04/10/2025
পুরাকীর্তির জন্য হুগলির দশঘরা গ্রামকে বলা হয় ‘বাংলার বিষ্ণুপুর’
হুগলি জেলার ধনিয়াখালী থানার অন্তর্গত একটি বিখ্যাত গ্রাম দশঘরা। হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে ধনিয়াখালী বা গুড়াপ রেলস্টেশন অথবা হাওড়া-গোঘাট মেইন লাইনে তারকেশ্বর রেলস্টেশন থেকে বাস বা ট্রেকারে দশঘরায় যাওয়া যায়। কথিত আছে, এই গ্রামটি বারদুয়োরি রাজ্যের রাজধানী ছিল। এই বারদুয়োরি রাজবংশের বংশধরদের এখন আর এই গ্রামে দেখতে পাওয়া যায় না। বহুকাল গ্রামটি ছিল বন-জঙ্গলে ভরা। সুধীরকুমার মিত্র তাঁর ‘হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন– ‘পাল বংশীয় এক কায়স্থ নরপতি দশঘরার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন বলে রজনীকান্ত রায় লিখেছেন। কিন্তু এই রাজবংশের কথা কোনো ইতিহাসে নেই। মেদিনীপুর জেলার ধারেন্দা রাজবংশের পূর্বপুরুষ নারায়ণচন্দ্র পালচৌধুরী মুসলমানদের অত্যাচারে দশঘরা ত্যাগ করে মেদিনীপুরে জমিদারি সানন্দে গ্রহণ করেন। দশটি ছোটো ছোটো গ্রাম নিয়ে গঠিত হয়েছিল বলে এর নাম হয় দশঘরা। এই দশটি গ্রাম এখন বর্তমান। গ্রামগুলো হল শ্রীকৃষ্ণপুর, জাড়গ্রাম, দিঘরা, আগলাপুর, শ্রীরামপুর, ইছাপুর, গোপীনগর, গঙ্গেশনগর, পারাম্বো ও নলথোবা। দশঘরা বলে একটি পৃথক মৌজা থাকলেও সরকারি গ্রন্থে উল্লেখিত একটি গ্রামকেই দশঘরা বলা হয়”। এদিকে হুগলি ডিস্ট্রিক্ট গেজেটারে বলা হয়েছে,
মুঘল আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজারা মহামূল্যবান মোহর-রত্ন সামগ্রী দিঘির জলের নিচে লুকিয়ে রাখত বলে এর নাম হয়েছে দশঘরা। মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে দশঘরা থেকে কিছু দূরে চকদিঘি গ্রামে অবস্থান করেছিলেন বলে জানা যায়।
এই গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কানা নদী। এই কানা নদীটি হল গোদাবরী নদীর একটি শাখা বা মরা নদী। এই নদীর পাশেই বিশ্বাস ও রায় পাড়ায় রাজাদের বাসস্থান। প্রাচীনকালে বিদেশি বণিকরা এই নদী পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। বর্তমানে এই নদীর জল প্রায় সময়েই শুকিয়ে যায়। দশঘরা গ্রাম হয়ে ধনিয়াখালীর দিকে যেতে একটা গ্রাম পড়বে। সেই গ্রামের নাম কানা নদী গ্রাম। গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আদিবাসীদের বাসস্থান ছিল। ঐতিহ্যময় মন্দিরের শহর হল দশঘরা। দশঘরাকে বলা হয়ে থাকে ‘বাংলার বিষ্ণুপুর’। এমনকি ‘টেরাকোটার শিল্প’ও বলা হয় এই গ্রামকে। এই গ্রামে পুরাকীর্তির নির্দশন সর্ষে দানার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এই গ্রামের বাইরে বেশ কিছু জায়গায় পুরাকীর্তির চিত্র দেখতে পাওয়া যায়, যেমন– আঁটপুর, দ্বারহাট্টা, রাজবলহাট, ভাঙামোড়া, ভান্ডারহাটি, বৈকুণ্ঠপুর, সোয়ালুক ও দেউলপাড়া। গ্রামের সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায় বিশ্বাস পাড়ায় গোপীনাথ মন্দির, রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ, চণ্ডীমণ্ডপ, শিবমন্দির, নহবতখানা, গোপীসাগর, কাছারি বাড়ি, বিশালক্ষী জোড়বাংলা মন্দির এবং রায় পাড়ায় শিবমন্দির, ঘড়ির টাওয়ার, বড় খিলান গেট, রায় বাড়ির নাচঘর, সিংহ দুয়ার, ব্রাডলি বার্ট বাংলো, বিপিনকৃষ্ণ রায়ের ম্যানশন বাগান ও চ্যারিটেবল ডিসপেনশনারি ইত্যাদি। মন্দিরগুলি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হুগলি জেলার বৃহত্তম রথ কিন্তু দেখতে পাওয়া যাবে এই দশঘরা গ্রামেই। যেটি বিশ্বাসদের দ্বারা পরিচালিত রথ।