19/05/2022
১৯৬১ ইংরাজি। বরাক-কুশিয়ারা-ধলেশ্বরী নদী তীরের আকাশে বাতাসে ‘বাংলাভাষা জিন্দাবাদ’, ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা’ – ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠল চারদিক। আবালবৃদ্ধবনিতা পথে বেরিয়ে এলেন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা এবং রাজ্যের শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার দাবিতে।
এলো ঐতিহাসিক ১৯ মে। সেদিন কাছাড়ের ত্রিশ লক্ষ মানুষের রাতের ঘুম যেন কেড়ে নিয়েছিল কেউ। সমগ্র উপত্যকা জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি। ভোর থেকে শিলচর- করিমগঞ্জ- হাইলাকান্দি শহর তথা গ্রাম-গঞ্জের হাজার হাজার মানুষ ট্রেনের চাকা বন্ধ করে দিলেন, বিমানের পাখা নড়ল না, স্কুল-কলেজ বন্ধ রইল, অফিস আদালতের তালা খুলল না। রেল লাইনের উপর শুয়ে পড়লেন তরুণতরুণীরা। সত্যাগ্রহীদের উপর তখন পুলিশের বুটের আঘাত, টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার কুন্ডলী আর বেধড়ক লাঠির ঘায়ে রক্তাক্ত হয়ে উঠল বরাক-কুশিয়ারা-ধলেশ্বরীর মাটি। তবুও আন্দোলনকারীরা অটল অনড় হয়ে পড়ে রইলেন। জেলে তখন আর জায়গা হচ্ছে না, গ্রাম-শহরের হাসপাতালে ঠাঁই নেই- বরাক উপত্যকার মানুষের সংগ্রামী চেতনার কাছে পরাস্ত হয়ে শাসকগোষ্ঠীর পুলিশ বাহিনী আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে। মধ্য আকাশের সূর্য তখন কিছু পশ্চিমের পথে পা বাড়িয়েছে– দুপুর দুটো বেজে দশ। পর পর গুলির শব্দে কেঁপে উঠল শিলচর রেলস্টেশনের চারদিক। বৃষ্টির মত ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেরিয়ে এলো বন্দুকের নল থেকে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকল ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাভাষা জিন্দাবাদ’। রক্তের বন্যায় ভেসে গেল শিলচরের রেল প্ল্যাটফর্ম। এগারোটি তাজা প্রাণ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। স্বাধীন ভারতবর্ষে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে দশটি যুবক ও একটি যুবতী তাদের বুক পেতে দিয়েছিল বন্দুকের নলের সামনে।
মৃত দেহ পরে রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, ছিন্নবিচ্ছিন্ন শব চেনা যাচ্ছেনা সব ভালো করে। হঠাৎ যেন তখন এক সুর ভেসে এলো কোথা থেকে, করে দিয়ে গেল জ্যান্ত সকল লাশকে শুধু একটি গানে -
"আমি বাংলায় গান গাই,
আমি বাংলার গান গাই।
আমি আমার আমিকে চিরদিন,
এই বাংলায় খুঁজে পাই।।
‘এখানকার বাঙালী যে স্থানগত ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও, ঘরে বাইরে সর্বত্র নিজেদের ভাষা-শিল্প-সংস্কৃতির গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছেন, ইতিহাসে এ দৃষ্টান্ত বিরল। শুধু মুখের ভাষায় নয়, বুকের অনুভূতি দিয়েই বরাকের বাঙালী বিশ্বাস করে ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি! বাংলাভাষা।’ আশির দশকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ‘বঙাল খেদা’ আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত কবিতায় তাই কবি যেমন প্রতিস্পর্ধী, মাতৃভাষার গৌরবে তেমনি স্ফীতবক্ষ –
সাতটি ভাই চম্পা, আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল; এই যে ঈশান কোন
কোন ভাষাতে হাসি কাঁদি, কান পেতে তা শোন
শুনলি না? ঐ কুচক্রীদের ছা’
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা
বাংলা আমার মাতৃভাষা; ঈশান বাংলা মা!