12/07/2025
শহরের বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে আরিয়ান কয়েকদিনের জন্য গ্রামে এসেছে।নেশা, দেহলোভ আর উদ্দাম জীবনে অভ্যস্ত এই ছেলেটা সব সময় মদে ভাসে।
তাকে গ্রামের মানুষেরা সমীহ করে, ভয়ে কথা বলে।
কারণ সবাই জানে—এই ছেলে টাকা ছুঁড়লে মানুষ বাঁচে, আর না দিলেই মরেও যেতে পারে।
সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের এক ছোট্ট রাস্তার মোড়ে হঠাৎ তার চোখ আটকে যায়...একটা মেয়ে, সাদা সালোয়ারে, চোখে কাজল, বাজারের ব্যাগ হাতে রাস্তা পার হচ্ছে।
মেয়েটার নাম — মেঘ।নাম যেমন, রূপও তেমন। মুখে এক অপার্থিব সরলতা, চোখে কষ্টের ছায়া।
আরিয়ান দাঁড়িয়ে যায়।দাঁড়িয়ে থেকে একবার তাকায়... তারপর আর নিজেকে থামাতে পারে না।
রাত গভীর হলে, মেঘ যখন পুকুরঘাট থেকে বাসায়ফিরছিল—ঠিক তখনই ঘটে সেই অন্ধকার ইতিহাস।
আরিয়ান, নেশায় অচেতন নয়,নেশায় উন্মাদ।
সেই রাত্রে, মেঘের সাদা পোশাক ভেসে যায় নীরব চিৎকারে, অসহায়তায়, আর পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর রক্তে।
সে রাত বদলে দেয় দুজনেরই জীবন।
পরদিন সকালসব খবর ছড়িয়ে পড়ে।মেঘের মা ছুটে এসে অজ্ঞান হয়ে যায়।গ্রামের লোকজন রাস্তায়, মেঘের নামে কান্না, অভিশাপ, প্রতিবাদ...
আরিয়ান?চুপচাপ দাঁড়িয়ে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলে—
আমি করলেও তোমরা কিছু করতে পারবা না। কারণ আমি আরিয়ান। আর আমার বাবার টাকা গিলে তুমরা বাঁচো!
মেঘ নিজেকে আর সহ্য করতে পারে না।সে নদীর কিনারে গিয়ে ঝাঁপ দিতে চায়।তবে সময়মতো কয়েকজন মেয়ে তাকে ধরে ফেলে, কান্নায় ভেঙে পড়ে।মেঘ একবার ফুঁসে উঠে বলে—আমি কিছু করিনি, আমি শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম!
সেদিন বিকেলে আরিয়ান আসে ঘটনাস্থলে—সবাই তাকে দেখে ভয় পায়, কেউ কিছু বলে না।কিন্তু হঠাৎ…মেঘ সামনে এসে দাঁড়ায়।তার চোখে আগুন।সে সবার সামনে আরিয়ানকে একটা, দুইটা, তিনটা থাপ্পড় মারে।আর বলে—
তুই যদি সত্যিকারে পুরুষ হোস, তবে আমার চোখে তাকিয়ে বল— আমি শুধু একটা রাতের জন্য বাঁচি? আমি কি মানুষ না?
আরিয়ান থমকে যায়।সবাই চুপ।সে আরিয়ান,তবু ঐ চোখের সামনে কিছু বলতে পারে না।সে চুপচাপ মেঘের চোখের গভীরে ডুবে যায়।
সেই মুহূর্তে,মেঘের রাগ, তার সাহস, তার মুখ, তার থাপ্পড়—
সবকিছু যেন এক অদ্ভুত ভালোবাসায় রূপ নেয়
আরিয়ানের মনে।
সে চুপ করে থাকে।ভেতরে কেবল একটাই আওয়াজ:এই মেয়েটা আমার। হোক না ঘৃণায়, তবুও আমার। আমি তাকে চাই।
সেই ঘটনার পরদিন সকালেই মেঘর বাড়িতে লোক আসে।
পিছে গাড়ি, সামনে কাজি সাহেব।আর গাড়ি থেকে নামে আরিয়ান… মাথায় সাদা পাগড়ি, চোখে ঠাণ্ডা আগুন।
গ্রামের সবাই ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে, কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করে না।মেঘর মা অজ্ঞান, আর ভাই বোন কাঁদছে।
মেঘ চিৎকার করে উঠে তুই কি পাগল? আমার সর্বনাশ করেছিস, এখন আবার আমার জীবনও নষ্ট করবি?আরিয়ান ঠাণ্ডা গলায় বলে,তোর জীবন আমি শেষ করিনি। আমি এবার শুরু করতে এসেছি।
কাজি সাহেব কাগজ খুলে ফেলে।আরিয়ান জোর করে মেঘের আঙুলে স্বাক্ষর নেয়।মেয়েটা কাঁপছে, চোখে ঘৃণা, মনে বিষ।তবুও…বিয়ে হয়ে যায়।
বিয়ের পরদিনই মেঘকে নিয়ে শহরে চলে আসে আরিয়ান।
তবে নিজের বাড়িতে নয়।তার বাবা, শফিক চৌধুরী, মেয়ে দেখতে না চাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দেয়—ছোটলোকের মেয়ে আমার বউ নয়, এই বাড়ির দরজায়ও পা দেবে না।
আরিয়ান রাগে বাবার গাড়ি, ব্যবসা, সব ছেড়ে এক ছোট্ট, আধা-ভাঙা কুঁড়েঘরে গিয়ে ওঠে।মেঘ সেই ঘরে গিয়ে বসে থাকে নিঃশব্দে…আর চোখে ঘৃণায় পোড়া অশ্রু জমে।
মেঘ কিছুই করে না, রান্না না, কথা না, একটুও না।শুধু চোখে আগুন নিয়ে বসে থাকে।আরিয়ান সব কাজ করে— রান্না, বাজার, মেঝে মোছা…আর রাতে শুধু জানলার পাশে বসে সিগারেট ফোঁকে।
আমার প্রতি তোমার ঘৃণা আমি বুঝি মেঘ…কিন্তু আমি এখন ভালোবাসি,হয়তো অন্যায়ভাবে শুরু করেছি,
কিন্তু শেষটা ঠিক করব… যদি তুমি একটু ভরসা করো।
মেঘ চিৎকার করে বলে—ভরসা? তোর মতো জানোয়ারের প্রতি?
আরিয়ান শুধু হাসে,জানোয়ারই তো বলেছিলি… এখন প্রমাণও তো পেতে হবে না?
রাত গভীর হলে, মেঘ ঘরের একপাশে শুয়ে থাকে আর কাঁদে।আরিয়ান জানলায় বসে পেছন ফিরে তাকায় না, শুধু চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে—
তুই ঘৃণা কর, আমি ভালোবাসব…তোর কান্না আমি বুঝি, কিন্তু আমি জানি,একদিন তুই আমাকে মাফ করবি… শুধু একটু সময় দে।তোর চোখে ঘৃণা আছে,কিন্তু আমার বুক ভরা ভালোবাসা…আমি মরব, কিন্তু তোকেই ভালোবেসে যাব।
শহরের অভিজাত পরিবার চৌধুরী ভিলা এখন অশান্ত।
শফিক চৌধুরী, কোটি টাকার মালিক,যার একমাত্র ছেলে তার কথায় চলে না এখন!একটা ‘গ্রামের মেয়ের জন্য’ তার আরিয়ান সব ছেড়ে দিয়েছে—এই অপমান সে সহ্য করতে পারছে না।
তুই যদি ওই মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখিস,তাহলে তুই আমার ছেলে না!আরিয়ান ফোন কেটে দেয়।আরিয়ান আর কিছু চায়না।শুধু চায় সে—মেঘ।যে এখনও তাকে ঘৃণা করে।
শফিক চৌধুরী চুপ করে বসে না।একদিন রাতে কয়েকজন মাস্তান পাঠায়—ওই মেয়েটা যেন থাকে না।আমি তার মুখ দেখতে চাই না।আরিয়ানকে ফিরিয়ে আনতে হলে, ওকে সরাতে হবে!কিন্তু আরিয়ান সেটা টের পায়।
রাত দশটা।মেঘ ঘরের ভেতর একা।আরিয়ান বাইরে একটা দোকানে।ঠিক তখনই তিনজন মুখ ঢাকা লোক এসে ঘরে ঢোকে।মেঘ ভয়ে কেঁপে ওঠে।তার চিৎকার করার আগেই একজন মুখ চেপে ধরে।
কিন্তু…আরিয়ান ঝড়ের মতো এসে হাজির।তার হাতে লাঠি।
তিনজনের ওপর এমন মার—একজনের হাত ভেঙে যায়, আরেকজন রক্তাক্ত হয়ে পড়ে।
আর একটা লোক পালাতে গেলে,আরিয়ান তার গলার কাছে লাঠি ঠেকিয়ে বলে—যারাই আমার বউর গায়ে হাত দিতে আসবে,আমি তার হাড্ডি ভেঙে ছাই করে দেবো।
আর শোন…আমি জানোয়ার, এখনো মানুষ হইনি,
সেই রাতে মেঘ ভয়ে কাঁপছিলো।আরিয়ান তার পাশে বসে বলে—আমি বাঁচাতে পারছি তোকেই,কিন্তু বিশ্বাসটা এখনো পাইনি।মেঘ প্রথমবার ফুপিয়ে কাঁদে,তবে মুখে এখনো তীব্র কণ্ঠে বলে,
তুই যা করছিস, সেটা তোর প্রাক্তন পাপ মোচনের চেষ্টা।
আমি তোকে কখনো ক্ষমা করবো না।আরিয়ান মাথা নিচু করে বলে—তুই যত ঘৃণা করবি, আমি তত ভালোবাসব।
(চলবে..?)