05/07/2025
রাজদীঘি: এক অজানা ইতিহাসের পদচিহ্ন
পড়ন্ত বিকেলে রাজদীঘির শান্ত পাড়ে দাঁড়িয়ে আমি অতীতের এক অজানা ইতিহাসের গন্ধ অনুভব করি। মানুষ হিসেবে আমাদের চিরন্তন অনুসন্ধিৎসু মন সবসময়ই নতুন দিগন্তের সন্ধানে ছোটে। বর্তমান যুগে যখন মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের চিন্তা চলছে, তখনও আমরা পিছন ফিরে তাকাই, কারণ ইতিহাস আমাদের সতর্ক করে, দেখিয়ে দেয় ধ্বংসের পথ। ডাইনোসরদের বিলুপ্তি কিংবা গভীর সমুদ্রের রহস্যময় জীবন—প্রতিটি অনুসন্ধানই আমাদের শেখায় অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই আধুনিক যুগে আমরা যখন জটিল সমস্যার সমাধান মুহূর্তেই করে ফেলছি, তখন কিছু অজানা ইতিহাস তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। তেমনই এক গল্প আজ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরব, আমার নিজের গ্রামের বুকে লুকিয়ে থাকা এক বিশাল জলাশয়, রাজদীঘির গল্প।
আমাদের গ্রামে রয়েছে এক সুবিশাল পুকুর, যার আয়তন অন্তত ছয়টি ফুটবল মাঠের সমান। বর্তমান সময়ে এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু কে বা কারা কবে এই পুষ্করিণী খনন করেছিলেন, সে ইতিহাস আজও অজানা। প্রায় ৩০০ বছর আগে যখন মানুষ বন কেটে বসতি স্থাপন করছিল, তখন পাশাপাশি দুটি পুকুর আবিষ্কৃত হয়—একটি বড় এবং একটি ছোট। মানুষ অনুমান করে নেয় যে, কোনো এককালে এখানে কোনো রাজা বসবাস করতেন। বড় পুষ্করিণীটির নাম দেওয়া হয় রাজার দীঘি বা রাজদীঘি, আর ছোটটি রাণীর দীঘি নামে পরিচিতি পায়।
রাজদীঘি গত প্রায় ৩০ বছর ধরে সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকলেও, দুঃখজনকভাবে রাণীর দীঘিটি বেদখল হয়ে একসময় বিলীন হয়ে যায়। গ্রামের প্রবীণ নাগরিকদের মুখে শোনা যায়, তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে এই পুকুরগুলো আবিষ্কারের কথা শুনেছেন। তাঁদের বয়সেও এই পুকুর দুটির খননকর্তা বা খননের সময়কাল সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। প্রবীণরা আরও উল্লেখ করেন যে, অতীতে ভূতের ভয়ে এই পুকুরের ধারেকাছে কেউ ঘেঁষত না। পদ্মবনে ঢাকা পুকুর দুটিকে ঘিরে নানা গুজব প্রচলিত ছিল। আমি নিজেও ছোটবেলায় এই পুকুরের পদ্মবন দেখেছি, কিন্তু ভয়ে কখনও তার পাড় মাড়াইনি।
সরকার রাজদীঘির দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে এর সংস্কার করে। পরবর্তীতে উন্নত মানের মাছের পোনা উৎপাদন এবং মাছ চাষের প্রশিক্ষণের জন্য এটিকে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। তবে, সরকারের হাতে যাওয়ার পর এই পুকুরটি থেকে কী লাভ হয়েছে, তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। বাহ্যিকভাবে দেখে মনে হয়, এখানে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নামে যে সমস্ত কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলোতে চরম দুর্নীতি হয়েছে। ঘরগুলো কোনোটি সম্পূর্ণ, কোনোটি অর্ধ-সমাপ্ত; কোনোটির চাল ঝড়ে উড়ে গেছে, কোনোটির অর্ধেক অংশ কবে ঝড়ে ভূপতিত হয়েছে, আর সংস্কার হয়নি। কাগজপত্রে সাতজন কর্মচারী থাকলেও, বাস্তবে পাওয়া যায় মাত্র একজনকে।
তবে, এই রাজদীঘি এবং রাণীর দীঘি শুধু দুটি পুকুর নয়, বরং এরা এখানে এককালে মানব সভ্যতার অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। কারা ছিলেন এই মানুষগুলো? কখন তাঁরা এখানে বাস করতেন? তাঁরা কোথায় গেলেন? কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই জাতি সমূলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, নাকি তাঁরা এই স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন? যারা এই পুকুরগুলো খনন করেছিলেন, তাঁদের কী হয়েছিল?
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সংশ্লিষ্ট এলাকার কিছু জায়গায় মাটি খনন করতে গেলে কিছু গভীরে পুরনো পোড়ামাটির বাসনের টুকরো পাওয়া যায়। এই মৃৎপাত্রের টুকরোগুলো আরও একবার প্রশ্ন তোলে: এখানে কারা ছিলেন? কখন তাঁরা ছিলেন? সকলে কি একসঙ্গে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলেন?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও রহস্যের আড়ালে রয়ে গেছে। রাজদীঘি যেন এক নীরব সাক্ষী, যা তার বুকে ধারণ করে আছে এক অজানা ইতিহাস। এই ইতিহাস আমাদের আহ্বান জানায়, আরও গভীরে অনুসন্ধান করার, এই বিলুপ্ত সভ্যতার পদচিহ্ন খুঁজে বের করার। হয়তো একদিন এই রাজদীঘিই তার দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে তার গর্ভে লুকিয়ে থাকা সকল রহস্য উন্মোচন করবে।