11/06/2025
“কানাই দা’র কাব্যকাণ্ড”
আমাদের গ্রামের নাম শীতলপুর। নাম শুনেই বুঝতে পারছো, খুবই শান্ত একটা গ্রাম। না, এখানে পাখি কিচিরমিচির করে, মাঠে সর্ষে ফুলের গন্ধ ভাসে, আর সন্ধ্যাবেলায় বাচ্চারা খেলাধুলা করে—এসব ঠিকই, কিন্তু আসল মজাটা হল আমাদের গ্রামের কানাই দা।
কানাই দা মানে কানাই চক্রবর্তী। বয়স আন্দাজ পঁইত্রিশ-ছত্রিশ, কিন্তু মনটা যেন আঠারোতেই আটকে আছে। সারাক্ষণ গালে একটা হাসি, পকেটে কলম, আর হাতে একটা মোটা খাতা—যেটাকে উনি বলেন “কাব্যজঞ্জাল”।
আমরা ওকে নিয়ে যেমন হাসি, তেমন ভালবাসিও। কারণ কানাই দা এমন একটা চরিত্র, যাকে ছাড়া শীতলপুরের দিনই যেন শুরু হয় না। কিন্তু একদিন এমন এক কান্ড করে বসলেন কানাই দা, যে গল্পটা আজও আমরা চা-স্টলে বসে হেসে হেসে বলি।
একটা সকাল, আর একটা কবিতা
সেদিন ছিল রবিবার। গ্রামের সবাই একটু আলসেমি করে। কিন্তু কানাই দা সকাল সাতটায় গাঁয়ের মোড়ে এসে হাজির। হাতে তাঁর সেই খাতা, চোখে জ্বলজ্বলে একরাশ স্বপ্ন।
— “তোমরা জানো তো, আমি এইবার কবিতার প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছি। কলকাতা থেকে এক ম্যাগাজিন ‘চোখে জল, মনে কবিতা’ এই প্রতিযোগিতা রাখছে। বিজয়ী পাবে নগদ দশ হাজার টাকা আর একখানা পদক!”
আমরা সবাই তো হাঁ! কানাই দা কলকাতায় কবিতা পাঠাবেন? ব্যাপারটা ভাবতেই হাসি পায়, আবার মনের ভেতর কোথাও একটু গর্বও লাগে।
— “শুনবি? আমার লেখা কবিতা?” — বলতে বলতে কানাই দা খাতা খুললেন।
আমরা ভয়ে ভয়ে বললাম, “বলি শুনি।”
তিনি পড়লেন—
"তোমার চোখে দেখেছিলাম সূর্যাস্তের স্বপ্ন,
আমার বুকে জেগেছিল এক জলজ পাখি।
তুমি গেলে, রইল শুধু বিস্কুট আর কফি।"
চা মুখে নিয়ে গিলতে গিয়ে আমি প্রায় দমে গেলাম! হাসিটা চাপা দিচ্ছি, কিন্তু পাশের শ্যামলদা কাশতে কাশতে পড়ে যেতে বসেছে।
— “এইটা তো প্রেমের কবিতা, না কি ব্রেকফাস্টের মেনু?” — কুটকুটে মন্তব্য করল নির্মল।
কানাই দা গম্ভীর হয়ে বললেন, “কবিতা সবাই বোঝে না ভাই। অনুভব লাগে।”
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, আর ঠিক করলাম—একবার ওঁর লেখা কলকাতায় পাঠানো হোক, তারপর দেখা যাবে।
মেয়েদের মায়া আর চিঠির ছলনা
এর কিছুদিন পর কানাই দা হঠাৎ করে আরও সিরিয়াস হয়ে গেলেন। আমাদের জানালেন যে, ম্যাগাজিন থেকে উত্তর এসেছে—কবিতা মনোনীত হয়েছে!
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, সম্পাদক স্বয়ং চিঠি লিখেছেন—“আপনার কবিতায় গভীর জীবনদর্শন আছে, দয়া করে কলকাতায় এসে পুরস্কার গ্রহণ করুন।”
আমরা তো পুরাই হ্যাবাক! কানাই দা জিতেই গেল?
সে যাই হোক, কানাই দা তো তৈরি। নতুন পাঞ্জাবি সেলাই করালেন, চটি পাল্টে জুতো কিনলেন। কিন্তু যাওয়ার আগের রাতে, যেটা ঘটল, সেটাই আসল মজার!
গ্রামের একমাত্র পোস্ট অফিসে কাজ করে বিনোদ কাকা। উনি সন্ধ্যায় চুপচাপ আমাকে আর নির্মলকে ডাকলেন।
— “এই যে, দেখো। চিঠিটা কে লিখেছে জানো?”
চিঠির নিচে লেখা নামটা স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু হাতের লেখা আমাদের খুব চেনা। নির্মল চিৎকার করে উঠল—
— “এই তো আমাদের গোপাল! সেই গোপাল যেটা এককালে কানাই দা’র প্রেমে পড়েছিল, তারপর কলকাতায় গিয়ে স্কুলে চাকরি পেয়েছে!”
বুঝে গেলাম, গোপাল মজা করেছে। কানাই দা’র কবিতার কোনো প্রতিযোগিতা নেই, সবটাই সাজানো নাটক। মেয়েটি মজা করে বানানো চিঠি পাঠিয়েছে, আর কানাই দা সেটাই সত্যি ধরে নিয়েছেন।
তখন আমরা একটা পরিকল্পনা করলাম।
কলকাতা অভিযান আর নাটকের রিহার্সাল
পরদিন সকালে কানাই দা গলায় গামছা ঝুলিয়ে, জুতো পরে, চোখে রোদচশমা লাগিয়ে রওনা হলেন কলকাতার দিকে।
আর আমরা চারজন—আমি, নির্মল, শ্যামল আর বিনোদ কাকা—ট্রেনে উঠলাম কানাই দার পিছনে। উদ্দেশ্য একটাই—ওকে না বুঝতে দিয়ে নাটকটা জমিয়ে তোলা!
কলকাতায় পৌঁছে আমরা গোপালের সাথে যোগাযোগ করলাম। সে তো পেট ধরে হাসছে, কিন্তু রাজি হয়ে গেল নাটক করতে। একটা ছোট্ট হলে ‘পুরস্কার বিতরণী’ নাটক সাজানো হল। কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে আমরা ঠিক করলাম, ওকে একটা ‘মেকি’ পদক আর মাইক্রোফোনে একটু নাটকীয় প্রশংসা করব।
পুরস্কারের মুহূর্ত
বেলা তিনটেয় ‘অনুষ্ঠান’ শুরু হল। কানাই দা তখন স্টেজে উঠে গেছেন। তার চোখেমুখে এক অপূর্ব গর্ব, যেন কবিতার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং।
গোপাল স্টেজে এল, একটা খালি ডিভিডি বাক্সে একটা গ্লিটার পেপার মুড়ে হাতে ধরিয়ে বলল, “এই পুরস্কার পেয়ে আপনি আমাদের সকলকে ধন্য করলেন।”
কানাই দা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “এই পুরস্কার শুধু আমার নয়, শীতলপুরের প্রতিটি পাখি, প্রতিটি চা-ওয়ালার!”
সবার হেসে পেট ফেটে যায়। কিন্তু আমরা থামি না। নাটকটা এত সুন্দর করে জমে উঠল যে কানাই দা কিছু বুঝতেই পারলেন না।
মধুর উপসংহার
গ্রামে ফিরে আসার পর আমরা সব খুলে বললাম। ভেবেছিলাম ও ভীষণ রেগে যাবে। কিন্তু কানাই দা একবার ওর খাতাটা খুলে, একটা নতুন কবিতা পড়ে শোনাল—
“যারা করে ঠাট্টা, তারাও কবিতা বোঝে,
বন্ধুত্বের ছলে, যে কাঁদে-হাসে—
তারাই আমার সত্যিকারের পাঠক।"
আমরা স্তব্ধ। তারপর সবাই মিলে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। সে দিনটা যেন আমাদের জীবনের অন্যতম মধুর মুহূর্ত।
শেষ কথা
আজও কানাই দা সেই খাতা হাতে কবিতা লেখে। আর আমরা বলি, “দা, আবার কফি-বিস্কুট কবিতা শোনাও!”
ও হাসে, বলে, “এবার লিখছি প্রেম নয়, বৃষ্টি নিয়ে!”
এভাবেই চলতে থাকে আমাদের শীতলপুর, কানাই দা’র কবিতার মজা, আর বন্ধুত্বের রঙিন কাণ্ডকারখানা।