
30/08/2025
#সন্তান
#শ্রেষ্ঠসম্পদ
'আমার ছেলে এমনটা হতেই পারে না ',... ' আমার ছেলে এমনটা ভাবতেই পারে না ' ..' আমার ছেলে একাজ করতেই পারে না ' এই ধরনের ভাবনাগুলো বোধহয় এবার ছাড়ার সময় এসেছে। চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি,ঘটনা গুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে। একটি শিশু জন্ম থেকেই অপরাধ প্রবণ মন নিয়ে জন্মায় না। পারিবারিক গন্ডীর বাইরেও পড়াশোনা, খেলাধূলা, আঁকা,গান,নাচ, আবৃত্তি শিখতে তাকে নানা জায়গায় যেতে হচ্ছে,নানা ধরনের বাচ্চার সঙ্গে সে মিশছে।
স্কুলেও সে অনেকটা সময় বন্ধুদের সঙ্গে কাটাচ্ছে; একটু বড়ো হচ্ছে যখন, সেই কিশোর বয়স অর্থাৎ বয়: সন্ধিক্ষণ তার কাছে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। অনেক কিছুই সে জানছে, শারীরিক ভাবে তার পরিবর্তন হচ্ছে,একটা স্বাভাবিক যৌনচেতনা ও চাহিদা তার মধ্যে বিকশিত হচ্ছে। খুব স্বাভাবিক নিয়মেই সে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীর প্রতি আকর্ষিত হয়,তার কাছে যাওয়ার,তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। কখনও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সকলের অগোচরে,তার যৌন চাহিদা চরিতার্থ তার সমবয়সী নাবালিকা বান্ধবীটি,তার ফলশ্রুতি একেবারেই ভালো হয় না দুজনের জন্য। স্বাভাবিক জীবন, পড়াশোনা ও আনুসঙ্গিক কাজে ছন্দ ব্যাহত হয়,এটা শুধু মাত্র দুটো ছেলেমেয়ের এবং তাদের পারিবারিক সমস্য নয়,একটা বৃহত্তর সামাজিক সমস্যাও বটে।
আরেকটি গুরূত্ব পূর্ব সমস্যা হলো বান্ধবী বা সঙ্গিনী প্রত্যাখ্যান করলে তাকে জবরদস্তি করা, সুযোগের অপেক্ষায় থেকে শারীরিক অত্যাচার, ধর্ষণ এবং সরিয়ে ফেলার চেষ্টা। এটি অতীত থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের গুরুতর সামাজিক সমস্যা,যেটি নিয়ে অবিলম্বে আমাদের সকলেরই ভাবা প্রয়োজন
আমাদের প্রত্যেকের ঘরেই ছেলে, মেয়ে আছে... পবিবারের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীদের ও আছে। একদম ছোট বয়স থেকেই ছেলে বা মেয়েকে সাবলীল ভাবে পারিবারিক আত্মীয় স্বজনের,পাড়ার সমবয়সী ছেলে মেয়ের সঙ্গে খেলাধূলা,গল্প করতে দিন... আমার ছেলে বা মেয়ে স্পেশাল,এই মনোভাব রাখবেন না।
আপনি যতই কর্মব্যস্ত হন না কেন, দিনশেষে বাড়িতে ফিরেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে না পরে,কিছুটা সময় তার সঙ্গে কাটান,সঙ্গ দিন... স্কুলে কোন টিচারের পড়ানো সবথেকে ভালো লাগলো,কোন কোন বন্ধুর সঙ্গে টিফিন শেয়ার করে খেলো,কি নিয়ে গল্প হোলো, তাদের নাম কি... গল্পের মতো করেই জানুন।
সমস্যা জটিল হতে শুরু করে কিশোর কিশোরী এবং ও সদ্য যৌবনে পা রাখা তরুণ প্রজন্মেকে নিয়ে। ভুল পথে পা বাড়ানোর এটি আদর্শ সময়।
বাইকে পিছনে/ গাড়ীর পাশের সিটে একজন সুন্দরী বান্ধবী নিয়ে ঘোরা এখনকার ট্রেন্ড, স্ট্যাটাস সিম্বল। ফেসবুক/ ইনস্টাগ্রাম এ Single দেখালে মান ইজ্জত আর কিছুই রইল না, এরকম একটা ব্যাপার। শুধু মাত্র ছেলেকে নিয়ে নয়টি, আপনার মেয়েটি ও যদি একটি ভুলভাল ছেলের পাল্লায় পড়ে যায়,তাহলে সেই ভুলের চোরাবালিতে তার সায়াটা জীবন তলিয়ে যায়, ফিরতে পারে কেউ কেউ,সকলে পারে না, সেই মনের জোর সকলের থাকে না।
আপনাদের সময় মতোই ছেলে/ মেয়েকে নিয়ে বসে গল্পগুজব করুন,কি ধরনের মুভি/ গান এখন জোর ব্যাবসা করেছে এবং কেনো ভালো লেগেছে,জানুন,কোনো রবিবারে বিকেলের স্ন্যাকস টা ছেলে/ মেয়েকে বানাতে বলুন, আপনি সঙ্গে থাকুন সহকারী হিসেবে... আপনার ঝকঝকে কিচেন নোংরা হবে? আপনাকেই পরিস্কার করতে হবে? একদিন না হয় একটু বেশিই খাটলেন, কিন্তু ছেলের হাতের গন্ধরাজ মোমো বা মেয়ের হাতের ইনস্ট্যান্ট চকো মাফিন/ হানি চিলি সয়া বলস খেতে খেতে ওইটুকু খাটনি নিমেষেই ভুলে যাবেন। খেতে খেতেই কলেজে কোন নতুন বন্ধু/ বান্ধবী হয়েছে কিনা, তাদের নামধাম কায়দা করে জেনে নিন। ছেলে/ মেয়ে কোন কোন বন্ধু/ বান্ধবীদের বাড়ি মাঝেমধ্যেই যাচ্ছে, খেয়াল করুন। আপনার ছুটি খাটায় তাদের কয়েকজন কে বাড়িতে ডাকুন, নিজের হাতেই কিছু বানিয়ে খাওয়ান। মায়ের হাতের খাবার খেয়ে বন্ধু/ বান্ধবীরা প্রশংসা করছে,এটা আপনার সন্তানের কাছে খুবই আনন্দের,গর্বের। আপনিও যোগ দিন ওদের গল্পে,গান বাজনা, আবৃত্তি,গল্পপাঠ এসব ও চলুক... ওদের রুচি সম্পর্কে একটা ধারণা হবে আপনার।
স্কুলের PTM ( Parents Teacher Meeting)এ অবশ্যই যাবেন আপনি বা আপনার হাসব্যান্ড... সম্ভব হলে দুজনেই। আপনাদের দুজনের কাছেই যে ও কতটা গুরুত্বপূর্ণ.. সেটা বোঝা ওর জন্য খুবই দরকারি। ছেলে বা মেয়ে সম্পর্কে অনেক তথ্য আপনি ওর টিচার দের থেকেই জানতে পারবেন। Weekly/ Monthly test গুলোর কোনোটাতে কম নম্বর হতেই পারে,কারণটা না জেনে অযথা বকাবকি/ মারধর করবেন না এমন কিছু বলবেন না,যেটা ওর ট্রমার কারণ হতে পারে। ধৈর্য ধরে ওর পাশে থাকুন একজন বন্ধুর মতো। বাবা ও মায়ের মতো করে সন্তান কে কেউই বোঝে না,একথা সর্বৈব সত্য।
একজন বাবা ও মা বড়ো হতে থাকা সন্তানের প্রথম রোল মডেল.. যাদের সামনে থেকে দেখে সে বড়ো হচ্ছে... আপনাদের ব্যক্তিগত সমস্যা/ মনোমালিন্য এবং অনিয়মিত লাইফ স্টাইল ওর উপরে সুদীর্ঘ খারাপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সেগুলো অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে মা ও বাবাকে। সন্তানের সামনে তার মায়ের গায়ে হাত তোলা বা অহেতুক সন্দেহপ্রবণতা সেই সন্তানের সঙ্গে অনেকটা দূরত্ব তৈরি করে একটা অপরাধ প্রবণতার জন্ম দেয়। তাই যা করবেন ভেবে করবেন।
আরেকটি সমস্যা হোলো এখনকার ছোট্ট নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। ঠাকুমা,দিদার বা অন্যান্য গুরুজনদের সান্নিধ্য না পাওয়া। এঁদের সাহচর্য একটি শিশুর মানসিক বিকাশে অনেক খানি সাহায্য করে। আমি নিজে বড়ো হয়েছি দাদু বাড়িতে, বিরাট এক সংসারে, সেখানে অনেক মানুষের উপস্থিতি আমাকে ভরিয়ে রেখেছে বরাবর। যদি দিদা - দাদু/ ঠাকুমা - দাদু শহরতলী/ গ্রামে/ অন্য জায়গায় থাকেন,তাদের কাছে আপনারা যান সন্তান সহ। দেখবেন ওদের মনের সব জমানো কথা প্রাণোচ্ছল ঝর্ণার স্রোতের মতো বেরিয়ে আসছে, অনেক কথা আপনিও জানেন না,সেকথা দিদুন/ ঠাম ঠিক জেনে নিয়েছে। আর ওই মানুষগুলোর খুশি... আনন্দ এযে উপরি পাওনা!
স্কুলে তো সেভাবে যৌন শিক্ষার পাঠ দেওয়া হয় না... ওরা সে বিষয় পড়তে পড়তেই অনেকটা জেনে ফেলে। আপনি আপনার ক্লাস এইট/ নাইনের ছেলে বা মেয়েটির সঙ্গে গল্পের মতো করে বোঝান,যতটা পারেন। কিভাবে বয়: সন্ধিতে মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন হয়, ছেলেদের কি ধরনের পরিবর্তন হয়... গলার স্বর ভঙ্গ হয়,সবটাই বলুন। মেয়ের পিরিয়ড হলে এটা ছুঁবি না,ওটা করবি না বা ভাই/ দাদাকে দিয়ে কখনো স্যানিটারি ন্যাপকিন আনাবি না এই ধরনের ট্যাবু থেকে বেরিয়ে আসুন। এটা স্বাভাবিক একটা বিষয় যেটাকে অযথা আমরা জটিল করে ফেলি।
সাপ্তাহিক বাজার টা আপনার কিশোর ছেলে/ মেয়েকে দিয়ে করান,আপনি ফর্দ করে দিন... দেখুন একদিনে না হলেও ও ঠিক লাউ - চালকুমড়োর পার্থক্য বুঝতে পারবে, পুঁইশাক - কলমি শাককে আলাদা করতে পারবে, আপনার পছন্দের বাজার ও ঠিকমতোই করে আনবে... রেস্টুরেন্টে গিয়ে মাঝেমধ্যে ওদের মেনু পছন্দ করার দায়িত্ব দিন... কে বলতে পারে যেগুলো আপনি ভাবছিলেন সেগুলোই ওরা অর্ডার দিলো। লং ট্যুর/ শর্ট ট্যুরে যাবেন ঠিক করেছেন? আপনার কিশোর/ কিশোরী ছেলে/ মেয়েকে আপনার সম্ভাব্য বাজেট আর ক' দিনের জন্য যাচ্ছেন জানান আর অবাক হয়ে দেখুন কি চমৎকার প্ল্যান ওরা বানায়।
আসলে আমরা ছোট থেকেই সন্তানদের একটা টার্গেট দেখিয়ে দিই... আমরা স্বপ্ন দেখি ক্লাসে প্রথম হবে, আঁকা,খেলা,গান, আবৃত্তি, সাঁতারে তুখোড় হবে... দুর্দান্ত সপ্রতিভ হবে... সবকিছুতে তার এক নম্বর জায়গা পাকা করতে গিয়ে আত্মীয় পরিজন, পরিচিত প্রতিবেশী সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ বিছিন্ন করে একটা আলাদা দ্বীপের বাসিন্দা করে ফেলি,প্রকৃত জীবনের বাস্তব শিক্ষাটা দিতেই ভুলে যাই, কখনও কখনও পরিবার সমাজের চোখে তাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে তার অপরাধ গুলো স্নেহবশত গোপন করতে করতে তাকে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী বানিয়ে ফেলি। তাই আসুন,যা হয়ে গেছে সেগুলো হয়তো আর ফিরে আসবে না... আপনি আমিই পারবো, আমাদের সন্তানকে অপরাধী না বানিয়ে একজন মানবিক ' মান ও হুঁশ ' সম্পন্ন মানুষ করে গড়ে তুলতে।
এখন ও সময় আছে...
আসুন সবাই বিষয়টিকে গভীর ভাবে ভেবে দেখি।
প্রতিটি মানুষের কাছে তার সন্তানই শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
একজন মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে...
©নীতা
#সংগৃহীত
゚
#অনুগল্প
সংগৃহীত