16/06/2024
আমার বিয়ে হয়েছে দুই মাস হলো। এতদিন আমি এ বাসার রান্নাঘরে ঢুকিনি। আজকে প্রথম কাজ করতে ঢুকলাম। পাশের বিল্ডিংটি আমাদের একদম কাছাকাছি, বলা যায় এক হাত দুরত্ব। আমাদের রান্নাঘরের জানালার সাথে ওই বিল্ডিং এর একটি ফ্লাটের বেডরুম। প্রথম দিন রান্না করতে ঢুকেই দেখলাম পাশের এই ফ্লাটের জানালায় মিষ্টি চেহারার এক মেয়ে, একটা ছোট বাচ্চা, তিন চার বছর বয়সের। আমাকে দেখে হাসলো, জানালায় উঠে এসে বলল,
"কেমন আছো গো নতুন বউ?আমি তোমাদের বিয়েতে গিয়েছিলাম, এতদিন রান্নাঘরে দেখিনি তাই কথা বলতে পারিনি!"
-"ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?"
"ভালো আছি গো! আন্টি কোথায়?"
-"মা তার ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছেন, এইজন্য আমি আসলাম রান্না করতে!"
"বাহ! রান্না পারো তো নাকি?কি নাম তোমার?"
-"জ্বি রান্না পারি। আমার নাম রুমকি। আপনার নাম কি?"
"আমার নাম ঝুমুর। আচ্ছা রান্না করো। কোন দরকার হলে ডাক দিও। আমার শাশুড়ি পছন্দ করেন না আমি বাসার বাইরে যাই বা কারো সাথে মিশি বুঝলে? এইজন্য জানালা দিয়েই কথা হবে। আন্টির সাথেও আমার বেশ কথা হয়।"
-"আচ্ছা। ও আপনার ছেলে? কি নাম ওর? ভারী মিষ্টি দেখতে!"
"হাহা! যেমন মিষ্টি তেমন দুষ্টু। ওর নাম আয়মান।"
-"বাচ্চারা তো একটু দুষ্টু হবেই..!"
এভাবে আস্তে আস্তে ঝুমুরের সাথে আমার সম্পর্ক বাড়ে। একটা মজার ব্যাপার যে আমি আর মা রান্নাঘরে থাকলে ওকে দেখতাম না কখনো। জানালা বন্ধ করে দিত। একদিন জিজ্ঞেস করবো ভেবেছিলাম তবে কেন যেন জিজ্ঞেস করা হয়নি। ভালোই কাটছিলো দিনগুলো। ঝুমুর আমার ফোন নাম্বারও নিয়েছিলো, আমি যখন থেকে রান্নাঘরের নিয়মিত দায়িত্ব নিলাম,সকালে আমার রান্নাঘরে যেতে দেরি হলে ও ফোন করতো। আমি অসুস্থ কি না জিজ্ঞেস করতো।
একদিন আমার শরীরটা বেশ খারাপ ছিলো। সাজ্জাদ মানে আমার স্বামী হঠাৎ রাতে বললো গোস্ত রুটি খাবে। আমি বললাম এত রাতে আমি পারবোনা বানাতে তার উপর আমার শরীর খারাপ। হঠাৎ সাজ্জাদ রেগে আমার মে রে বসলো একটা চ ড়, আমি দাড়িয়ে ছিলাম, ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে পড়ে গেলাম। আর খাটের কোনার লেগে সাথে সাথে কপাল কেটে গেলো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম এই ঘটনায়। বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার গায়ে হাত তুললো সাজ্জাদ এটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পরেরদিন সকালে উঠতে আমার দেরি হলো, দেখি শাশুড়ি আবার তার ভাইয়ের বাসায় গেছেন আর সাজ্জাদ নাস্তার জন্য দেরি না করেই অফিসে গেছে। আমি কপালে গজ, টেপ দিয়ে আস্তে আস্তে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। যেতেই জানালায় ঝুমুরকে বেশ চিন্তিত মুখে দেখলাম। আমাকে দেখেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
"রুমকি, কি হয়েছে?আমি তোমাকে এখনই কল দিতাম!কপালে কি? সাজ্জাদ মেরেছে?"
আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম। আস্তে বললাম,
-"আরেহ না ঝুমুর, আমি গতকাল পিছলে পড়ে যেয়ে খাটের কোনায় লেগে কপাল কেটে গেছে!"
ঝুমুর একটু কড়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বললো,
"রুমকি শোন, সাজ্জাদের আরো একটা বিয়ে হয়েছিলো এর আগে। তুমি হয়তো জানোনা। সেই মেয়েটাকে সাজ্জাদ মে রে মে রে একবারে লাশ বানিয়ে ফেলেছে। ওদের একটা ছেলেও ছিলো। বাচ্চাটাকেও ছাড়েনি এই বদমেজাজি লোকটা। আমি ভেবেছিলাম এবার হয়তো একটু শোধরাবে, ভালো হবে কিন্তু হয়নি। এই মা ছেলে মিলে টাকা দিয়ে কেইস অফ করে দিয়েছে। তারপর সবকিছু লুকিয়ে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছে!"
এক নাগাড়ে এ কথাগুলো বলে ঝুমুর শব্দ করে জানালাটা লাগিয়ে দিলো। আমি কয়েকবার ডাকলাম তবে আর খুললো না জানালা। অন্য রুমের জানালা থেকেও ডাকলাম, কোন সাড়া পেলাম না।
ঝুমুরের এই কথাগুলো আমার মাঝে তোলপাড় করে দিলো। সাজ্জাদ কে জিজ্ঞেস করলাম না কারন বুঝতে পারছিলাম যে সঠিক কোন উত্তর পাবো না বরং পরিস্থিতি খারাপ হবে। তাই নিজেই বাসায় খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম কোন প্রমাণের আশায়। শাশুড়ির ঘরে আমি কাজ ব্যতীত কখনো যাই না তবে এবার যেয়ে খুঁজলাম। তেমন কিছুই পেলাম না। আমি হিসেব মেলাতে পারলাম না, ঝুমুরের তো কোন শত্রুতা থাকার কথা না সাজ্জাদের সাথে। তাহলে এ কথাগুলো ও শুধু শুধু বলবেই বা কেন? আর এমন কিছু ঘটে থাকলে ওরা সব লুকালো কিভাবে? এত পরিষ্কারভাবে কি করে?এলাকার লোকজনও তো তাহলে বিয়ের আগে বলতো।
ওরা এ এলাকায় এসেছে আমাদের বিয়ের এক বছর আগে। আমার মামার বড় মুদি দোকান আছে এ এলাকায়। সাজ্জাদ আর ওর মা কে মামা চিনেছেন নিয়মিত দোকানের খরিদ্দার বলে। পরে খোঁজ নিয়ে ওদের পরিবার ভালো লাগে। নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার, বাবা নেই, আর কোন ভাইবোন ও নেই। মা আর ছেলে। গ্রামের বাড়ি জায়গা আছে, সাজ্জাদ ও ব্যাংকের অফিসার পদে আছে। পছন্দ না হওয়ার কারন নেই। এজন্যই বিয়েতে কারো কোন আপত্তিও ছিলো না। তাছাড়া আমিও বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে তাই সবাইই চেয়েছে এমন নির্ঝঞ্ঝাট ফ্যামিলিতেই আমি থাকি।
পরেরদিন সকালবেলা রান্নাঘরে যেতেই ঝুমুরকে দেখলাম জানালায়। ডাক দিয়ে বললাম,
-"ঝুমুর, কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো তো। আমি তো কোনকিছু পেলাম না খুঁজে!"
ঝুমুর মুখ কালো করে বললো,
"শোন সাজ্জাদের আগের একটা বিয়ে ছিলো। এই মেয়েটার সাথে সাজ্জাদের সম্পর্ক ছিলো প্রায় বছর ছয়। এম এ পাস করেই বিয়ে করে মেয়েটাকে ও। তারপর চাকরি পাইলে একসাথে সংসার শুরু করে। কিন্তু আন্টি মেয়েটাকে একটুও পছন্দ করতেন না, সাজ্জাদ প্রেম করে বিয়ে করেছে বলে। অনেক মিথ্যা নালিশ করতেন ও অফিস থেকে ফিরলে। ওরও মেজাজ খারাপ হয়ে যেত, ও মা র ধো র করতো। ওদের একটা ছেলেও ছিলো, এই দুই আড়াই বছর যখন বয়স হলো, তখন একদিন সাজ্জাদ এত মার লো ওর বউটাকে যে বউটা মারাই গেলো। আর বাচ্চাটা এসব দেখে কান্নাকাটি করছিলো, রাগের চোটে বাচ্চাটার মাথায়ও আঘাত করে মেরে ফেলেছিলো। কেইস কাবারি, পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিলো অনেক। ওরা ত একরকম পালিয়ে আসছে আগের জায়গা থেকে। টাকা পয়সা দিয়ে সব ছুটিয়েছে..."
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-"তুমি এতকিছু কিভাবে জানলে?"
ঝুমুর এটার উত্তর না দিয়ে বললো,
"তুমি প্রমান চাও তো? তাহলে মোহনপাড়ার ৪ নং রোড এর যেকোন বাড়িতে যেয়ে জিজ্ঞেস করো। আর বউটার বাবার বাড়ি ছিলো দক্ষিন পাড়া, মেজকালা নামের এলাকায়, ১৬ নাম্বার রোডের, ২১ নাম্বার বাড়ি। যেয়ে খোঁজ নিও, সব জানতে পারবে! আমি বউটার বাপের বাড়ি বহুবার গেছি, এইজন্য সব জানি! এইজন্যই তোমার শাশুড়ির সাথে এখন আর কথা হয়না...!"
এ কথাগুলো বলে ঝুমুর রুম থেকে চলে গেলো। আমি আরো অবাক হলাম। ভুলে যাওয়ার আগেই ডায়রীতে ঠিকানাগুলো লিখে রাখলাম। এসব ঠিকানায় যাওয়ার জন্য আমার মন আনচান করতে থাকলো। আমি ভাবলাম কাউকে দিয়ে না, আমি সশরীরে এসব জায়গায় যেয়ে সত্যতা যাচাই করবো। যতই হোক, এটা অনেক বড় একটা দাবী, সত্য কি মিথ্যা অবশ্যই যাচাই করা দরকার। আমি সুযোগ খুঁজতে থাকলাম।একদিন সুযোগ পেয়েও গেলাম। মোহনপাড়া চলে গেলাম বাসে করে। আমাদের এই এলাকা থেকে প্রায় দুই ঘন্টার দুরত্ব। যেয়ে এলাকাটি খুঁজে বের করে প্রথমে একটি বড় দোকানে খোঁজ নিলাম। নাম শুনেই দোকানদার আৎকে উঠলো। বললো
"এদের কেন খুঁজেন? আবার কিছু করছে নাকি?"
-"কেন ভাই আগে কিছু করছে? আমার বোনের জন্য সম্মন্ধ এসেছে...!"
দোকানদার আরো ভয় পেয়ে বললো,
"বইন, এরা ডাকাত। এগো কাছে আপনার বইনেরে দিয়েন না, মাই রা ফালাইবো!"
এরপর প্রায় আধা ঘন্টায় সে জানালো, ঝুমুর যা যা বলেছিলো। এরপর আরো সিউর হওয়ার জন্য আমি ওরা কোন বাসায় ছিলো সেটি খুঁজে বের করে সেখানের আশেপাশের মানুষদের থেকে খোঁজ নিলাম। কয়েকজন আমাকে পেপারের নিউজ ও দেখালো। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। সেদিনের মত বাসায় ফিরে আসলাম। শাশুড়ি আর সাজ্জাদকে এত ভয় পেতে থাকলাম বলার মতো না। যদিও সেদিনের পর সাজ্জাদ আর কিছু করে নি, সব ভালোই ছিলো। ঝুমুরকেও আর দেখছি না ওই সেদিনের পর থেকে। জানালা সব বন্ধ, ডাকলেও কোন সাড়া দেয় না। ফোন নাম্বারে কল দিলে "this phone number Doesn't exist" বলে। আমি চিন্তায় চিন্তা দিন কাটাচ্ছি। এর মাঝেই বাবার বাড়ি আসলাম, কয়েকদিন থাকবো বলে। চিন্তা করলাম বাবা কে এটা জানাই, মা কে জানালে ভেঙে পড়বে বেশি। বাবাকে নিয়ে সাজ্জাদের আগের বউয়ের বাসায় যাবো।
বাবাকে সব জানালাম। বাবাও প্রচন্ড রেগে গেলেন। তবে বাবাকে আপাতত চুপ থাকতে বললাম। একদিন বিকালে বাবার সাথে মেয়েটির বাসায় গেলাম খুঁজে নিয়ে। মেয়েটির বাসার ড্রইংরুমে ঢুকতেই আমি একটু আৎকে উঠলাম। মেয়েটির বাবা এলেন। সব কিছু জানালেন, কাগজপত্র, ছবি প্রমান সব দেখালেন। আমার বাবা আর আমি রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমরা ঠিক করলাম আমরা তখনই যাবো পুলিশের কাছে সব জানাতে। উঠতে উঠতে আংকেল কে জিজ্ঞেস করলাম,
-"আংকেল আপনার মেয়ের নাম কি ছিলো"
"অলিউননাহার"
-"ডাক নাম?"
"ঝুমুর"
আমি আরো একবার আৎকে উঠলাম। বললাম,
-"আংকেল আপনার নাতির নাম কি ছিলো?"
"আয়মান"
আমি যে ওদের বাসায় ঢুকেই আৎকে উঠেছিলাম, তার কারন হলো ড্রইং রুমে বড় করে ফ্রেম করা ছিলো ঝুমুর আর আয়মানের ছবি। যার সাথে আমার জানালায় কথা হতো, দেখা হতো। যে আমাকে এতকিছু জানিয়েছে। এরপর আমি ডিভোর্স নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই, বাবা আর আংকেলের সাথে পুলিশের কাছে যাই। আমাকে সব তথ্য লুকিয়ে করার জন্যও কেস হয়, আগের কেস আবার ওপেন করা হয়।
আপনাদের মতো আমিও একটা হিসাব মেলাতে পারিনি। তাই এরপর যেদিন ও বাসায় গেলাম, আমার সব জিনিস আনতে, পাশের বিল্ডিং এ যেয়ে ওই ফ্লাটের সম্পর্কে খোঁজ নিলাম। জানলাম গত প্রায় আড়াই বছর ধরে এ ফ্লাটে কোন ভাড়াটিয়া নেই। থাকতে পারেনা, উঠলেই নানারকম আজব ঘটনা ঘটে, এক মাসের মাঝেই তারা নেমে যেতে বাধ্য হয়। আমার ফোনে যে নাম্বারটি সেভ ছিলো ঝুমুরের সেটির কোন রেকর্ড ও আর দেখলাম না। এই নাম্বারটি যে সিম কোম্পানির মনে হয়েছিলো, তাদের থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম এই সিমটি প্রায় তিন বছর যাবৎ বন্ধ আছে।
জানিনা কে এভাবে আমাকে বাঁচিয়ে দিলো, এটা কি ছিলো, তবে আমার জীবনটা বেঁচে যাওয়ার জন্য আমি প্রতিনিয়ত তাকে ধন্যবাদ জানাই।
অনুগল্পঃ প্রতিবেশি
AmmDr-Mojaffar Molla(THG)