29/10/2025
সেদিন রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি রিকশা ধরবো বলে, দেখি সামনে একটা ছেলে এসে রিকশা নিয়ে দাঁড়ালো।
"মিঠি, ওঠো ওঠো!" — আমি একটু অবাক হয়ে দেখলাম। বয়স প্রায় সাতাশ-আঠাশ, রুগ্ন শরীর, কিন্তু চোখ দুটো বড় মায়াময়।
খুব ভাবার চেষ্টা করলাম পরিচিত কিনা! কিন্তু চিনতে পারছি না। পরিচিত কিছু রিকশাচালকদের মধ্যেও কোথাও এর ছবি নেই।
"উঠে পড়ুন দিদি! এমনিতেই আমি এই স্ট্যান্ডের না! এরা দেখলে আবার চিৎকার করবে!" — ছেলেটি তাড়াহুড়ো করে বললো।
"তা তোমাকে কে বলেছে ভাই এতো উপকার করতে! আমি তো এখানকার রিকশাতেই চলে যেতে পারি!" — এই কথাগুলো বলতে যাবো, তার আগেই মিঠির কম্ম সারা। উঠে বসেছে রিকশায়।
আমি রিকশায় উঠে মিঠিকে গলাটা নামিয়ে বললাম, "চিনিস তুই?" মিঠি ভুরু কুঁচকে বললো, "একদম না!"
এবার একটু ভয়ই লাগছে। চারিদিকে যা সব ঘটনা ঘটছে! "মিঠি, নাচে যাও এখনও?" — শুনলাম, ছেলেটা রিকশা চালাতে চালাতেই বললো।
মিঠি সুর করে বললো, "হ্যাঁ, শনিবার যাই তো! কালই যাবো!"
এই হলো মিঠির সমস্যা — অতিরিক্ত বকে! আর এই জন্যই আমার ভয়। আজকাল বাচ্চারা সত্যি নিরাপদ নয়। তার ওপর এই ছেলেটার মতো মানুষগুলোই দিনের শেষে পেটে জল পড়লে ভয়ানক হয়ে যায়।
এসব ভেবেই আরও ভয় পেয়ে গেলাম। মিঠিকে আলাদা করে চিনবে কীভাবে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।
কিন্তু চেনে তো বোঝা যাচ্ছে। নামটাও ঠিক বলছে। "দিদি, মিঠি এখনো দুষ্টুমি করে?" — শুনলাম, রিকশা চালাতে চালাতেই জিজ্ঞেস করছে সামনের ছেলেটা।
আরও অবাক হওয়ার পালা এবার আমার। মিঠি তাহলে দুষ্টুমিতে এতো পরিচিত যে কলমে অনিন্দিতা হয়েও আমি কিছু করতে পারলাম না।
আমি কিছু বলার আগেই মিঠি বললো, "আমি এখনো দুষ্টু আছি! এই তো দিদুন বাড়িতে একটা গ্লাস ভেঙে আসলাম!"
বলেই হেসে যাচ্ছে মিঠি, সাথে ছেলেটিও। আমি এবার না চাইলেও জিজ্ঞেস করে ফেললাম, "তুমি মিঠিকে কিভাবে চেনো?"
ছেলেটা একটু থেমে বললো, "রূপা ড্রেসেস অ্যান্ড মেকআপ।" নামটা বেশ চেনা — শুধু আমি নই, এই অঞ্চলে সবাই চেনে।
ওরা নাচের প্রোগ্রামে ড্রেস ভাড়া দেয়, আর সাথে মেকআপ করায়। মনে পড়লো, মিঠিদের নাচের প্রোগ্রামে এই রূপা ড্রেসের মালিক রূপা মজুমদারকে সুন্দর মেকআপ করানোর জন্য পুরস্কার দিয়েছিল কোনো একটা মিডিয়া থেকে।
মনে পড়ায় এবার নিশ্চিন্ত হলাম আমি। কিন্তু ও কি করে মিঠিকে চেনে! ভেবেই জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কি ওখানে কাজ করো?"
ছেলেটা হমম বললো। আমি ধরেই নিলাম, ও তাহলে ভ্যান চালিয়ে ড্রেস নিশ্চয় হলে পৌঁছে দেয়! এটাই হয়তো করে — একজন রিকশাচালকের বেশি আর কী করবে!
ছেলেটা বললো, "সামনে তো আবার প্রোগ্রাম!" তারপর পিছন ঘুরে মিঠির দিকে তাকিয়ে বললো, "এবার দুষ্টুমি করলে কিন্তু অন্ধকার ঘরে আটকে রাখবো! আগেরবার যা করেছিল!"
গ্রীনরুমের ভেতরকার খবর আমি সত্যি জানি না। তাই একটু উৎসাহ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, "কি করেছিল গো?"
বললো, "দিদি, চোখ আঁকতে বসে এতো নড়েছে — নিজেরটা তো বিগড়েছেই, সাথে এমন হাত নাড়িয়েছে যে পাশের বাচ্চার মুখে আমার হাতে থাকা কালো রঙ পড়ে গেছে!"
এই ঘটনাটা সত্যি আমার অজানা। কিন্তু শুনে একটু লজ্জাই লাগছে। মিঠিকে বললাম, "তুই এটা করেছিলি?" মিঠি মাথা নাড়িয়ে হমম বলে বললো, "সে তো অনেকদিন আগে!"
সত্যি, যেকোনো ঘটনার তক্ষুনি যে রেশটা থাকে, সেটা পরে আর থাকে না। তাই আমারও খুব রাগ হচ্ছে না, আর বুঝলাম মিঠিও ভয় পাচ্ছে না যে ওই ঘটনার জন্য ও বকা খেতে পারে!
ছেলেটি আবার বললো, "দিদি, সেদিন মিঠিকে খুব বকেছি। আর ওই মেয়েটা মিঠিরই বয়সি, খুব শান্ত। কি সুন্দর চুপচাপ থেকে আমাকে সাহায্য করেছিল! ধীরে ধীরে ওর মুখ থেকে কালো রঙ উঠিয়ে আমি আবার মেকআপ করে দিয়েছিলাম!"
সেসব শুনে আমার খারাপ লাগার কথা, কিন্তু তা না হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি মেকআপ আর্টিস্ট?"
ছেলেটা জোরে হেসে বললো, "আর্টিস্টি কিনা জানি না! আমি ওই রূপা ম্যাডামের গ্রুপে মেকআপ করি, চোখ আঁকি! চোখ আঁকাটাই আমার পেশা। ঠাকুরের বলুন, নাচের প্রোগ্রাম, বিয়েবাড়িতে বৌয়ের — সব জায়গায়!"
মনে পড়লো, মিঠিদের নাচের স্কুলে বড়দের একটা নাচে চোখগুলো একটু অন্যরকমভাবে আঁকা হয়েছিল।
অসাধারণ মেকআপ হয়েছিল — সবাই আলোচনা করেছিলাম আমরা। তাহলে সেই মেকআপটাও কি এই ছেলেটাই করেছিল? ভেবেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কি ওই নৃত্যনাট্যের মেকআপ, মানে চোখ এঁকেছিলে?"
রিকশা ততক্ষণে থেমে গেছে আমার বাড়ির সামনে। ছেলেটা রিকশা থেকে নেমে বললো, "হমম, হরিণের চোখের মেকআপ তো? কি একটা নৃত্যনাট্য হয়েছিল যেন, সব হরিণ সেজেছিল!"
আমি হমম বলে বললাম, "ওই মেকআপের জন্য তোমাদের গ্রুপ তো পুরস্কার পেল! রূপা ম্যাডাম এসে প্রাইজ নিলেন!"
ছেলেটা মনে হয় আমার কথাটা ধরতে পেরেছে। তাই বললো, "হমম, রূপা ম্যাডাম প্রাইজ নিয়েছেন, নাম কিনেছেন! ফিরে এসে আমাকে বারোশো টাকা ধরিয়েছেন!"
"আমিও ওটা নিয়েই খুশি। প্রতিটা শো-পিছু বারোশো করেই পাই। বৌয়ের মেকাপে অবশ্য দাম বেশি — ওটায় রূপা ম্যাডাম পনেরোশো দেন! খালি মেকআপ আর চোখ আঁকি!"
আমি বললাম, "এতো গুণ তোমার! তুমি তো আরও গ্রুপে কাজ করতে পারো!"
ছেলেটি বললো, "দিদি, সে শর্তেই ঢুকেছি যে একসাথে একাধিক মেকআপ কোম্পানিতে জয়েন করা যাবে না। আর এখানে ভালোই কাজ হয় — মাসে পনেরো দিন তো থাকেই সব মিলিয়ে। তাই তো অবসরে বাবার রিকশা নিয়ে বেরোই! বাবা মারা যাওয়ার পর পড়েই আছে, নিয়ে বেরোলে দুটো টাকা হয়!"
ও কথা বলেই যাচ্ছে, তার মধ্যেই আমি পয়সার ব্যাগ খুলে টাকা বের করে ভাড়া দিতে যাচ্ছি। ভাড়া পনেরো হয়, কিন্তু আমার একটু বেশি দিতে মন চাইছে।
কিন্তু মনকে আস্কারা দিলাম না। উল্টে বোঝালাম — এই মানুষটাকে আরও দশ-বারো টাকা বেশি দিলে তাকে অপমান করা হবে, অপমান করা হবে শিল্পীর শিল্পসত্ত্বাকে।
ছেলেটার এই অসাধারণ গুণকে এই টুকু টাকা দিয়ে অপমান করা মানে আমার নিজেকেই ছোট করা।
কিছু বলার আগেই মিঠির গালটা টিপে দিয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটি। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, সঙ্গে রইলো ভাবনা — জানি, যেটা দুদিন পরে ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যাবে।
তাই হয়েছিল। কাজে কর্মে সেসব ভুলে গেছি। হঠাৎ মনে পড়লো সেদিনের বিয়েবাড়ির কথা।
সবাই বলছে, মাংসটা নাকি দারুণ হয়েছে! আমার সামনেই একজন ক্যাটারিংয়ের নম্বর নিলেন।
ক্যাটারিংয়ের ভদ্রলোকও ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিয়েবাড়িতে আর প্রশংসা কুড়োচ্ছেন। অথচ পর্দার পিছনে যে মানুষগুলো বড় বড় উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে এই গরমে ঘেমে এতো ভালো মাংস রান্না করলো, তার খবর কেউ রাখলো না।
রূপা ড্রেসেস বলুন আর উত্তম ক্যাটারার — প্রতিটা প্রতিষ্ঠান আজ নামে-দামে ফুলে ফেঁপে উঠেছে শুধু এই মানুষগুলোর জন্য, যারা সাথে না থাকলে সেদিন রূপা ম্যাডামের পুরস্কার পাওয়াও হতো না অথবা উত্তমবাবুর আরও দুটো অর্ডার আসতো না।
পর্দার পিছনের মানুষগুলোকে সম্ভব হলে সামনে আনুন। পাওয়া প্রাইজটা হাতে তুলে দিন। স্বীকার করুন যে এই ছেলেটি অসাধারণ চোখ আঁকে — তাই না আজ রূপা ম্যাডামের এতো নাম!
অথবা উত্তমবাবু একবার বলুক না কেন — আমার ক্যাটারিংয়ে অমুক রাঁধুনি আছে বলে রান্নায় এতো স্বাদ! তাতে সত্যি কোনো কৃতিত্ব নেই আমার!
যদিও ওনাদের স্বীকারের ধার ধারে না পর্দার পিছনের মানুষগুলো, কারণ গুণগুলো ওদের রক্তে আর ঘামে মিশে গিয়ে কিছু টাকায় বিক্রি হয়ে গেছে। তবু একটু প্রশংসা পেলে ওনাদের মনটা খুশি হবে, আর তাতে আরও বাড়বে রান্নার স্বাদ।
এই প্রশংসা টুকু ওদের প্রাপ্য — বঞ্চিত করবেন না, প্লিজ 🙏
শেয়ার করুন যারা জানে না, তাঁদের শেখান — সবার গুণের সঠিক মূল্যায়ন হোক।
( মিঠি এখন অনেক বড়ো, নাচটা ওর পছন্দের নয় তাই ছেড়েও দিয়েছে! আর দেখা হয়না রূপা ম্যাডামের সেই আর্টিস্ট দের সাথে কিন্তু ফেসবুকে র পাতায় গল্পটা আবার মনে করালো শিল্পীর সম্মান টুকু তার প্রাপ্য!!)
#আর্টিস্ট
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
Feminine Wisdom