09/08/2025
রাখী বন্ধন উৎসবের সম্পূর্ণ ইতিহাস
➡️ রাখী বন্ধন বা রাখী পূর্ণিমা হলো ভাই-বোনের ভালোবাসার এক পবিত্র উৎসব। এটি শুধু ভাই-বোনের সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সৌভ্রাতৃত্ব, সংহতি এবং পারস্পরিক সুরক্ষার প্রতীক হিসেবেও এই উৎসব পালিত হয়। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব উদযাপিত হয়। 'রাক্ষা' শব্দের অর্থ রক্ষা করা এবং 'বন্ধন' শব্দের অর্থ বাঁধা, অর্থাৎ এই উৎসব সুরক্ষার বন্ধনকে বোঝায়।
পৌরাণিক ইতিহাস –
রাখী বন্ধন উৎসবের উৎপত্তির পেছনে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে:
কৃষ্ণ ও দ্রৌপদী: মহাভারত অনুসারে, একবার শ্রীকৃষ্ণের হাতের কবজিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে পাণ্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদী নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। দ্রৌপদীর এই ভালোবাসায় অভিভূত হয়ে কৃষ্ণ তাঁকে নিজের বোন হিসেবে ঘোষণা করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি দ্রৌপদীকে সর্বদা রক্ষা করবেন। বহু বছর পর যখন কৌরবরা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে চেয়েছিল, তখন কৃষ্ণ অলৌকিকভাবে তাঁর সম্মান রক্ষা করে সেই প্রতিদান দেন। এই ঘটনাটি রাখী বন্ধনের অন্যতম জনপ্রিয় উৎস।
দেবী লক্ষ্মী ও রাজা বলি: আরেকটি গল্প অনুযায়ী, দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বালির রাজ্য রক্ষা করতে তাঁর দ্বারী হয়ে থাকতেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পেতে এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিকে বলেন যে তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ এবং যতদিন না তিনি ফিরে আসেন, ততদিন বলি যেন তাঁকে আশ্রয় দেন। বলিরাজা ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দিতে রাজি হন। শ্রাবণ পূর্ণিমার দিনে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলি কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী নিজের আসল পরিচয় দেন এবং বিষ্ণুকে ফিরে পাওয়ার কথা বলেন। লক্ষ্মীর এই আবেদনে বলি মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। এই ঘটনা থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিতে রাখী বন্ধন পালনের প্রচলন হয়।
ইন্দ্র ও শচী: প্রাচীনকালে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের কাছে পরাজিত হচ্ছিলেন। তখন ইন্দ্রের স্ত্রী শচী বিষ্ণুর পরামর্শে একটি পবিত্র সুতো ইন্দ্রের হাতে বেঁধে দেন, যা ইন্দ্রকে যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করে। এটিও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে রাখী বন্ধনের প্রাচীনতম নিদর্শনগুলির একটি।
যম ও যমুনা: যমদেব তাঁর বোন যমুনার সাথে দীর্ঘ ১২ বছর দেখা করেননি। এরপর গঙ্গা তাঁকে যমুনার সাথে দেখা করার কথা মনে করিয়ে দিলে যম যমুনার কাছে যান। যমুনা ভাইকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তাঁর হাতে রাখী বেঁধে দেন। এতে যম এতই মুগ্ধ হন যে তিনি যমুনাকে অমরত্বের বর দেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট –
রাখী বন্ধন শুধু পৌরাণিক কাহিনীতেই সীমাবদ্ধ নয়, এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে:
আলেকজান্ডার ও রাজা পুরু: ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেন, তখন তাঁর স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো (রাখী) পাঠিয়ে অনুরোধ করেন যেন তিনি আলেকজান্ডারকে আঘাত না করেন। রাজা পুরু সেই রাখীর সম্মান রেখেছিলেন এবং আলেকজান্ডারকে হত্যা করেননি।
রানী কর্ণাবতী ও সম্রাট হুমায়ুন: ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে চিতোরের রানী কর্ণাবতী মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেন। যদিও হুমায়ুন সাহায্য পাঠাতে দেরি করেন এবং চিতোর রক্ষা করা সম্ভব হয়নি, তবুও এই ঘটনাটি রাখীর মাধ্যমে স্থাপিত সম্পর্কের ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রমাণ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান –
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করেন, তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ রাখী বন্ধন উৎসবকে ব্যবহার করেন। তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এই উৎসব পালনের আহ্বান জানান। রবীন্দ্রনাথের ডাকে হাজার হাজার মানুষ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একে অপরের হাতে রাখী বেঁধে সংহতির বার্তা দেন। এটি রাখী বন্ধন উৎসবের আধুনিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, যা উৎসবটিকে শুধু পারিবারিক বন্ধন নয়, সামাজিক ও জাতীয় সংহতির প্রতীক হিসেবেও তুলে ধরে।
তাৎপর্য –
রাখী বন্ধন উৎসবের মূল তাৎপর্য হলো ভালোবাসা, সুরক্ষা এবং পারস্পরিক নির্ভরতার বন্ধন। এই দিনে বোনেরা ভাইয়ের হাতে রাখী বেঁধে তাঁদের দীর্ঘায়ু, সমৃদ্ধি ও মঙ্গলের প্রার্থনা করে। বিনিময়ে ভাইয়েরা বোনদের আজীবন রক্ষা করার এবং যেকোনো বিপদ থেকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এই উৎসব রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও বন্ধুত্বের সম্পর্ক এবং সামাজিক সংহতির প্রতীক হিসেবেও পালিত হয়। এটি কেবল একটি সুতো বাঁধা নয়, এটি এক পবিত্র প্রতিশ্রুতি, যা সম্পর্ককে আরও দৃঢ় ও মধুর করে তোলে।
#ভালোবাসারগ্ৰামসিমলাপাল