14/03/2025
শ্রীকৃষ্ণের আলোকে শ্রীচৈতন্য:
সব্যসাচী
শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য দুজনেই এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। এই অনন্যতার প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো এরা দুজনেই এসেছিলেন অতীতে। কিন্তু আসলে এরা ভবিষ্যতের। এখনো কোন সময়কাল আসেনি, যা এদের সমসাময়িক হতে পারে। এরা দুজনেই সব সময় 'নতুন মানুষ"। এদের জীবনবোধ, সত্যবোধ জীবনযাত্রা সবসময় out of the box. দুজনেই জীবনে প্রত্যেক পর্যায়ে convention ভেঙে দিয়েছেন। দুজনেই সমাজের সংস্কারবদ্ধতা, বিভেদ ভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। কোথাও নিষ্প্রাণ ধার্মিকতার বিরুদ্ধে মানুষের জয় গান গেয়েছেন। কখনো মানুষের সাংসারিক সামাজিক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে ধর্মের সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য। দুজনেই সব সময় নতুন মানুষ। প্রতিটি যুগেই তারা নতুন।
যুগের পর যুগ ধরে, অনাদিকাল ধরে সভ্যতা দুটি ( পরস্পর বিরোধী) আইডিয়া নিয়ে চলেছে।
হয়, আত্মা ( ব্রহ্ম, ঈশ্বর) সত্য। শরীর এবং বস্তু জগত মায়া বা মিথ্যা।
অথবা, শরীর এবং বস্তু জগত একমাত্র বাস্তব। আত্মা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। ভ্রম।
প্রায় সব যুগেই, সমগ্র পৃথিবীতে অধিকাংশ ধর্মীয় আচার্য, দার্শনিক, চিন্তাবিদরা শারীরিক মানুষকে স্বীকার করতে পারেননি। আবার যখনই জড়বাদ, বস্তুবাদ (অ?)ধর্মের সংস্কার এবং শোষণকে কে পরাজিত করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তখনই মানুষের আত্মা কে চূড়ান্ত অস্বীকার করা হয়েছে।। শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক অস্তিত্বকেই বাস্তব ধরা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই যখন শুধুমাত্র আত্মা কে স্বীকার করে, শরীরকে বা এই সংসারিক জগতকে অস্বীকার করা হয়েছে তখনই আত্মিক উন্নতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে সভ্যতাকে গ্রাস করেছে দারিদ্র, ক্ষুধা, রোগ, ব্যাধি, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, অসচেতনতা, .... যা শেষ পর্যন্ত মানুষের আত্মাকেও কলুষিত করে।
আবার যখনই আত্মা কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মানুষের শারীরিক অস্তিত্বকে ই বাস্তব ধরা হয়েছে তখন পৃথিবীতে বিরাট নগরায়ন হয়েছে। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবনযাত্রা অনেক সুবিধায় ভরে গেছে। জীবনে গতি এসেছে। রোগ ব্যাধি মহামারী থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের ব্যবহারিক জীবন সুখ, অর্থ, সমৃদ্ধিতে ভরে উঠেছে ঠিকই কিন্তু সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছে পুঁজিবাদী শ্রেণী। অর্থনৈতিক শোষণ, সাম্রাজ্যবাদ। মানুষের হৃদয় আবেগ, সমবেদনা, সহমর্মিতা, নৈতিকতা হারিয়ে গেছে। নগরায়নের ফলে প্রকৃতির বিরাট ক্ষতি হয়েছে। মানুষ হয়ে উঠেছে শরীর সর্বস্ব, অথচ প্রেমহীন!!! আত্মবিস্মৃত!!!
শরীরকে, বস্তুজগতকে মায়াবোধে তুচ্ছ করে শুধুমাত্র আত্মিক সত্যের রাস্তা নিয়ে ছিল প্রাচ্য।। যার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল বুদ্ধ, পতঞ্জলি, শংকরাচার্য, মহাবীর, তুলসী দাস, বল্লভ আচার্য, কবির এদের মত সত্যের মহাসাধক। যারা তুরীয় চেতনায় অধিষ্ঠান করেছেন এবং অসংখ্য মানুষকে তার দিশা দেখিয়েছেন। তেমনই একইসঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল সীমাহীন দারিদ্র্য। খাদ্যের হাহাকার। মহামারী। অসংখ্য মানুষের অনাহারে পশুর মত মৃত্যু।
পাশ্চাত্য বস্তুবাদের পথ ধরেছিল। আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিল। ফলে সৃষ্টি হয়েছে অত্যাধুনিক নগর। কারিগরি। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ। মানুষের পার্থিব জীবনের পরম সমৃদ্ধি। এবং যথারীতি সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী শ্রেণীর ক্ষমতার দম্ভ, বলগা হীন সাম্রাজ্যবাদ সেই সঙ্গে হিরোশিমা নাগাসাকি ও। মানুষেরই রক্ত মাংসের উপর মানুষেরই সৌধ অট্টালিকা।
এক আশ্চর্য দ্বন্দ্ব!!! হাজার হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতা এইরকম বিকারগ্রস্তভাবেই চলেছে। মানুষকে পূর্ণভাবে ( totally) কেউ গ্রহণ করেনি। এই দ্বন্দ্বের একমাত্র উত্তর শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রী চৈতন্য।
শ্রীকৃষ্ণ তার জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন মানুষ আত্মা এবং দেহ উভয়ই। মানুষ কদাপি শুধুমাত্র আত্মা নয়। আবার শুধুমাত্র দেহও নয়। মানুষ দেহ এবং আত্মার এক আশ্চর্য ছন্দ। আত্মা বা চৈতন্য সত্বার বাহ্যিক প্রকাশ হয় দেহের মাধ্যমে। দেহেরই অন্তর কেন্দ্র চৈতন্য বা আত্মা। দৈহিক সুখ ভোগ, লীলা-বিলাস, চাহিদা, সাংসারিকতা রাজনীতি যুদ্ধ এসব কোনো কিছুকেই শ্রীকৃষ্ণ অস্বীকার করেননি। অথচ এসবের মধ্যে সত্যের মহিমা কোথায় সেই দিকে সদা সর্বদা দিক নির্দেশ করেছেন।। কামনাকে ( sexuality) শর্তহীন, সংস্কারহীন ভাবে গ্রহণ করে নিষ্কাম প্রেমের চরম উৎকর্ষ দেখিয়েছেন।। তেমনি সাংসারিকতা, ক্ষমতালোভ, রাজনীতি, যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সবকিছুর ঊর্ধ্বে যুগের কাছে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।
শ্রীকৃষ্ণ এমন একজন মানুষ যিনি কাউকে প্রেমের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে বলেছেন , আবার কাউকে হিমালয় কঠোর তপস্যা করতে বলেছেন আবার কাউকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর যুদ্ধ করতে বলেছেন। সেখানে স্বজন এবং পরিবারের লোকজনকেও ক্ষমা করেন নি। তথাকথিত সাংসারিক রাজনৈতিক পারিবারিক জীবন কাটিয়েও তিনি মহাযোগী। ভারতের পরমাত্মা।
শ্রীচৈতন্যের সাধনাই ছিল দেহের মধ্যে দিয়ে দেহাতীত কে স্পর্শ করা। ত্যাগী বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর রূপকল্প তার ছিল না। তিনি শুধু অন্তরে রাধা ভাব নিয়ে তপস্যা করেননি। বহিরাঙ্গেও তিনি রাধা হয়ে কৃষ্ণের দিকে ধেয়ে চলেছেন। কৃষ্ণের প্রতি এই কেন্দ্রাতিগ আকর্ষণ শুধু চেতনা দিয়ে নয়, সমগ্র শরীর দিয়ে গ্রহণ করেছেন ও প্রকাশ করেছেন। কায়ীক প্রেমের রূপকল্প আশ্রয় করে শর্তহীন সংস্কারমুক্ত সর্বগ্রাসী প্রেমের চরম সোপানে পৌঁছেছেন এবং সমগ্র যুগকেই সেই দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে সমাজ পরিবর্তন করেছেন।। ধর্ম শাস্ত্র মতামত জাতি কুল সবকিছু ঊর্ধ্বে প্রেমকে স্থাপন করেছেন। গোটা উপমহাদেশে বহুমুখী প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে ঘটিয়েছেন। দক্ষিণ ভারতে রাজন্যবর্গের মাধ্যমে সভ্যতা সংস্কৃতির, ক্ষত্রিয় শক্তি, মানুষের জীবনের সাংসারিক উন্নতির চরম উৎকর্ষ ঘটিয়েছেন। আরেক দিকে গুরু নানকের মাধ্যমে শিখ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। আবার কখনো শ্রীচৈতন্যের প্রভাব সন্ত তুকারামের মধ্যে দিয়ে শিবাজীর উত্থান ঘটিয়েছে। আরেক দিকে ইসলামী উদার সাধকদের মধ্যে দিয়ে মুঘল বাদশাহ আকবরের চিন্তা পরিবর্তন ঘটিয়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক তথা ধর্মীয় বাতাবরণে বিরাট পরিবর্তন আনেন।। এমন এক প্রেম সাধনার ধারা নিয়ে আসেন যেখানে হিন্দু মুসলমান সহ অসংখ্য সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে চেতনার উত্তরণ ঘটাতে পারে।
শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রী চৈতন্য দুজনেই তাদের সমগ্র জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেলেন আত্মা ও দেহের অপূর্ব এক ছন্দ ই হলো সত্য। পরমাত্মা এবং বস্তু জগত উভয়ের ছন্দবদ্ধতাই হল ঈশ্বরত্ব। সম্পূর্ণতা। সত্য।
প্রাচ্য গৃহস্বামী তৈরি করেছে কিন্তু গৃহ তৈরি করতে পারেনি। পাশ্চাত্য আকাশছোঁয়া অট্টালিকা বানাতে পেরেছে। কিন্তু সেখানে কোন মানুষ বাস করে না।
অভুক্ত হয়ে ধ্যান করা যায় না, আবার ধ্যানহীন মানুষ নিষ্প্রাণ। তাই খাদ্য এবং ধ্যান দুই প্রয়োজন। আমরা একই সঙ্গে আত্মা এবং শরীর। এই নিয়েই আমাদের অস্তিত্ব। কিন্তু মানুষের সমগ্র অস্তিত্বকে আজও গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রী চৈতন্য তাই আজও আমাদের কাছে অধরা। দুজনেই আমাদের সময়কালের থেকে অনেক এগিয়ে আছেন। হয়তো ভবিষ্যতে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য কে আরো বেশি করে ছোঁয়া যাবে।। হয়তো। অথবা কত যুগ লাগবে কে জানে.....
কিন্তু ঘরে ঘরে শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্যের পূজা সমগ্র দেশে হয়ে চলেছে।। কত চর্চা আলোচনা বক্তৃতা হয়ে চলেছে। সম্প্রদায় মঠ মন্দির গড়ে উঠেছে। কিন্তু এই শ্রীকৃষ্ণ এবং এই শ্রীচৈতন্য যে মন্দিরের দেবতা। আমাদের তৈরি করা।। আমাদের মতই। আমরা যেমন বুঝতে চাই, তেমনি।
#শ্রী_চৈতন্য #শ্রীকৃষ্ণ #মুকুন্দপুর_আশ্রম #পারুল_আশ্রম