Dreamful Life

সেদিন রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি রিকশা ধরবো বলে, দেখি সামনে একটা ছেলে এসে রিকশা নিয়ে দাঁড়ালো।"মিঠি, ওঠো ওঠো!" — আমি এক...
29/10/2025

সেদিন রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি রিকশা ধরবো বলে, দেখি সামনে একটা ছেলে এসে রিকশা নিয়ে দাঁড়ালো।

"মিঠি, ওঠো ওঠো!" — আমি একটু অবাক হয়ে দেখলাম। বয়স প্রায় সাতাশ-আঠাশ, রুগ্ন শরীর, কিন্তু চোখ দুটো বড় মায়াময়।

খুব ভাবার চেষ্টা করলাম পরিচিত কিনা! কিন্তু চিনতে পারছি না। পরিচিত কিছু রিকশাচালকদের মধ্যেও কোথাও এর ছবি নেই।

"উঠে পড়ুন দিদি! এমনিতেই আমি এই স্ট্যান্ডের না! এরা দেখলে আবার চিৎকার করবে!" — ছেলেটি তাড়াহুড়ো করে বললো।

"তা তোমাকে কে বলেছে ভাই এতো উপকার করতে! আমি তো এখানকার রিকশাতেই চলে যেতে পারি!" — এই কথাগুলো বলতে যাবো, তার আগেই মিঠির কম্ম সারা। উঠে বসেছে রিকশায়।

আমি রিকশায় উঠে মিঠিকে গলাটা নামিয়ে বললাম, "চিনিস তুই?" মিঠি ভুরু কুঁচকে বললো, "একদম না!"

এবার একটু ভয়ই লাগছে। চারিদিকে যা সব ঘটনা ঘটছে! "মিঠি, নাচে যাও এখনও?" — শুনলাম, ছেলেটা রিকশা চালাতে চালাতেই বললো।

মিঠি সুর করে বললো, "হ্যাঁ, শনিবার যাই তো! কালই যাবো!"

এই হলো মিঠির সমস্যা — অতিরিক্ত বকে! আর এই জন্যই আমার ভয়। আজকাল বাচ্চারা সত্যি নিরাপদ নয়। তার ওপর এই ছেলেটার মতো মানুষগুলোই দিনের শেষে পেটে জল পড়লে ভয়ানক হয়ে যায়।

এসব ভেবেই আরও ভয় পেয়ে গেলাম। মিঠিকে আলাদা করে চিনবে কীভাবে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।

কিন্তু চেনে তো বোঝা যাচ্ছে। নামটাও ঠিক বলছে। "দিদি, মিঠি এখনো দুষ্টুমি করে?" — শুনলাম, রিকশা চালাতে চালাতেই জিজ্ঞেস করছে সামনের ছেলেটা।

আরও অবাক হওয়ার পালা এবার আমার। মিঠি তাহলে দুষ্টুমিতে এতো পরিচিত যে কলমে অনিন্দিতা হয়েও আমি কিছু করতে পারলাম না।

আমি কিছু বলার আগেই মিঠি বললো, "আমি এখনো দুষ্টু আছি! এই তো দিদুন বাড়িতে একটা গ্লাস ভেঙে আসলাম!"

বলেই হেসে যাচ্ছে মিঠি, সাথে ছেলেটিও। আমি এবার না চাইলেও জিজ্ঞেস করে ফেললাম, "তুমি মিঠিকে কিভাবে চেনো?"

ছেলেটা একটু থেমে বললো, "রূপা ড্রেসেস অ্যান্ড মেকআপ।" নামটা বেশ চেনা — শুধু আমি নই, এই অঞ্চলে সবাই চেনে।

ওরা নাচের প্রোগ্রামে ড্রেস ভাড়া দেয়, আর সাথে মেকআপ করায়। মনে পড়লো, মিঠিদের নাচের প্রোগ্রামে এই রূপা ড্রেসের মালিক রূপা মজুমদারকে সুন্দর মেকআপ করানোর জন্য পুরস্কার দিয়েছিল কোনো একটা মিডিয়া থেকে।

মনে পড়ায় এবার নিশ্চিন্ত হলাম আমি। কিন্তু ও কি করে মিঠিকে চেনে! ভেবেই জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কি ওখানে কাজ করো?"

ছেলেটা হমম বললো। আমি ধরেই নিলাম, ও তাহলে ভ্যান চালিয়ে ড্রেস নিশ্চয় হলে পৌঁছে দেয়! এটাই হয়তো করে — একজন রিকশাচালকের বেশি আর কী করবে!

ছেলেটা বললো, "সামনে তো আবার প্রোগ্রাম!" তারপর পিছন ঘুরে মিঠির দিকে তাকিয়ে বললো, "এবার দুষ্টুমি করলে কিন্তু অন্ধকার ঘরে আটকে রাখবো! আগেরবার যা করেছিল!"

গ্রীনরুমের ভেতরকার খবর আমি সত্যি জানি না। তাই একটু উৎসাহ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, "কি করেছিল গো?"

বললো, "দিদি, চোখ আঁকতে বসে এতো নড়েছে — নিজেরটা তো বিগড়েছেই, সাথে এমন হাত নাড়িয়েছে যে পাশের বাচ্চার মুখে আমার হাতে থাকা কালো রঙ পড়ে গেছে!"

এই ঘটনাটা সত্যি আমার অজানা। কিন্তু শুনে একটু লজ্জাই লাগছে। মিঠিকে বললাম, "তুই এটা করেছিলি?" মিঠি মাথা নাড়িয়ে হমম বলে বললো, "সে তো অনেকদিন আগে!"

সত্যি, যেকোনো ঘটনার তক্ষুনি যে রেশটা থাকে, সেটা পরে আর থাকে না। তাই আমারও খুব রাগ হচ্ছে না, আর বুঝলাম মিঠিও ভয় পাচ্ছে না যে ওই ঘটনার জন্য ও বকা খেতে পারে!

ছেলেটি আবার বললো, "দিদি, সেদিন মিঠিকে খুব বকেছি। আর ওই মেয়েটা মিঠিরই বয়সি, খুব শান্ত। কি সুন্দর চুপচাপ থেকে আমাকে সাহায্য করেছিল! ধীরে ধীরে ওর মুখ থেকে কালো রঙ উঠিয়ে আমি আবার মেকআপ করে দিয়েছিলাম!"

সেসব শুনে আমার খারাপ লাগার কথা, কিন্তু তা না হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি মেকআপ আর্টিস্ট?"

ছেলেটা জোরে হেসে বললো, "আর্টিস্টি কিনা জানি না! আমি ওই রূপা ম্যাডামের গ্রুপে মেকআপ করি, চোখ আঁকি! চোখ আঁকাটাই আমার পেশা। ঠাকুরের বলুন, নাচের প্রোগ্রাম, বিয়েবাড়িতে বৌয়ের — সব জায়গায়!"

মনে পড়লো, মিঠিদের নাচের স্কুলে বড়দের একটা নাচে চোখগুলো একটু অন্যরকমভাবে আঁকা হয়েছিল।

অসাধারণ মেকআপ হয়েছিল — সবাই আলোচনা করেছিলাম আমরা। তাহলে সেই মেকআপটাও কি এই ছেলেটাই করেছিল? ভেবেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কি ওই নৃত্যনাট্যের মেকআপ, মানে চোখ এঁকেছিলে?"

রিকশা ততক্ষণে থেমে গেছে আমার বাড়ির সামনে। ছেলেটা রিকশা থেকে নেমে বললো, "হমম, হরিণের চোখের মেকআপ তো? কি একটা নৃত্যনাট্য হয়েছিল যেন, সব হরিণ সেজেছিল!"

আমি হমম বলে বললাম, "ওই মেকআপের জন্য তোমাদের গ্রুপ তো পুরস্কার পেল! রূপা ম্যাডাম এসে প্রাইজ নিলেন!"

ছেলেটা মনে হয় আমার কথাটা ধরতে পেরেছে। তাই বললো, "হমম, রূপা ম্যাডাম প্রাইজ নিয়েছেন, নাম কিনেছেন! ফিরে এসে আমাকে বারোশো টাকা ধরিয়েছেন!"

"আমিও ওটা নিয়েই খুশি। প্রতিটা শো-পিছু বারোশো করেই পাই। বৌয়ের মেকাপে অবশ্য দাম বেশি — ওটায় রূপা ম্যাডাম পনেরোশো দেন! খালি মেকআপ আর চোখ আঁকি!"

আমি বললাম, "এতো গুণ তোমার! তুমি তো আরও গ্রুপে কাজ করতে পারো!"

ছেলেটি বললো, "দিদি, সে শর্তেই ঢুকেছি যে একসাথে একাধিক মেকআপ কোম্পানিতে জয়েন করা যাবে না। আর এখানে ভালোই কাজ হয় — মাসে পনেরো দিন তো থাকেই সব মিলিয়ে। তাই তো অবসরে বাবার রিকশা নিয়ে বেরোই! বাবা মারা যাওয়ার পর পড়েই আছে, নিয়ে বেরোলে দুটো টাকা হয়!"

ও কথা বলেই যাচ্ছে, তার মধ্যেই আমি পয়সার ব্যাগ খুলে টাকা বের করে ভাড়া দিতে যাচ্ছি। ভাড়া পনেরো হয়, কিন্তু আমার একটু বেশি দিতে মন চাইছে।

কিন্তু মনকে আস্কারা দিলাম না। উল্টে বোঝালাম — এই মানুষটাকে আরও দশ-বারো টাকা বেশি দিলে তাকে অপমান করা হবে, অপমান করা হবে শিল্পীর শিল্পসত্ত্বাকে।

ছেলেটার এই অসাধারণ গুণকে এই টুকু টাকা দিয়ে অপমান করা মানে আমার নিজেকেই ছোট করা।

কিছু বলার আগেই মিঠির গালটা টিপে দিয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটি। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, সঙ্গে রইলো ভাবনা — জানি, যেটা দুদিন পরে ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যাবে।

তাই হয়েছিল। কাজে কর্মে সেসব ভুলে গেছি। হঠাৎ মনে পড়লো সেদিনের বিয়েবাড়ির কথা।

সবাই বলছে, মাংসটা নাকি দারুণ হয়েছে! আমার সামনেই একজন ক্যাটারিংয়ের নম্বর নিলেন।

ক্যাটারিংয়ের ভদ্রলোকও ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিয়েবাড়িতে আর প্রশংসা কুড়োচ্ছেন। অথচ পর্দার পিছনে যে মানুষগুলো বড় বড় উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে এই গরমে ঘেমে এতো ভালো মাংস রান্না করলো, তার খবর কেউ রাখলো না।

রূপা ড্রেসেস বলুন আর উত্তম ক্যাটারার — প্রতিটা প্রতিষ্ঠান আজ নামে-দামে ফুলে ফেঁপে উঠেছে শুধু এই মানুষগুলোর জন্য, যারা সাথে না থাকলে সেদিন রূপা ম্যাডামের পুরস্কার পাওয়াও হতো না অথবা উত্তমবাবুর আরও দুটো অর্ডার আসতো না।

পর্দার পিছনের মানুষগুলোকে সম্ভব হলে সামনে আনুন। পাওয়া প্রাইজটা হাতে তুলে দিন। স্বীকার করুন যে এই ছেলেটি অসাধারণ চোখ আঁকে — তাই না আজ রূপা ম্যাডামের এতো নাম!

অথবা উত্তমবাবু একবার বলুক না কেন — আমার ক্যাটারিংয়ে অমুক রাঁধুনি আছে বলে রান্নায় এতো স্বাদ! তাতে সত্যি কোনো কৃতিত্ব নেই আমার!

যদিও ওনাদের স্বীকারের ধার ধারে না পর্দার পিছনের মানুষগুলো, কারণ গুণগুলো ওদের রক্তে আর ঘামে মিশে গিয়ে কিছু টাকায় বিক্রি হয়ে গেছে। তবু একটু প্রশংসা পেলে ওনাদের মনটা খুশি হবে, আর তাতে আরও বাড়বে রান্নার স্বাদ।

এই প্রশংসা টুকু ওদের প্রাপ্য — বঞ্চিত করবেন না, প্লিজ 🙏
শেয়ার করুন যারা জানে না, তাঁদের শেখান — সবার গুণের সঠিক মূল্যায়ন হোক।

( মিঠি এখন অনেক বড়ো, নাচটা ওর পছন্দের নয় তাই ছেড়েও দিয়েছে! আর দেখা হয়না রূপা ম্যাডামের সেই আর্টিস্ট দের সাথে কিন্তু ফেসবুকে র পাতায় গল্পটা আবার মনে করালো শিল্পীর সম্মান টুকু তার প্রাপ্য!!)

#আর্টিস্ট
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা

Feminine Wisdom

কোনমতে ধড়পড়িয়ে অটোতে উঠে একদম ভিতরের সিটটাতে বসলো সপ্তম শ্রেণীর অন্তু। উফ! আর মাত্র দশ মিনিট লেট হলেই আজকে আবার বকা খেতে...
29/10/2025

কোনমতে ধড়পড়িয়ে অটোতে উঠে একদম ভিতরের সিটটাতে বসলো সপ্তম শ্রেণীর অন্তু। উফ! আর মাত্র দশ মিনিট লেট হলেই আজকে আবার বকা খেতে হতো স্যারের কাছে। নতুন নতুন ভর্তি হয়েছে, রোজ লেট-টা কি মানা যায় নাকি? যাক, এবারে অন্তত একটু বিটিএসের গান শোনা যাবে। তড়িঘড়ি প্যান্টের পকেট থেকে দুটো ইয়ার বাড ঢুকলো অন্তুর কানে।

টিউশন-এ পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় ছ-টা বেজে গেলো। উঠোনের কাছে আসতে আসতেই অন্তর কানে আসতে থাকলো দীপ্তিমান, পিঙ্কি, অঙ্কিতাদের গলা। উঠোনতা পেরিয়ে গিয়ে আসতে করে গেট-টা খুলে ভিতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় পাছায় একটা সজোরে থাপ্পড় খেল সে! চটাস করে একটা শব্দ! ভীষণ অপ্রস্তুতে পড়ে থপ করে পিঙ্কির পাশে বসে পড়লো অন্তু। একটু গোলগাল হওয়ার জন্য বসার আওয়াজ-টা বেশ জোরে হলো। সবাই হা-হা করে হেসে উঠলো, কিন্তু হঠাৎ স্যার এসে পড়ায় সবাই চুপ করে গেল।

অঙ্কটা অভিজিৎ স্যার দুর্দান্ত পড়ান। মনোযোগ দিয়ে সবাই শুনছে, কেউ বা মুখ টিপে হাসছে অল্প অল্প। হঠাৎ বাড়ির ভিতরে ফোন বাজাতে স্যার বললেন, "তোরা একটু নোটস গুলো দেখ, আমি এক্ষুনি আসছি।"

স্যার আসতে একটু দেরি করছে দেখে বাচ্চা দের মধ্যে আবার গল্প শুরু হলো। চুপ চাপ খাতায় মুখ গুঁজে বসে থাকা অন্তর কানে আসতে থাকে, "তুই এই গেম টা খেলেছিস ভাই?", "বিরাট কোহলি আমার গুরু", "কে ফেভারিট জাস্টিন বিবার না টেলর সুইফ্ট?" ইত্যাদি...।

বাঁ-দিকে একটু তাকিয়ে অন্তু লক্ষ‍্য করে পিঙ্কি অঙ্কিতা কে কানে কানে কি যেন বলছে আর আড়চোখে অন্তর জামার দিকে তাকাচ্ছে। মিনিট খানেক পরে পিঙ্কি অন্তর কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, "ভাই, তোর মেল বুবস আছে।" বলেই হাত টাকে তেরছা করে মারে অন্তর নরম বুকে। ক্লাস শুদ্ধ সবাই হেসে হেসে পাগল হয়ে যায়। কেউবা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

চেঁচামেচি শুনে হুংকার দেন স্যার! কি হলো রেএএএ..?! যাচ্ছি দাঁড়া! মিনিট পাঁচেক গেছি তার মধ্যেই?! পড় চুপচাপ! সবাই চুপ করে যায়। লজ্জায় কান গুলো লাল হয়ে ওঠে অন্তর! বেশ বুঝতে পারে সবাই তাকে নিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। স্যারের দাবড়ানিতে সবাই আবার থেমে যায়। কিন্তু অন্তু বোঝে যে সবার মনোযোগ তারই দিকে। ভীষণ নার্ভাসনেস-এ হালকা কাঁপতে থাকে পেনটা, কিন্তু স্যারের থেকে দূরত্বের কারণে সেটা সহজেই চোখ এড়ায় স্যারের।

ঠিক আটটায় পড়া শেষ, সবার বাবা-মা আসবে। অন্তু জানে ওর মায়ের আসতে একটু সময় লাগবে। দিনের বেলায় কোনো ভাবে আসা-টা অ্যালাও করলেও রাত্রে কোনো ভাবেই একা ছাড়ে না মা। সব ফাঁকা হয়ে গেলে অন্তু মাথা নিচু করে ব্যাগ-টাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। তার মনে পড়ে যায় ২ মাস আগে স্কুলে ঘটে যাওয়া একটা দুর্ঘটনা; একটা দিদিকে ব্যাড টাচ করার জন্য একটা দাদাকে সাসপেন্ড করেছে হেড স্যার। সমস্ত দাদা দিদিরা ভীষণ ভাবে প্রতিবাদ করেছিল; সবটা না বুঝতে পারলেও সে তার বাবা মায়ের হাত ধরে ঐ দাদার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল সেদিন।

আজকের ঘটনাটা ভীষণ ভাবে নাড়া দেয় ছেলেটার নরম সত্ত্বাকে। তবে কি সে শুধুমাত্র ছেলে বলেই তার যেখানে সেখানে....? না কি সে একটু গোলগাল বলে...? তার কচি মনে অনেক বিক্ষিপ্ত প্রশ্ন দানা বাঁধে। স্কুলের ঘটনাটার থেকে এই ঘটনাটা যে একটু হলেও আলাদা সেটা আজ বেশ বুঝতে পারে অন্তু। কিন্তু পার্থক্যটা যে ঠিক কতখানি সেটা বুঝে ওঠার আগেই চরম লজ্জায় এবং অপমানে তার চোখগুলো ভিজে ওঠে...।

॥ সমাপ্ত ॥
অন্তু / ছোটগল্প / কৌশিক চ্যাটার্জি

©️Kausshik Chatarji

'শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেব!' তথা, 'বিয়ে দিয়ে দেব!' - এই মারাত্মক শব্দবন্ধগুলোর সঙ্গে প্রথম পরিচয় বোধ হওয়ার প্রায় সঙ্গ...
27/10/2025

'শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেব!' তথা, 'বিয়ে দিয়ে দেব!' - এই মারাত্মক শব্দবন্ধগুলোর সঙ্গে প্রথম পরিচয় বোধ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।
আড়াই তিন বছর বয়সেই বেজায় গিন্নিবান্নি হয়ে উঠেছিলুম; মানে, রান্নাঘরে ঠাকুমাকে শিখিয়ে দিতুম কেমন করে মাছ কাটতে হয় বা নারকেল কুড়াতে হয়... ছোটপিসি - ঝন্না ডাল চাপালে তার মধ্যে কেমন করে নুন দিতে হয়... ভক্তিপিসিকে শেখাতুম কেমন করে উনোন লেপতে হয়.. এসব আর কি ! কেবল মায়ের ধারে কাছে ঘেঁষতাম না, পেয়ারার ডালের ভয়ে।
অতিষ্ট হয়ে ঠাকুমা মাঝে মাঝেই হুমকি দিত, 'তরে বিয়া দিয়া দিমু !'

তখনও বাড়িতে কোনো বিয়ে দেখিনি বা শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কেও আইডিয়া ছিল না। পাড়ায় দেখতাম, সুন্দর করে সেজেগুজে কাঁদতে কাঁদতে অনেক পিসিরা - সিল্কের পাঞ্জাবি পরা নতুন বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। এত সাজপোশাক পেয়েও তারা যখন কাঁদছে তখন বুঝতে হবে - সে জায়গা আর যাই হোক, অন্তত নন্দনকানন নয়। তারওপর, ঠাকুমা ভয় দেখায়- শ্বশুরবাড়ি বড় কঠিন ঠাঁই! পান থেকে চুন খসলেই শাশুড়ি নাকি মায়ের পেয়ারার ডালের থেকেও এক বাঘা ডান্ডা দিয়ে উত্তম মধ্যম দেবে, আর বাড়িও আসতে দেবেনা।

প্রথম ভুল ভাঙ্গলো মায়ের সঙ্গে এক রাতে কথোপকথনে।
সেদিন শুতে এসে মা বাবাকে বলে, 'মেয়েদেরই সব সময় শ্বশুর ঘরে যেতে হবে কেন? ছেলেদের ঘরজামাই থাকার প্রথা ইমিডিয়েট শুরু করা উচিত!'
-'নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! আমার তো খুবই ভালো হয়', বাবা একগাল হেসে বলে, 'মা, মণিকাকু যত্ন কইরা খাওয়াইবে, আপিস কামাই করলে খুশি হইবে!'
মা আর মণিকাকু হল - আমার বাবার শাশুড়ি আর খুড়শ্বশুর, বাবার নিজের শ্বশুর মারা গেছেন, যখন আমার মায়ের ন বছর বয়স।
'দুই দিনের জন্য গেলে সবাই অমন করে, পাকাপাকি থাকলে মজা বুঝবে!' মুখ মচকে কথা কটা বলে মা এসে আমার পাশে শোয়।
চুপি চুপি জানতে চাই, 'মা, সবার শ্বশুরবাড়ি হয়?'
'হুঁ!'
'তোমারটা কোথায় গো?'
'এই বাড়িটা! এত রাত অব্দি জেগে থাকা কি? ঘুমো শিগগির!' মা তাড়া লাগায়।
পাশ ফিরে ছোট্ট কোলবালিশটা আঁকড়ে ধরে জীবনের প্রথম জবরদস্ত কনফিউশন নিয়ে হিমশিম খেয়েছিলুম সে রাতে।
শ্বশুরবাড়ি সংক্রান্ত ঠাকুমার ইনফরমেশন, আর শ্বশুরবাড়িতে মায়ের পজিশন - দুটোই সম্পূর্ন উল্টো সাক্ষ্য দিচ্ছে।
পান থেকে চুন খসলে মা শায়েস্তা হবে কি? উল্টে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকই মায়ের ভয়ে পান আর চুন যথাস্থানে রাখে...
শাশুড়ির হাতে ডান্ডা পেটা? তবেই হয়েছে! মায়ের হাত থেকে আমায় বাঁচানোর সময় ঠাকুমাই উল্টে বেশ ক ঘা খেয়ে যায়...
মানে, ইনফরমেশনে বিস্তর ভেজাল।
চোখ আরো খুললো পর পর দুটো বিয়ে দেখে - একটি আমার প্রাইভেট টিউটর বিভামিসের, আর অন্যটি মেজোপিসি - বুন্ডির। তাঁরা যথারীতি কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরবাড়ি গেলো, কিন্তু পরে যখন এলো তখন মুখে হাসি আর ধরে না! কি সুন্দর যে দেখতে লাগছে, কি বলবো!
সঙ্গে হুকুম তামিল করার একটি বর, একটি বার আবদার করলেই যে আকাশের চাঁদটি পর্যন্ত এনে হাজির করতে পারে।

মনে ইচ্ছে জাগে, একটা বিয়ে করে নিলেই হয় ! মেলা শাড়ি-গয়না, মেকআপ বক্স... বরের তোয়াজ... সিনেমা, থিয়েটার... আর সবার ওপর - লেখাপড়ার বালাই নেই...
ঠাকুমাকে কবার রিকোয়েস্ট করলাম - 'দিয়ে দাও বিয়ে!'
কিন্তু মোটে গা করলো না। অগত্যা নিজেরই উদ্যোগ নিতে হয়...
প্রথমেই দরকার একটা সুপাত্রের, যার ঘাড়ে চেপে শ্বশুরবাড়ি নামক মধুপুরীতে এন্ট্রি মেলে।
তার অভাব অবশ্য কোনো কালেই ছিল না; দাদুর বন্ধুরা তো সব এক পায়ে খাড়া; সারাদিন - গিন্নি! গিন্নি! বলে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে!
সবচেয়ে তোষামদ করে হরিবোলদাদু- এক বিখ্যাত গয়নার দোকানের মালিক; তাঁর ছেলে আবার বাবার বুজুম ফ্রেন্ড, আমায় আদর করে মা বলেও ডাকে।
দেরী না করে সেই সম্বন্ধই পাকা করে ফেলি। একটাই শর্ত- অনেক ইমনিশনের গয়না দিতে হবে!
স্বয়ংবরে সিলেক্টেড হয়ে মহা আল্লাদে দাদু বলে, 'ইমিটেশন ক্যান? সোনায় মুইরা দিমু !'
- 'চুক্করো! বলছি ইমনিশন, আর উনি সোনা সোনা করছেন !' আবহমান নারীর মত হবু বরের ওপর তম্বি করে উঠি.. জিনের মধ্যেই রয়েছে কিনা!
আসলে ওটা নিয়ে ব্যথা আছে, এই তো সেদিন, ঝন্নার ইমিটেশনের গয়নার বাক্স একটু হাটকেছিলাম বলে কী হেনস্থা ! কী হেনস্থা !

কিন্তু এহেন সুপাত্রও বাতিল হয়ে গেলো স্রেফ একদিন মন দিয়ে পড়াশুনো করতে উপদেশ দেওয়ায়।
অবশ্য আমার মনাকাকা ততদিনে আর এক সৎপাত্র খুঁজে পেয়েছে।
রোজ সকালে, সে যখন আমাদের বাড়ির পাশের পুকুরে জল তোলপাড় করে স্নান করে, দুজন অ্যাডমায়ারার তাঁকে লক্ষ্য করে - দোতলায় আমি আর পুকুরপারে হাফপ্যান্ট পরা কানাইলাল বাঁদর।
কানাইলালের নাম কানাইলাল হলো কেন, সে এক ইতিহাস। বোধহয়, জোব চার্ণকের আমল থেকে দুই দুরসম্পর্কের জ্ঞাতি - কানাইলাল ও রামলাল পরিবার কোলকাতায় পাশাপাশি বাস করেছে আর লাঠালাঠি করেছে। বেশ কয়েক বছর আগে সে শত্রুতা মামলা মোকদ্দমা অবধি গড়ায়, আর পরাজিত রামলাল পরিবার গায়ের ঝাল মেটানোর জন্য শত্রুপক্ষের দোর্দন্ডপ্রতাপ পূর্বপুরুষের নামে বাঁদর পোষে। কালক্রমে সবার সঙ্গে সবার ভাব হয়ে গেছে, শুধু বুড়ো কানাইলাল বাঁদর রয়ে গেছে এক বনেদী শত্রুতার স্মৃতি হয়ে।

তখন ঠাকুমার কাছে বুদ্ধু-ভূতুমের গল্প শুনতাম। কানাইলাল বাঁদরের মানুষের মত পায়াভারী হাবভাব দেখে একদিন মনাকাকার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ও আসলে ছদ্মবেশী রাজকুমার বুদ্ধু কিনা; আর সেটাই কাল হল।
আমার ইষ্টদেবতা মনাকাকা আমায় বুঝিয়ে ছাড়লো - কানাইলাল আর আমার মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই; ও ছাল পরানো বাঁদর, আর আমি নাকি ছাল ছাড়ানো বাঁদর, একে বারে রাজযোটক!
পড়াশুনোও করতে বলবে না, সারাদিন দুজনে এ ডাল ও ডাল লাফিয়ে বেড়াবো- এমন রাজপুত্র হাতছাড়া করা মোটেই উচিত নয়; প্রাণের বন্ধু বুড়ি জানতে পারলে আগেই নাকি বিয়ে করে নেবে।
'কিন্তু ছাল পরানো বাঁদর যে! লোকে হাসবে!' ক্ষীণ কন্ঠে মনের দোলাচল প্রকাশ করে ফেলি।
'ধুর বোকা! বিয়ের রাতে আমি ঘরে ফায়ার প্লেসের ব্যবস্থা করে দেব, কানাইলাল ছাল খুলে ঘুমোলেই পুড়িয়ে দিও!' মুশকিলআসান মনাকাকা সমস্যার তুরন্ত সমাধান করে দেয়।

কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়, সম্পর্ক পেকে ওঠার আগেই কানাইলাল বাঁদর সাধনোচিত ধামে গমন করেন। তবে সত্যি বলছি আপনাদের, বাপ মায়ের ঠিক করে দেওয়া কর্তা যখন গম্ভীর মুখে ল্যাপটপ নিয়ে বারমুডা পরে বসে থাকেন, তখন মাঝে মাঝে মনে হয়, 'আবার সে এসেছে ফিরিয়া ...'
©কেকা বসু দেব

সকাল থেকে পরপর তিনটে সার্জারি করে অপারেশন রুম থেকে বেরোয় শহরের নামকরা কার্ডিওলজিস্ট সুশোভন মিত্র। তার মধ্যে শেষ অপারেশনট...
27/10/2025

সকাল থেকে পরপর তিনটে সার্জারি করে অপারেশন রুম থেকে বেরোয় শহরের নামকরা কার্ডিওলজিস্ট সুশোভন মিত্র। তার মধ্যে শেষ অপারেশনটা ছিল সবথেকে কঠিন, রুগীর বয়েস আশির কোঠায়। একটু এদিক ওদিক হলেই রুগীর প্রাণহানির আশঙ্কা তো আছেই। তার উপর বিগত বেশ কয়েক বছর সেইসাথে যুক্ত হয়েছে রুগীর পরিবারের সদস্যদের সাথে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গোলযোগ। কথায় কথায় হাতাহাতি, ভাঙচুর যেন লেগেই আছে। ডাক্তারির মত একটা পবিত্র পেশাতে এসেও প্রতিমুহূর্তে কাজ করতে হয় প্রাণ হাতে নিয়ে। যদিও সুশোভন এসবের উর্ধ্বে। নিপুণ দক্ষতার সাথে ও রুগীকে সুস্থ করে তোলে, অনেক জটিল কেস সহজ হয়ে যায় ওর হাতে এলে। যাক সেসব, অনেকক্ষণ হলো পেটে কিছু পরেনি ওর। এবার নিজের চেম্বারে ঢুকে কিছু একটু খাওয়া যাক। ইন্টারকমে এক কাপ কালো কফি আর চিকেন স্যান্ডউইচ অর্ডার করে চোখটা বন্ধ করে রিভলভিং চেয়ারে বসে সুশোভন। অল্প সময়ের মধ্যেই খাবার এসে যায়। হাত, মুখ ধুয়ে এসে চিকেন স্যান্ডউইচে সবেমাত্র একটা কামড় বসিয়েছে ও এমনসময় কানে আসে একটা চিৎকার,চেঁচামেচি। কী হলো আবার? এই সিকিউরিটিগুলোকে নিয়ে আর পারা গেলনা। ভিজিটিং আওয়ার্স তো শেষ। তা সত্ত্বেও উটকো লোকজন যে কেন ঢোকায় ওরা? সবসময় কেমন একটা গা ছাড়া মনোভাব এদের, বসে বসে খৈনি টিপছে দিনরাত। মাথাটাও হালকা ধরেছে অযথা এই ঝামেলা সহ্য হচ্ছেনা আর।

ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছে সেটা জানতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সুশোভন। এক ওয়ার্ডবয় হুড়মুড় করে ছুটে এসে ওকে জানায়,"ওদিকে এখন যাবেন না ডাক্তারবাবু। গতকাল মহিলা বিভাগে এক বয়স্ক মহিলার জরুরী অপারেশন হয়েছিল। উনি ভালোই আছেন তবুও কয়েকদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এমনিতে ওনার তিনকুলে কেউ নেই, ভাইপোদের কাছেই থাকেন। আজ কোথাকার এক পাতানো মেয়ে এসে বলছে,"উনি অনেক দূর থেকে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছেন। ওনাকে দেখা করতে দিতে হবে, এদিকে ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ। এই নিয়েই তর্কাতর্কি চলছে। আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। নিজের চেম্বারে গিয়ে নিশ্চিন্তে বসুন ,আমরা এদিকে দেখে নিচ্ছি ব্যাপারটা।"

করিডোর বরাবর হাঁটতে থাকে সুশোভন। নিমেষে চোখের সামনে ফুটে ওঠে একটা হাসিমুখ। পরনে ছাই রঙা শাড়ি, আঁচলে লেগে হলুদের ছাপ। রান্নাঘরে একের পর এক সকলের ফাইফরমাশ খেটে চলেছে হাসিমুখে। শাশুড়ির সুগারের ওষুধ, দেওরের চা, ননদের কলেজের টিফিন আরো অগুনতি সাংসারিক কড়চা। তারপর ছোট্ট সুশোভনের দায়দায়িত্ব সব সামলে নিজের সেলাইয়ের কাজ। স্বামী মারা যাবার পর থেকে শ্বশুরবাড়ির একটা ঘরে মুখবুঁজে থাকতেন সরমা। বাপের বাড়ি ফিরে যাবার রাস্তা খোলা ছিলনা সরমার কাছে।। হাজার লাঞ্ছনার মাঝেও তাই ওনার লক্ষ্য ছিল ছেলে সুশোভনকে সঠিকভাবে মানুষ করে তোলা, নিজের পায়ে দাঁড় করানো। সেলাই করতে করতে সরমার হাতে কড়া পড়ে গেছিল। রাতে যন্ত্রণায় শরীর কুঁকড়ে আসতো তবুও সেদিনের ছোট্ট সুশোভনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সরমা বলতেন,"ভালো করে লেখাপড়া কর শোভন। তোকে অনেক বড় হতে হবে।" সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় তো সুশোভন হলো কিন্তু সরমা কেমন আছেন? শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারে বসেও কুলকুল করে ঘামতে থাকে ডক্টর সুশোভন।

কতদিন হলো মায়ের সাথে ওর দেখা করা, কথা বলা হয়না। মাস দুই আগে একবার মিনিট পাঁচেকের জন্য ফোনে কথা হয়েছিল। বছর দুই হলো "স্বপ্নসন্ধানী" বৃদ্ধাবাসে থাকেন সরমা। সুশোভনের স্ত্রী দিয়াশ্রী চায়না শাশুড়ি ওদের সংসারে থাকুক। সরমা ব্যাকডেটেড, একসাথে থাকলে প্রেস্টিজ পাংচার হবে এটাই ছিল দিয়ার যুক্তি। সরমাও আর অযথা কথা না বাড়িয়ে পা বাড়িয়েছিলেন বৃদ্ধাবাসের পথে। কিন্তু শেষ বয়েসটা কী প্রিয়জনের সান্নিধ্যে একটু ভালো করে কাটানো উচিত ছিলনা সরমার? পাতানো মাকে দেখবার জন্য কত দূর থেকে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন এক মহিলা আর সুশোভন? বিবেকের কাছে আজ বড্ড অপরাধী ঠেকে নিজেকে। জীবনে সফল হয়েও আজ সন্তান হিসাবে ও চূড়ান্ত অসফল। যে করেই হোক আজ একবার মায়ের কাছে যেতেই হবে সুশোভনকে । গাড়িতে যেতে যেতে পুরনো দিনের অসংখ্য চালচিত্র ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সরমাদেবী বরানগরে গঙ্গার ধারে যে বৃদ্ধাবাসে থাকেন সেখানে পৌঁছায় সুশোভন। ঘড়িতে এখন প্রায় সাড়ে সাতটা। গেটে বসে থাকা দারোয়ানটি জানায় আটটায় ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ। মাত্র আধ ঘন্টা দেখা করার সময় মায়ের সঙ্গে। জলদি মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ায় সুশোভন।

দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায় ও। চারদিকে অসংখ্য রঙিন সুতো। মা একমনে বুনে চলেছে নকশীকাঁথা ঠিক যেমন আগে বুনতেন। সুশোভনের পায়ের আওয়াজ শুনে মা বলে,"তুই এলি শোভন। দেখ কত কাঁথা বুনেছি। কদিন পরেই তোদের নতুন অতিথি আসতে চলেছে। আমার তরফ থেকে এগুলো উপহার। দিয়াশ্রী তো খুব ব্যস্ত ওর এসব বানানোর সময় কই?"

চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে সুশোভনের। আজও ওর কথা, দিয়ার কথা মা সমানভাবে ভেবে চলেন। মায়ের স্নেহের ফল্গুধারা প্রবহমান এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। সেখানে নেই কোনো হিসেবনিকেষ, চাওয়াপাওয়া। তাইতো যে সংসারে থাকতে পারেননি সেখানকার জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলিয়ে চলতে পারেন মানুষটি।

মায়ের কোলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুশোভন বলে,"আমাকে ক্ষমা করে দিও মা, আমি ভালো ডাক্তার হলাম ঠিকই কিন্তু ভালো মানুষ হতে ব্যর্থ। বোধ করি বড় না হলেই ভালো হতো। তোমার হাতের আদর, চুলের জবাকুসুম তেলের গন্ধ, মৌরলা মাছের টক দিয়ে ভাত খাইয়ে দেওয়া এসব দিনগুলোই বড্ড বেশি ভালো ছিলো।"

__"দূর পাগল ছেলে ওমন মনে হয়। আমি এখানে খুব ভালো আছি রে। সকালে উঠি, প্রার্থনা করি। তারপর খেয়েদেয়ে উঠে কখনও গান শুনি। আর দুপুরের পর থেকেই এই নকশীকাঁথাই আমার সঙ্গী। স্বপ্নসন্ধানী আমাকে বাঁচার নতুন দিশা দেখিয়েছে। বুঝলি শোভন আমাদের জীবনটাও আসলে এই নকশীকাঁথার মত! একটার পর একটা ফোঁড় তুলে নানারকম ছবি বুনে চলি আমরা প্রতিদিন। বিচিত্র তার রঙ, বিচিত্র তার অনুভূতি। কখনো সাদা,কালো কখনো লাল,নীল, সবুজ, হলুদ, আসমান,জমিন।"

ঘড়ির কাঁটা জানান দেয় রাত আটটা। এবার মাকে ছেড়ে ঘরে ফিরতে হবে সুশোভনকে। সরমা কাগজের ব্যাগ ভরে ছেলের হাতে তুলে দেন নিজের হাতে বোনা কতগুলো নকশীকাঁথা। প্রাণভরে সেগুলোর ঘ্রাণ নিয়ে সুশোভন বলে,"আপাতত এগুলো তোমার কাছেই থাক মা, অনেক কদরে থাকবে। আমি এবার থেকে প্রতি সপ্তাহে এসে দেখে যাব। এখন যাই।"

__"যাই বলতে বলতে নেই বল আসি"";সরমার কথা শুনতে শুনতে গাড়িতে এসে বসে সুশোভন। দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে ওর। বাইরে ঝিরিঝিরি নেমেছে এখন। বিদায় বাঁশির সুরে মায়ের মুখটা কি কালো হয়ে এলো? না ওদিকে আর তাকাবে না সুশোভন। স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখে ও। কানে বাজতে থাকে মায়ের বলা কথাগুলো,"বুঝলি শোভন জীবনটা হলো নকশীকাঁথার মতো..."

কম্পাউন্ড ছেড়ে যায় সুশোভনের সদ্য কেনা বিদেশী লাল গাড়িটা। সরমাও মুখ ফেরান। সেলাইয়ের জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে ইজিচেয়ারে এসে বসেন টেবিলে রাখা রেডিওটা চালিয়ে। অঝোর শ্রাবণ তখন ভিজিয়ে দিচ্ছে চারপাশ। জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর কণ্ঠে ভেসে আসে,"এই করেছ ভালো,নিঠুর হে, নিঠুর হে এই করেছ ভালো।
এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো।।"

(সমাপ্ত)

#নকশীকাঁথা
#পুষ্পিতা_ভৌমিক

*ভালো লাগলে অবশ্যই লেখিকার নামসহ শেয়ার করবেন*

খবরদার বলছি, তুমি আরেকবার ফোন দিয়েছো তো এই সংসার রেখে যেদিকে দুচোখ যাবে চলে যাব। থাকো তোমার গাদাগাদা অতিথি, আত্মীয়স্বজন ...
27/10/2025

খবরদার বলছি, তুমি আরেকবার ফোন দিয়েছো তো এই সংসার রেখে যেদিকে দুচোখ যাবে চলে যাব। থাকো তোমার গাদাগাদা অতিথি, আত্মীয়স্বজন আর সংসার নিয়ে। এমন করে এই সংসারে আমি আর থাকতে পারব না।

কথাটা শেষ করেই সুরভী ফোনের লাইন কেটে দিল। আমি মোবাইল কানের কাছে ধরে বসে আছি। আবার ফোন দিব কিনা বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে সুরভীর রাগ দেখলে আমার সত্যি সত্যি ভয় হয়। আজও সুরভী ঠিক ভয় লাগার মতো করে রাগ করল। কিন্তু আজ আমার একটুও ভয় লাগছে না। আমার ভয় অন্য কোথাও। আমি এখন অন্য কিছু নিয়ে ভাবছি। ভাবছি সবুর মুন্সীর কথা। ভাবতে ভাবতে সবুর মুন্সীর ফোন আসল।

- বাজান কনে তুমি? আমি তো তোমার বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়ায়ে আছি।

- আমি তো কাকা অফিসে। আপনি গেইটে গিয়ে আমার নাম বললে বাসায় যেতে দিবে। আপনাদের বউমা বাসায় আছে। আমি একটু পর অফিস থেকে বাসায় আসব কাকা।

সবুর মুন্সী। আমাদের মুরাদপুর গ্রামের মুন্সী কাকা। মুরাদপুর বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠ পার হলে বিশাল এক সফেদা গাছ। সেই গাছ লাগোয়া আড়াআড়ি বাড়িটা মুন্সী কাকার। মুরাদপুর বাজারে কাকার সারের ব্যবসা। ছেলেমেয়ে নেই। মাস ছয়েক আগে হুট করে একদিন ঢাকায় এসে আমাকে ফোন দিল। কাকার কানের সমস্যা। ঢাকায় এসেছেন ডাক্তার দেখাবেন বলে। আমি বাসায় নিয়ে আসলাম। চারদিন থেকে গ্রামে ফিরে গেল। আজ সকালে ফোন দিয়ে বলল তিনি আবার ঢাকায় আসছেন। একটু আগে সুরভীকে এই কথা জানাতেই ফোন দিয়েছিলাম।

আমাদের মুরাদপুর গ্রামের চেনাজানা অনেকে ঢাকায় আসলে আমার বাসায় উঠে। সপ্তাহ দুই থাকার পর গত পরশু আমার ছোট ফুপা বাড়ি গেলেন। মাসের শেষ। হাতে টাকা পয়সার অবস্থা বলতে গেলে ভীষণ খারাপ। এই মাসে ঠিক সময়ে বেতন হবে কিনা বলা যাচ্ছে না। কোম্পানির অবস্থা বেশ খারাপ যাচ্ছে। এখন প্রায় মাস শেষে বেতন নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছে। অল্প বেতনের চাকরি। সেই বেতন নিয়ে যখন ঝামেলা হয় তখন পরিবার পরিজন নিয়ে টিকে থাকা খুব কঠিন। গত দুইদিন টানাটানির মধ্যে বাজার সদাই করে সুরভী চালিয়ে নিচ্ছে। হাতের জমানো টুকটাক সব বেরিয়ে যাচ্ছে তার। আমি জানি সুরভীর খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হলেও এতোদিন কিছু বলেনি। কিন্তু আজ আবার মুন্সী কাকা আসার কথা শুনে রাগ ধরে রাখতে পারল না।

বাসা থেকে ফোন আসেনি। আমি জানি মুন্সী কাকা বাসায় পৌঁছে গেছে। না গেলে কাকা নিজে ফোন দিত। আজ একটু আগে আগে বাসায় পৌঁছানো দরকার। কিন্তু আমি বসে আছি। অফিসের অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহেব গিয়েছেন ডেমরার ফ্যাক্টরীতে। তিনি আসা অবধি আমার অপেক্ষা করতে হবে। হাজার খানেক টাকা এ্যাডভান্স নিতে হবে বেতনের টাকা থেকে। যদিও বেতনের টাকা হিসেব করা। এই মাসের বেতন থেকে বড় মেয়ের স্কুলের ভর্তি টাকা হিসেব করে রেখেছে সুরভী। আমাকে খুব করে বলে দিয়েছে বেতনের টাকা থেকে এক পয়সা যেন এ্যাডভান্স না নিই। কিন্তু এখন উপায় নেই। ঘরে বাজার সদাই কিছুই নেই। তাছাড়া মুন্সী কাকা এসেছেন। এখন এই ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।

অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহেব আসতে আসতে সন্ধ্যা হলো। অফিসের লোকজন বলতে আমি আর পিয়ন মতিন। মতিন আমার উপর খুব বিরক্ত হচ্ছে। দুই দুইবার চায়ের কথা বললেও সে চা দেয়নি। যদিও এই নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার খেয়াল এখন অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহেবের দিকে।

- এ্যাডভান্স তো দেওয়া যাবে না ফরহাদ সাহেব। এই মাসের বেতন নিয়ে চিন্তায় আছি কী করব। এদিকে আপনি বসে আছেন এ্যাডভান্স নেওয়ার জন্য। স্যারের বারণ আছে ফরহাদ সাহেব।

- ঝামেলায় আছি কুতুব সাহেব। দেখেন যদি কিছু একটা করতে পারেন।
- কিছু করার নাই। মার্কেটে অনেক টাকা আটকে আছে। আল্লাহ আল্লাহ করেন মাস শেষে যেন বেতনের টাকাগুলো পাওয়া যায়। এখন অন্যকিছু নিয়ে টেনশন দিয়েন না তো ফরহাদ সাহেব। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বাড়ি যান।

অ্যাকাউন্ট্যান্ট কুতুব সাহেব না করে দেওয়ার পরও আমি কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। আমি জানি উনি খুব বিরক্ত হচ্ছেন। সেই বিরক্তি উনার চেহারার দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে। আমি ইচ্ছে করেই তার দিকে তাকাচ্ছি না। তাকালে আমার কেমন জানি খুব অসহায় অসহায় লাগছে। তারপরও আমি বসে আছি। বসে আছি যদি কুতুব সাহেব মত পাল্টান।

কুতুব সাহেব মত পাল্টালেন না। আমি অফিস থেকে বের হয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। আর কোনো উপায় নেই। পরিচিত সামর্থ্যবান সবার কাছে কিছু না কিছু ধারদেনা আমার আগে থেকেই আছে। আর কারো কাছে গিয়ে উপায় নেই বলেই আমি বাসার দিকে রওনা দিলাম।

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আটটা বাজল। মুন্সী কাকা ঘুমাচ্ছেন। রান্নাবান্নার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সুরভী রান্না ঘরে কিছু একটা করছে। আমি বুঝতে পারছি সে কিছু একটা ব্যবস্থা করেছে। আমাকে দেখে কিছুই বলল না। রেগে আছে বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি বলেই আমি নিজ থেকে কিছু বলার সাহস পেলাম না।

রাতের খাবার দেয়া হয়েছে। ডিম, আলু ভাজি আর মসুর ডাল। সুরভী মসুর ডাল খুব ভালো রান্না করতে পারে। একবার কেউ যদি সুরভীর হাতের মসুর ডাল রান্না খেয়েছে সে অনেক দিন মনে রাখবে। মুন্সী কাকা খুব আয়েশ করে ভাত খাচ্ছেন। এই বাসায় কেউ আসলে সুরভী চেষ্টা করে ভালো মন্দ কিছু রান্না করে খাওয়াতে। আমি জানি সুরভীর খুব মন খারাপ। শুধু ডাল ভাত দিয়ে অতিথিদের খেতে দিয়েছিল সুরভী এমনটা আমার মনে পড়ে না। আমি নিজেও চেষ্টা করি আমার ঢাকার বাসায় কেউ আসলে একটু ভালোমন্দ বাজার করতে। মুন্সী কাকাকে আয়েশ করে খেতে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। ডিম দুইটা। কাকা অর্ধেক ডিম আমার বড় মেয়ের পাতে দিতে দিতে বলল, আমাগো বউয়ের হাতে রান্না মাশাআল্লাহ স্বাদের। এই ডাল দিয়া এক হাড়ি ভাত খাওয়া যাবি। শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো না। খাওয়া দাওয়া কমায়ে দিয়েছি। এই বয়সে ডিম একটু কম খাওয়া ভালো। আমার ভাগের থে অর্ধেক তোমার খাওয়া লাগবি বইন।

খাওয়া শেষ করে মুন্সী কাকা মোনাজাত ধরলেন। আমার দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাকা ইশারা করলেন তারাও যেন মোনাজাত ধরে। কাকার মোনাজাত শেষ করে আমার মেয়ে দুইটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, খাওনদাওন আল্লাহর নিয়ামত। এই নিয়া শুকরিয়া করতি হয় বইন। এই কইরলে আল্লাহ খুশি হবি।

পরের দিন অফিস যেতেই অ্যাকাউন্ট্যান্ট কুতুব সাহেব আমার হাতে দুই হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল, আমি জানি আপনি ঝামেলায় আছেন। অফিস থেকে অগ্রিম দেওয়া স্যারের নিষেধ আছে। এই টাকা আমার নিজের। চালিয়ে নেন মাহমুদ সাহেব। বেতন হলে ফিরিয়ে দিয়েন।

কুতুব সাহেবের কাছ থেকে টাকা পেয়ে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। গতকাল উনাকে যতটা কঠিন মনে হয়েছিল উনি ঠিক তেমন না। মানুষটার মনে মায়া আছে। ফোন দিয়ে সুরভীকে জানিয়ে রাখলাম আসার সময় বাজার সদাই নিয়ে আসব।

মুন্সী কাকা থাকলেন আরো একদিন। ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে গেলেন একদিন পর। এদিকে আমার সংসার এমন করে টেনে টুনে চলতে লাগল। ধার করি, বেতন পেলে ফেরত দিই এমন করে চলতে লাগল। সুরভী খুব হিসেব করে সংসার চালায়। এদিক ওদিক করে আমার অল্প বেতনের টাকায় সংসার টা টিকিয়ে রেখেছে সে।

এদিকে গ্রাম থেকে আমার বাসায় অতিথি আসা কিন্তু থেমে নেই। প্রতি মাসে কেউ না কেউ আসছে। কেউ একদিন, কেউ তিন দিন কিংবা কেউ সপ্তাহ থাকার পর ফিরে যায়। এই নিয়ে সুরভী মাঝে মাঝে খুব রাগ করে। ভীষণ রাগ। এমনও হয়েছে রাগ করে সুরভী একবেলা না খেয়ে থাকল। আমি কিছুতেই সেই রাগ ভাঙ্গাতে পারলাম না। তার রাগ আমার উপর। কখনো রাগ করে অতিথির অবহেলা করেছে তা কিন্তু হয় নি। আমার আব্বা গ্রামের সহজ সরল সাধারণ কৃষক। আব্বা মনে প্রাণে চাইতেন গ্রামের মানুষ ঢাকায় আসলে যেন তার ছেলের বাসায় উঠেন। গ্রামের লোকজন শহর থেকে ফিরে গিয়ে তার ছেলেকে নিয়ে গল্প করবে সেটা শুনতে আব্বার খুব ভালো লাগে। আব্বার পাঞ্জাবীর পকেটে আমার বাসার ঠিকানা লেখা একটা কাগজ আছে। লাল রঙের সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো দিকে এই ঠিকানা লেখা। কেউ জানতে চাইলে সেই ঠিকানা দেখিয়ে লিখে নিতে বলেন। গ্রামের লোকজন আব্বাকে এই সহজ সরলতা এবং ভালো মানুষীর জন্য ভালোবাসেন। মাঝে মাঝে আমার নিজের বিরক্ত লাগলে আব্বার কথা ভেবে কিছু বলতে পারি না।

এরইমধ্যে বছর খানেক গেল। আমি চাকরী পাল্‌টালাম। আগের চেয়ে বেতন একটু বাড়তি পাই ঠিকই কিন্তু সংসারে ওই টানাটানি ঠিকই আছে। বাসায় অতিথি আগের চেয়ে বরং বেড়েছে। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। হঠাৎ করে আমার বড় মেয়ের ভীষণ অসুখ ধরা পড়ল। বেশ কিছুদিন যাবৎ জ্বর। এই জ্বর কিছুতেই কমছে না। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মাথায় সুক্ষ জটিল এক টিউমার ধরা পড়ল। ডাক্তার বলে দিয়েছেন শীঘ্রই অপারেশন করানো দরকার। অপারেশন করার আগে আবার বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। তখন বিষয়টা আরো বিস্তারিত জানা যাবে। এসব শুনে সুরভী পাগলের মতো হয়ে গেল। আমাদের সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। যা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাই। এখন হঠাৎ করে লাখ তিনেক টাকা আমাদের জন্য যেন আকাশকুসুম কল্পনা। আমি জানি আব্বার কাছে বলে লাভ নেই। তারপরও বললাম। আব্বাকে বললাম দোয়া করতে।

নানা ঝামেলায় আছি। এরই মধ্যে মুন্সী কাকা এসে হাজির। কেনজানি মুন্সী কাকাকে দেখে আমার খুব রাগ হলো। খুব রাগ। আমার আর সুরভীর মনের অবস্থা ভালো নেই। মুন্সী কাকা বসে আছেন আমাকে নিয়ে কানের ডাক্তারের কাছে যাবেন। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। এমনিতেই বাসায় ফিরতে দেরী হয়। এদিকে মুন্সী কাকা কিছুতেই আমাকে ছাড়া ডাক্তারের কাছে যাবেন না। আমি অফিস থেকে ফিরতেই খুব জোরাজুরি করল তার সাথে যাওয়ার জন্য। আমি সোজাসুজি না করলাম। বললাম, কাকা আপনি একা যান। আমার শরীর ভালো না।

মুন্সী কাকা আমার কথা শুনে কী বুঝল জানি না। কিছু না বলে একা একা ডাক্তারের কাছে গেলেন। ফিরলেন অনেক রাত করে। পরের দিন খুব ভোরে গ্রামে ফিরে গেলেন। আগের বার যাওয়ার সময় আমি আরো কিছুদিন থাকার জন্য অনুরোধ করতাম। এবার কিছুই বললাম না। কেন জানি এসব করতে আমার আর ভালো লাগছিল না। বড় মেয়েটার চিন্তায় সারাদিন মগ্ন থাকি। মেয়ের চিন্তায় সুরভীও দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। টানাটানি করে আমার সংসার চলে যাচ্ছিল। এই নিয়ে আমার তেমন কোনো আফসোসও ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে মেয়েটার এমন রোগে পুরো সংসার যেন এলোমেলো করে দিল।

মুন্সী কাকা ফিরে যাওয়ার সপ্তাহ খানেক পর আব্বা আসলেন। শহরে আব্বা খুব একটা আসেন না। ভাবলাম নাতনির অসুখ শুনে দেখতে আসলেন। কিন্তু আব্বা এমনি এমনি আসেন নি। আব্বা টাকা নিয়ে আসলেন। আব্বার হাতে টাকা দেখে আমি আর সুরভী তো অবাক। এত টাকা আব্বা পেলেন কোথায়! আমাদের এমন কিছু যে নেই আব্বা বিক্রি করে এই টাকা আনতে পারেন। আব্বার কাছে জানতে চাইলাম। আব্বা চুপ করে আছেন। একদম চুপ। আমি এবার জোর করলাম। আব্বা বাচ্চাদের মতো কাঁদল। আব্বার কান্না দেখে আমার ভয় বাড়ল। এমন করে আব্বাকে তো কাঁদতে দেখিনি। এত টাকা নিয়ে এসে আব্বা এমন করে কাঁদছে কেন? আমি আব্বার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম। আব্বার হাত দুটো ধরে বললাম আব্বা, কী হয়েছে আপনার?

আব্বা আমার দিকে তাকালেন। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, আমি লোকজনেরে তোমাগে শহরের বাসায় পাঠায়ে খুব বিরক্ত করি এই আমি জানি। তোমাগো আয় রোজগার তেমুন ভালা না এই সংবাদও আমার জানা আছে। তার মইধ্যে এমুন কইরে গ্রেরামের মানুষজন আইসে থাহে। তোমাগে কষ্ট হয় । কিন্তু তোমরা কহনো বেজার হও নাই। সকলেই আমার ছাওয়াল, ছাওয়ালের বউয়ের রান্নার তারিফ করিছে। এই তারিফ শুইনে আমার খুব ভালো লাগে।

আমি বললাম, এই নিয়ে আমরা তো কিছু বলি নাই আব্বা। কিন্তু এই টাকার সাথে এসব কথা কেন বলছেন ?

- কচ্ছি, এবার বাড়ি ফিরত গিয়ে মুন্সী মিয়া সোজা আমাগের বাড়িত গিয়া হাজির। আমার নাতিনের খবর আমি কাউরে কই নাই। মুন্সী মিয়া আমারে গিয়া কইল, কিছু একটা হয়েছে। তুমি আমায় কও কী হয়েছে।

- তারপর?

- আমারে জোর কইল্লো। শেষে সব ঘটনা খুইলে কইয়েছি। আমার কাছে ঘটনা শুইনে যাওনের চারদিন পর আবার আইসেছে মুন্সী মিয়া। আমার হাতে এই টেকা দিয়া কয়েছে তাড়াতাড়ি যেন তোমার কাছে পৌঁছায়ে দিই।

- কাকা এত টাকা পেয়েছে কোথায়?

- মুরাদপুর বাজারের সারের দোকান বিক্রি করেছে। আমি বেজার হয়েছি। কিন্তু মুন্সী মাইনলো না। মুন্সী কইলো, ছাওয়াল-পাওয়াল তো আমার কেউ নাই। বয়স হয়েছে। জমি জমা যা আছে তা দিয়ে চইলে যাবে। শহরে গেলে মনে হয় আমার ছাওয়ালের বাড়ি গিয়াছি। গিয়া ছাওয়ালের বউয়ের হাতের রান্না খাইয়ে আইসেছি। তোমার ছাওয়াল অহন আমারো ছাওয়াল।

আমি কী করব বুঝতে পারলাম না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। গতবার মানুষটার সাথে এমন করা নিয়ে আমার কষ্ট যেন বাড়তে লাগল। আমি জানি তিনি মনে মনে কষ্ট পেলেও আব্বাকে এই নিয়ে কিছু বলেন নি।

মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম তাও প্রায় মাস দুয়েক হতে চলল। টাকা পয়সা যোগাড় না হওয়াতে ইচ্ছে করেই আর ডাক্তারের কাছে যাইনি। যদিও এর মধ্যে মেয়ের শারীরিক অবস্থা বেশ ভালো। মেয়েকে দেখলে মনে হয় না তার কোনো রোগ আছে। আগের মতো স্বাভাবিক। টাকা পাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার নতুন করে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দিলেন। পরীক্ষার পর রির্পোট দেখালাম। রির্পোট দেখে ডাক্তার আবার অন্য জায়গায় পরীক্ষা করতে দিলেন। সেই রির্পোটও দেখালাম। রির্পোট দেখে ডাক্তার বলল, কোথাও একটা ভুল হয়েছিল। জানি না ভুল টা কোথায়। তবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করেন যে আমরা যা ভেবেছিলাম আপনার মেয়ের সেই রকম কিছু হয়নি। আপনার মেয়ে এখন পুরোপুরি সুস্থ।

আমার কাছে সবকিছু কেমন যেন স্বপ্ন মনে হতে লাগল। আমি আর সুরভী ডাক্তারের সামনে পাগলের মতো করে কাঁদছি। আমাদের কান্না দেখে ডাক্তার নিজেও লুকিয়ে চোখ মুছলেন। এমনটা হয়তো তিনি নিজেও কখনো দেখেন নি।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে সুরভী বলল, আমি আজই মুরাদপুর যাব।

- রাত তো দশটা বাজল। আমরা না হয় সকালে রওনা দিই।

- না, আমি আজই যাব। সকাল হতে হতে মুরাদপুর পৌঁছে যাব।

সুরভীর আগ্রহ দেখে আমি আর না করলাম না। বাসায় গিয়ে টুকটাক গোছগাছ করে সেদিনই আমরা দুই মেয়ে নিয়ে মুরাদপুর রওনা দিলাম। পৌঁছলাম ভোরের দিকে। ভোর রাতের ঈষৎ অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে সবে আলো ফুটছে। প্রথমে গেলাম মুন্সী কাকার বাড়ি। বাড়ির বারান্দায় কোণার দিকে মুন্সী কাকা ফজরের নামাজ শেষ করে মোনাজাত করছেন। কাকা কাঁদছেন। চোখ বন্ধ করে কী সব বলে কাকা কাঁদছেন। তখনো তিনি আমাদের দেখেন নি। কাকার পেছনে দাঁড়িয়ে সুরভী কাঁদছে। ভোরের প্রথম প্রহরের আলোয় এই দুইটা মানুষের কান্না আমার কাছে মনে হলো পার্থিব কোন সুখ বর্ষিত হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে সেই সুখ বর্ষণ করছেন।

মোনাজাত শেষ করে কাকা আমাদের দেখে একটু অবাক হয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ও আল্লাহ, এই সকাল সকাল তোমরা আমার বাড়িত?

এতক্ষণ আমার একটুও কান্না আসে নি। কিন্তু মুন্সী কাকার কণ্ঠ শুনে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। কাকা কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। কাঁদছে সুরভী আর আমার মেয়ে দুইটাও। কাকাকে জড়িয়ে ধরেই আমি বললাম, আমাকে মাফ করে দেন কাকা। গতবার আমার বাসায় গিয়ে আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন। এটা আমি ইচ্ছে করে করি নি কাকা।

কাকা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল, ছাওয়ালের উপর বাপ-মায়ে কখনো রাগ করতি পারে না। শেষবার গিয়া আমি বুঝতি পারিছি তোমাগের কিছু একটা হয়েছে। আমি বুঝিছি ইডা খারাপ কিছু। তোমাগের খারাপ দেখে যে আমার মনেও কষ্ট হয়েছে। খুব কষ্ট।

আমি কিছু একটা বলব তখন কাকা সুরভীর দিকে তাকিয়ে বলল, এই বউ ঘরের জমানো পত্রিকা বেইছে বাজার করিছে। আমারে খাওনের জইন্যে ডিমের কোরমা, আলু ভাজি আর ডাইল রাধিছে। ঘরে কিছু নাই কিন্তু আমারে দেইখে বেজার হয় নাই কহনো। শুধু আমি কেন, এই গেরামের যারা গিয়েছে কেউ আইসে কতি পারে নাই অমুকের বাড়িত গিয়ে খারাপ থাকিছে, খারাপ খায়েছে। অথচ গতবার আমি গিয়ে বুঝেছি তোমাগের কিছু একটা হইয়েছে। আমি অনেক কিছু বুঝি বাজান। বউয়ের রান্না খাইয়ে বুঝেছি আমাগের বউ ভালা নাই । ওইদিন ডাইল খাইয়ে আমি বুঝেছি আমাগের বউ এমুন কইরে ডাইল রাঁধে না। আমাগের বউয়ের কিছু একটা হইয়েছে।

মুন্সী কাকা একটার পর একটা বলে যাচ্ছেন। সুরভী হাউমাউ করে কাঁদছে। সুরভীর কান্না দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। সুরভীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, পৃথিবীতে এমন সুখী মানুষের ছবি বোধহয় খুব কম আছে। আমি মুন্সী কাকার কাছে গিয়ে টাকা গুলো দিয়ে ঘটনা খুলে বললাম। কাকা টাকা গুলো আমাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, এই জিনিস তোমার কাছেই থাকুক। যহন কাজে লাগবি আমি চাইয়ে নিব বাজান।

ভোরের দিকে আমাদের আসতে দেখে গ্রামের কেউ একজন হয়তো আমাদের বাড়িতে খবর দিয়েছে। আব্বা-আম্মা, কাছের লোকজন সেই ভোরে মুন্সী কাকার বাড়ি এসে হাজির। আস্তে আস্তে মুরাদপুরের অনেকের কাছে খবর গেল আমরা বাড়ি আসছি। এই কয়দিনে আব্বার কাছে গ্রামের অনেকে আমার মেয়ের অসুখের কথা জেনে গিয়েছে। এখন হঠাৎ করে গ্রামে আসার খবর শুনে সবাই ছুটে আসল। মুন্সী কাকার বাড়ি লোকে লোকারণ্য। মেয়ের কিছু হয় নাই এই সংবাদ শুনে সবাই যেন আনন্দে আত্মহারা।

মুন্সী কাকার বাড়ির পুরো উঠান জুড়ে মানুষ আর মানুষ। মুন্সী কাকা মোনাজাত ধরলেন। কাকা চিৎকার করে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছেন। ভোরের প্রথম প্রহরের মোনাজাতে অনেকে কাঁদছেন। আমি সবার দিকে তাকিয়ে আছি। মুন্সী কাকা সৃষ্টিকর্তার কাছে একটার পর একটা ফরিয়াদ করছেন, শুকরিয়া করছেন। আমার কাছে মনে হলো আমি কোনো এক স্বর্গের মাঝে বসে আছি। আমার চারপাশে মানুষের ভালোবাসা আর ভালোবাসা। আমি সেই ভালোবাসায় স্বর্গের সুখ স্পর্শ নিয়ে ভেসে যাচ্ছি।

ছোট্ট এই গ্রাম থেকে অনেকে শহরে আমার বাসায় গিয়েছে। স্বল্প আয়ের এই আমি সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু পেরেছি যত্নআত্তি করেছি। মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও কখনো কাউকে বুঝতে দিই নি। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে এই মানুষগুলো আমার জন্য আশীর্বাদ। এই আশীর্বাদ অবহেলা করলে সৃষ্টিকর্তা নাখোশ হন। আমি এখন যেমন আছি, হয়তো এর চেয়ে খারাপ থাকতে পারতাম। হয়তো এই মানুষগুলোর আশীর্বাদ আমাকে এইটুকু ভালো রেখেছে। আমার সকল বিপদ গুলো সৃষ্টিকর্তা নিজেই সরিয়ে নিয়েছেন।

ভোরের নরম আলোর কুসুম ফেটে সূর্যের প্রথম রোদ এসে পড়ছে আমার প্রিয় গ্রাম মুরাদপুরে। ঠিক এই আলোর মত করে আমি মানুষকে ভালোবাসতে চাই।

পৃথিবীতে মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো কর্ম হতে পারে না।

#অতিথি
©রুহুল আমিন*

Address

Ranaghat Dhantala, Nadia
Ranaghat
741201

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Dreamful Life posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share

Category