাই, সে তখন বাগানের ফুলগাছে পানি দেয়। আর সবশেষে সবাই মিলে খেয়ে ওঠার পর সে আমায় নিয়ে তার রুমে গিয়ে বসে। তারপর শুরু হয় নতুন কোনো এক জীবনলিপির গল্প, মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলেও প্রায় সময়ই তার গল্পগুজব শুনতে আমার বেশ লাগে। শুয়ে বসে থাকতে থাকতে যখন দুপুর গড়ায় তখন সে আমার হাতের চা নিয়ে মোনায়েম চাচার রুমে ঢুকে গানের সাথে সাথে বাড়তি কিছু আলাপ-সালাপ করতে। এরপর যখন রাত নামে, সন্ধে হয় ওমনি সে আমায় ডেকে তার রুমে আনে। অতঃপর তেল দিয়ে মালিশ কিংবা আগুনের ছ্যাক নেয়। এভাবেই দিন গড়াচ্ছিলো।
তবে তার অনুপস্থিতি তার বন্ধু বান্ধবের মাঝে বেশ ভালোই প্রভাব ফেললো। একদিন সদলবলে তারা বাসায় এসে হাজির। এতগুলো দানবের মতো যুবক দেখে আমি খানিকটা ভয়ও পেয়েছিলাম বটে, তবে শেষে তাদের জন্য গরম লুচি আর সিংগারা, আর চা সেই আমাকেই করতে হলো।
সেসব নিয়ে আমি যখন ইমন ভাইয়ের শোবার ঘরে ঢুকছিলাম, ওমনি শুনলাম তার বন্ধুরা বলাবলি করছে, হুট করে যেভাবে গায়েব হয়ে গেলি ভেবেছিলাম কি না কি হলো। সাব্বির তো বললো, বিয়ে সাদি করে সংসারী হয়ে গেছিস বোধ হয় তাই ক্লাবে যাচ্ছিস না। ও মা, এখন দেখি সাব্বিরের কথাই সত্যি। তুই তো সত্যিই সংসারী হয়ে গেছিস। তফাৎ হলো এই বউয়ের বদলে একটা বর পেয়েছিস এই যা।। তবে, ওকে বউ বললেও ভুল হবে না। আংকেলের মুখে শুনলাম তোর যা যত্ন আত্তি করছে আর তুই যেভাবে ওর পিছু পড়ে আছিস সেটা বউয়ের চায়তে কম না।। তো, নতুন জীবনে স্বাগতম বন্ধু।
বলেই সবাই ইমনকে নিয়ে সেকি হাসাহাসি। যদিও ইমন হয়তো একটু লজ্জা পেলো, তবে তার মুখেও একটা হাসি ফুটে ওঠলো। এরপরেই আমি যখন খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলাম, একজন বলে ওঠলো, এই তো চা সিংগারা নিয়ে নতুন ভাবি চলে এসেছে।
কথাটা শুনে আমি একটু আশ্চর্য হলাম এবং আহত হলামও বটে। দেখলাম ইমন বিস্ময় নিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। যাক সে কথা। রাতে যখন তার সাথে ঘুমুতে গেলাম সে ফের ঐ প্রসঙ্গ তুলে বললো, ওদের কথায় কিছু মনে করো না ইলু। আরে ওরা হচ্ছে জাওরামির শিরোমনি। ভাগ্যিস তুমি নতুন বলে তোমায় বেশি কিছু বলেনি।
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, আচ্ছা সত্যিই কি আমি যা যা করছি এসব আপনার বউয়ের মতো কাজ হয়ে যায়?
ইমন ভাই, আমার গালে আদর বুলিয়ে বললো, আরে পাগল। বললাম তো ওসব মনে নিও না। তুমি যা যা করছো, সেসব হয়তো আমার বউ এলেও করতো না বা করবে না। তুমি আমার বউয়ের চায়তেও বেশি কিছু, বুঝলে?
কথাটা বলেই সে আমায় জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। তবে আজকে তার ছোঁয়াতে কি যেন নতুন এক আবেশে শরীর শিউরে ওঠলো।
__________________
৪. সামনেই ইমন ভাইয়ের ফাইনাল খেলার ম্যাচ। এদিকে আমার ফাইনাল এক্সামও সন্নিকটে। তবুও পড়াশোনা শেষ করে যতটুকু সময় হাতে পাই ইমন ভাইয়ের শরীর মালিশে কাজে লাগাই। কারণ, এ সময় তার খুব পরিশ্রম যাচ্ছে। আগের মতো সারাদিন রাত খেলা নিয়ে পড়ে না থাকলেও দিনের অনেকটা সময়ই সে খেলা চর্চার পিছনে ব্যয় করতে লাগলো। আর এতে আঘাত আর ক্ষত যে হবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিছুদিন পর তার সেই চূড়ান্ত পর্যায়ের দিন এসে উপস্থিত হলো। ইমন ভাই পুরোপুরি প্রস্তুত, তবে তার খেলা দেখবার মতো অবস্থা আমার ছিলো না। কয়েকদিন ঠিকঠাক মতো ঘুমুতে না পাড়ায়, আর পড়ার চাপে আমি বেশ ভালোই অসুস্থ হলাম। মাথা তুলে যেন ওঠতেই পারি না। ইমন ভাই এই নিয়ে খুব চিন্তা করতে লাগলেন, তবুও তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমি খেলতে পাঠিয়ে দিলাম। সারারাত খেলাধুলা চললো। আমি শুধু অপেক্ষায় রইলাম কখন সকাল হবে, আর কখন দেখবো ইমন ভাই হাসি মুখে এসে বলবেন, হুররে আমরা জিতে গেছি৷ আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছি। আমার আর তর সইছিলো না।
সকাল নয়টা নাগাদ আমার ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে দেখি পাশেই ইমন ভাই বসা, তবে তার চোখে স্পষ্ট নিরানন্দ। আমি বুঝলাম কিছু একটা খারাপ হয়েছে। আমি তাই খুব কথা না বাড়িয়ে সরাসরি বললাম, ইমন ভাই, হার জিত নিয়েই তো পৃথিবী। একদল না হারলে তো আরেকদল জিততে পারে না। তাই যা হবার হয়েছে, মেনে নেওয়াই ভালো।
ভেবেছিলাম কথাগুলো কাজে দিবে। কিন্তু সে দেখি ওঠে দাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমায় বলে বসলো, তুমি প্লিজ আজ থেকে গেস্টরুমে থাকতে পারবে??
_____________
পরবর্তীতে জানতে পারলাম আমায় নিয়ে বিরাট ঝামেলা হয়ে গেছে। তারা তো এবারের ম্যাচ হেরেছেই। এরই সাথে তার বন্ধুরা তার এই হারের জন্য আমায় দায়ী করেছে। আমিই নাকি ইমনের মনোযোগ নষ্ট করে ফেলেছি। তার এত বৎসরের চর্চা শেষ করে দিয়েছি, আর তাই বাঁচতে হলে আমার থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। আমায় নিয়ে কে কে বললো সেটা ভাববার বিষয় ছিলো না, তবে ইমন ভাইয়ের হঠাৎ পরিবর্তন আমায় ভীষণ আহত করলো। সে আমায় সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে লাগলো। আবারও গভীর রাতে বাসায় ফিরতে শুরু করলো, আর সেই ভোরে চলে যেতে লাগলো। তার সাথে সারাদিনেও আর দেখা সাক্ষাৎ নেই। এদিকে আমার ফাইনাল এক্সামও শেষ। অতএব একরাতে জালাল চাচাকে নীরবে ডেকে তাকে সব বুঝিয়ে শুনিয়ে তার হাতে এ সংসারের দায়িত্ব সপে দিয়ে আমি বিদেয় হলাম। এবার আর শহরের জীবন নয়, ডাইরেক্ট আমার সবুজ শ্যামল গ্রাম মায়ের কোল। যতটুকু পড়েছি যথেষ্ট, যদি চাকরি পাই ভালো, না পেলে আছে তো মধ্যপ্রাচ্যের ধূসর মরুভূমি। সেথায় না হয় গিয়ে খেজুর চাষ করবো।
চলে গেলো প্রায় দেড় মাসের মতো সময়কাল। এরইমধ্যে দেখি একদিন জালাল চাচা আর মোনায়েম চাচা খুঁজে খুঁজে আমার গ্রাম বের করেছেন। তারপর আমায় পেয়ে আনন্দে যেন আত্মহারা দুজন। আমি যথাসাধ্য তাদের আপ্যায়ন করলাম। তবে, তাতেও তাদের মন ভরলো না। তারা বলেই বসলো, এতদিন সে সংসার আমার দায়িত্বে ছিলো আমি গুছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু যবে থেকে তার হাল তুমি ধরেছো ও সংসার সেদিন হতে তোমার হয়ে গেছে, আমি বাবা এখন আর কিছুই জানি না। তুমি সব কিছু আগের মতে করে দাও। ইমনকে তুমি আবারও ফিরিয়ে আনো বাবা। নয়লে আমি ওর চিন্তাতেই মারা যাবো।
আমি কিছু বলবো, তার আগেই আমার বাবা বললো, ও তো ছেলে মানুষ। ভাবছি ভিসা পার্সপোর্ট করে বিদেশ পাঠাবো। বয়স তো আর কম হলো না, বিয়ে করাতে হবে। তা আপনার ছেলেকে বিয়ে করাচ্ছেন না কেন?
ইমনের বাবা কি জানি কি ভেবে বললো, আমাদের সমাজ এমন এক নিয়মের জালে বাঁধা পড়ে আছে যে জাল হয়তো আমার পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়। নতুবা আমার ছেলেটাকে কবেই আমি আমার ঘরের লক্ষীটির সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম। কিন্তু কি আর করবো, সমাজ যে তা মেনে নেবে না।। ইলু বাবা, তোমার কাছে শেষ বার অনুরোধ করছি। পারলে একবার এসো।
বলেই তারা চলে গেলো। আমার তাদের সাথে যাবার তীব্র ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারলাম না। বাবা অগ্নিশর্মা হয়ে চেয়ে রইলেন আমার দিকে।
_____________
৫. প্রায় তিন মাস পর, বাড়ি থেকে কয়েক কিলো দূরের দোকানে গিয়েছিলাম কিছু সদাই করার জন্য। কিন্তু সেথায় গিয়ে আমি থ মেরে গেলাম। দেখি ইমন ভাই রুক্ষ মুখে বসে বসে সিগারেট টানছেন। আর আমায় দেখামাত্রই সেটা ফেলে দিয়ে সে যেন ঝড়ের বেগে ছুটে এসে আমায় তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো। আর এত শক্ত করেই ধরে রাখলো যেন ছুটাতে গেলে পনেরো- দশেক মানুষ লাগবে।
আমি কিছু বলবো, তার আগেই সে বলে ওঠলো, ইলু। তোমায় ছাড়া আমি এবার আর একা একা বাড়ি ফিরবো না। প্লিজ চলো আমার সাথে। আমি যে প্রতি রাতে ছটফট করতে করতে মরে যাচ্ছি। কেউ নেই আমার শরীরে একটু মালিশ ডলে দেবার। কেউ নেই, আমার লুঙ্গির তলে ঘুমিয়ে থাকার। কারো হাতের রান্নাই আমার মুখে রোচে না। প্লিজ চলো না, তোমায় ছাড়া যে আমি মরে যাচ্ছি ইলু।
আমি তাকে ছাড়াতে চেষ্টা করতে করতে বললাম, শুধুমাত্র মালিশ ডলার জন্য আর মলম লাগানোর জন্য বুঝি আমায় নিতে এসেছেন? কেন আপনার এত বন্ধু বান্ধব তারা কি করে? আর একটা বিয়ে করে নিচ্ছেন না কেন? বউয়ের কোমল হাতের রান্না খেতে পারবেন আর মালিশও পাবেন।
সে বললো, এত কথা বলো না তো প্লিজ। আমি কিচ্ছু জানি না। তুমি আমার সাথে যাচ্ছো এই কথা ফাইনাল।
হঠাৎ দেখি পাশেই আমার বাবা দাঁড়িয়ে। আমাদের ওই অবস্থায় দেখে তার মুখের অবস্থা দেখার মতো। তবুও সে বিশেষ কিছু না বলে বললো, সদাই কিনতে এতক্ষণ লাগে বুঝি? আর এ বুঝি তোমার সেই ইমন ভাই? তাকে নিয়ে বাড়িতে আসো, আমি ভাত চড়াচ্ছি।
________________
রান্না শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে গেলো। বাবা ডিম ভুনা করলেন, ছোট মুরগীর বাচ্চাটাকে কসালেন, পুইঁশাক রাঁধলেন, মাছ ভাজলেন আর ভাতের পরপর কিছু পোলাও চড়ালেন। রাতে ইমন ভাই খুব তৃপ্তি করে খেয়ে দেয়ে শেষে বললেন, চাচা, আমি কিন্তু আপনাদের নিয়ে যেতে এসেছি। কাল সকালেই ইলু আর আপনি আমার সাথে চলবেন আমাদের বাড়িতে। আপনাদের আর এ গ্রামে ফিরতে হবে না। আমি আপনাদের দেখে শুনে রাখবো সারাজীবন। কথা দিচ্ছি কখনই ইলুর কোনো কমতি আমার রাখবো না।
বাবা বিশেষ কিছু বললেন না, বললেন, ইলু। মশারী টাঙিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি পাশের রুমে।
__________
সেই রাতে ইমন ভাইয়ের সাথে অনেক বাক্য বিনিময় হলো। তবে কি জানি কি ভেবে এক পর্যায়ে তিনি আমায় ফের জড়িয়ে ধরে গালে আর ঠোঁটে চুমু দিতে লাগলেন। দিনে তখন বাঁধা দিলেও এই রাতে তাকে বাঁধা দিতে ইচ্ছে হলো না, বরং নিজেকে তার কাছে সপে দিতে ইচ্ছে হলো। তবে সে বিশেষ কোনো জোরাজোরি না করে খুব কোমল ভাবেই আমার সারা শরীরে ভালোবাসা স্নেহ আদর সবকিছুর মিশেল পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলো। তার আর আমার মাঝে কোনো গোপনীয়তা বলতে কিছু আর রইলো না। এক পর্যায়ে