16/06/2024
েশবাড়ির_ছেলে ■
বাবার বাংলাদেশ : হাটখোলা পর্ব ■
______________________________
●
আমার প্রিয় গানের একটি এটি। সেদিন সন্ধ্যায় যখন গানটি মোবাইলে শুনছিলাম। বাবা অন্য রুমে অনেকটা দূরে ছিলেন। কাছে এগিয়ে এলেন। মনোযোগ দিয়ে মোবাইলে গানের সেই ভিডিওর দৃশ্য পলকহীন দৃষ্টিতে শুধু দেখেই চলেছেন। মনে মনে ভাবছিলাম, বাবার নিজের দেশের গান, নস্টালজিয়ায় হয়তো চুম্বকের ন্যায় আটকে গেছেন ভিডিওর সামনে। ঠাওর করলাম, ক্ষণিকের মধ্যে বাবার চোখ, মুখ, মুখের রঙ যেন অবলীলায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠছে। বাবা উচ্ছাসের সঙ্গে জ্বলজ্বল চোখে বলছেন, " সারেং বৌ ! ... ফারুক-কবরী, সালটা ১৯৭৮। আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে আমাদের প্রিয় গান।" বাবার উজ্জ্বল মুখ থেকে প্রতিফলিত আলোর বিচ্ছুরণে বুঝতে পারলাম, এ সাধারণ বিষয় নয়! এটি বাবার দুরন্ত বয়সের গান। আমি সেকেন্ড মুহূর্তে যেন সেই অতীতে চলে যাই নীরবে, মনে মনে, বাবার কথার রেশ ধরে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সেইসব ঘটনাগুলো এখনের মতো ততটাই আধুনিক। আমি ঐ মুহূর্ত থেকে অনুভব করতে শুরু করলাম সদ্য স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশকে।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ। ১৯৭৩ সাল। বাবা তখন উনিশ বছরের এক দুরন্ত তরুণ। পড়াশুনা শেষ করে ইউনাইটেড কেমিস্ট কোম্পানির অধীনে চাকুরি নেন।
প্রথমদিকে ঢাকার হাটখোলাস্থিত (তৎকালীন, বিক্রমপুর হাউজের পেছনে) কোম্পানির কারখানায় স্টোর ইনচার্জ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, যেখান থেকে ওষুধপত্র ডেসপাচ হতো দেশের নানা জায়গার উদ্দেশ্যে। এখনের মতো এতটা গাড়ির সুব্যবস্থা ছিল না তখন। প্রতিদিন ঠ্যালায় বোঝাই করে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো ওষুধ, রেল কিংবা স্টিমারের কাছে। অর্থাৎ হাটখোলা থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন কিংবা হাটখোলা থেকে সদরঘাট অবধি কিংবা বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট পর্যন্ত। সেখান থেকে বিভিন্ন বিভাগে, জেলায় (বর্তমানে উপজিলা নামকৃত) পাঠানো হতো। বাবার অ্যাসিটেন্ট ছিলেন বিনয় পাল, যিনি পরবর্তীতে কোলকাতায় চলে আসেন। স্টোরে বছর তিনেক চাকুরির পর কয়েকবছরের জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন কোম্পানির ক্যামিকেল সেকশনে। মেধাবী হওয়ার কারণে কোম্পানির এম. ডি. নিখিল দাশগুপ্ত মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে বাবাকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় রেংকিং স্ট্রিট সংলগ্ন ওয়ারী-স্থিত কোম্পানির সেলস অফিসে, বিল সেকশনে হিসাবরক্ষকের কাজে। পরবর্তীতে ইউনাইটেড কোম্পানির সমস্ত ব্যবস্থাপনা স্থানান্তরিত হয়ে যায় মগবাজারে। ওখানে কোম্পানির সেলস অফিসে নিজের দেশ-জীবনের শেষপর্যন্ত চাকুরি করে এসেছেন।
মগবাজারে কোম্পানির অফিসের জন্য যে বিল্ডিং ভাড়ায় নেওয়া হয়, সেটি আসলে একটি বৃহৎ বাড়ি ছিল। সেই বাড়িটি নিয়ে একটি ছোট্ট কাহিনী আছে। একাত্তরের আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, সেইসময় একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূত ওখানে বাসাবাড়ি তৈরি করেছিলেন। সেই বাড়িতে গৃহ পরিচারিকার কাজ করতেন এক মহিলা। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রদূত যখন স্বাধীন বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান, যাওয়ার সময় ঐ পরিচারিকাকে বাড়িটি দান করে দিয়ে যান। লোকমুখে এটাই কথিত ছিল সেইসময়।
বাবার সঙ্গে আমার ছোটবেলা থেকেই মানসিকভাবে দূরত্ব বজায় থাকতো। এতটা ঘনিষ্ট কোনসময়ই ছিলাম না। একমাত্র কারণ ছিল, প্রচন্ড ভয় করতাম। মাঝেমধ্যে বাড়িতে অন্যদের সাথে আড্ডা জমে উঠলে প্রায়ই বাবা নিজের ছোটবেলার, কৈশোরের, তারুণ্যের নানা গল্প বলতেন, এখনো বলেন। আমি শুনি, আর মনে মনে নিজের কল্পনায় একটা বাংলাদেশ বানাই। একটা কুমিল্লা, একটা চৌদ্দগ্রাম, একটা ঢাকা - যেখানে বাবার কাহিনী অনুযায়ী আমার চোখের অপর পিঠে প্লট তৈরি হয়। বাবার জন্ম কুকুড়িখিল গ্রামে। সেখানের পথ ঘাট মাঠ - বাবার হাঁটতে শেখা, খেলাধূলা, দৌড়াদৌড়ি, বর্ষায় ডোবায় মাছধরা - সব যেন আমি চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করি। বাবার স্কুলে ভর্তি হওয়া, খাড়ঘর প্রাইমারি স্কুল, স্কুলের রাস্তা, বাবার বই হাতে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া, মাস্টার সিদ্দিকুর রহমান মজুমদার মহাশয়ের শাসন, ওনাদের চোখে বাবার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা, নানা হাতের সাহায্য নিয়ে বড় হয়ে ওঠা, অগণিত সংগ্রাম করে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মার্কস পাওয়া, ঢাকায় চলে যাওয়া - প্রত্যেকটা কাহিনী আমাকে অতীতের গহ্বরে টেনে নিয়ে যায়, যেন আমি চোখের সামনে স্থান কাল চরিত্র সব দেখতে পাই সিনেমার মতো। বাবার বাংলাদেশকে আমি বাবার মতোই ভালোবাসি। কেন ভালোবাসি, তার কারণ হয়তো শরীরে রক্তের টানের মধ্যে লুকিয়ে আছে, সেই অনুভূতির পর্যাপ্ত বর্ণনা আমি শব্দ প্রকাশের মাধ্যমে কোনোদিন দিতে পারবো না। যে দেশটিকে এতটা ভালোবাসি, যে দেশের মাটি বাবার শরীর গড়ার মাটি, আজ এসময়ে এসে সেই আকুতির কারণে আমার মনে একটা তুফান কাজ করে। কেন আমি সেই সুন্দর যোগসূত্রকে সংরক্ষণ করছি না, কেন আমি বাবাকে তাঁর দেশের সঙ্গে আজীবনের জন্য বাঁচিয়ে রাখছি না! পরিশেষে, ঐদিনের ঐ মুহূর্তের পর থেকে এই জীবন দরিয়ার কথা জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম। যার সূত্রপাত এই গানটি দিয়ে - "ওরে নীল দরিয়া, আমায় দেরে দে ছাড়িয়া।"
কোম্পানির কারখানায়, প্রথমে যেখানে নিযুক্ত ছিলেন সেই হাটখোলা, জাঁকজমকপূর্ণ শহুরে পরিবেশ। পশ্চিমে ছিল বঙ্গভবন, পূবে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন, উত্তরে মতিঝিল শাপলা চত্বর। কারখানার নিকটেই অভিসার সিনেমাহল। কারখানার ছাদ থেকে সিনেমাহল দৃশ্যত ছিল। তারও উত্তরে ছিল মধুমিতা সিনেমাহল। সব মিলিয়ে হাটখোলায় কর্মরত কালে দৈনন্দিন দিনযাপন ছিল ব্যঞ্জনাময়। কারখানার উপরের তলায় থাকার সুব্যবস্থা ছিল। সঙ্গে আরও দুই ঘনিষ্ট সহপাঠী - জহর সাহা, চন্দ্রসাগর মজুমদার।
প্রতিদিনের রুটিন অনেকটা এরকম ছিল - ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃভ্রমনে বেরুতেন। কোনোদিন টয়েনবী রোড ধরে মধুমিতা সিনেমাহল পেরিয়ে অনেকটা দূর মতিঝিল শাপলা চত্ত্বর অবধি, কোনোদিন ফজলে রাব্বী রোড ধরে বঙ্গভবন অবধি প্রাতঃভ্রমন চলতো। প্রতিদিন ফেরার পথে ইত্তেফাক অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালে সাঁটানো দৈনিক ইত্তেফাক-এর সংবাদের উপর চোখ বুলিয়ে না আসলে দিনের শুরু অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তারপর সারাদিন কোম্পানির কাজ, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। ছুটিরদিনে অনেকসময় বেঙ্গল স্টুডিও বেড়াতে যেতেন যেখানে সিনেমার শুটিং হতো প্রায়ই। সন্ধ্যা হলে আশেপাশে সান্ধ্যকালীন ভ্রমণ, চায়ের আড্ডা, দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডার (হোটেল) ছিল আড্ডার অন্যতম জায়গা। এছাড়া রয়েল রেস্ট হাউজ এন্ড হোটেলের নিচের তলা ছিল আরেকটি আড্ডাস্থল। নিচতলার একপাশে মিষ্টির দোকান, অন্যপাশে সুস্বাদু মোগলাই, বিরিয়ানির ব্যবস্থা। অত্র এলাকায় অত্যন্ত বিখ্যাত ছিল এই দোকানের খাবার। রয়েল রেস্ট হাউজ এন্ড হোটেলের মালিক মিলনবাবু ছিলেন মাস্তান টাইপের লোক, যিনি পুলিশে চাকরি করতেন। অবসর গ্রহণের পর এই ব্যবসা শুরু করেন এবং সুস্বাদু খাবার পরিবেশনে ঐসময়ে ঐ এলাকায় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। প্রায় প্রতিদিন আড্ডায় দিনান্ত করে মাঝেমধ্যে সপ্তাহান্তে অভিসার অথবা মধুমিতা সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখা ছিল একটি বাড়তি বিনোদন।
সাল ১৯৭৮। ১৬ ই জুন, "সারেং বউ" মুক্তিপ্রাপ্ত হয়। ঢাকার পথে পথে ফারুক-কবরীর ছবি সম্বলিত পোস্টার। পরিচালক - আবদুল্লাহ আল মামুন। নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা, তরুণের মনে এ নিয়ে যে উত্তেজনা শুরু হয়, বাবা সহ অন্য সহপাঠীদের বেলায়ও তা-ই হয়েছিল। বাবার বয়স তখন চব্বিশ। রেংকিং স্ট্রিট সংলগ্ন ওয়ারী-স্থিত ইউনাইটেড কেমিস্ট কোম্পানির সেলস অফিসে কর্মরত। ভাড়া থাকতেন গোলাপবাগে। সেখান থেকে ঐসময় সহপাঠীদের সঙ্গে চলে আসতেন হাটখোলায় - অভিসার সিনেমাহলে নতুবা মধুমিতায় । সত্যি অর্থে ঐ হাটখোলা এলাকাতেই ছিল বাবার পরিচিত সকলে। নিজের এলাকার যে সুখ, সেটা সেখানেই পেতেন বাবা। কারণ এই নয় যে, চাকুরির শুরু থেকে সেখানেই নিযুক্ত ছিলেন। কারণ ছিল, অনেকবছর অনেক মানুষের সঙ্গে উঠা বসায়, সেখানকার অনেকেরই প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন বাবা। "সারেং বউ" মুক্তিপ্রাপ্তের পর কোনো এক সপ্তাহের একটি সন্ধ্যায় সিনেমাটি দেখতে আসেন তাঁরা। পছন্দের জুটি। তার উপরে আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সেই গান। বহুদিন পর একটা ভালো কাহিনী তাঁদের উত্তেজনাকে সার্থক করে। সিনেমা শেষ করে চলে যান মিলনবাবুর বিখ্যাত বিরিয়ানি খেতে। ভয়ংকর ঝড়ে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, দুনিয়া শান্ত হলে সব হারিয়েও ভালোবাসার তাগিদে মানুষ মানুষকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করে - এমন একটি বুক কাঁপানো অনুভূতি আর নীল দরিয়া'র সুর সযতনে বুকে বেঁধে আগামীর রাস্তায় এগিয়ে চলেন বাবা। নিয়মমতো রাতে ফিরে আসেন গোলাপবাগ নিজের আস্তানায়। আজ দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর পরেও সেই সময়ের স্মৃতিগুলি শিকড়ের মতো বাবার বুকের মাটি ভেদ করে সেই গভীর পর্যন্ত নাড়া দেয়, যে গভীরে বাবার আবেগ অনুভূতি এখনো জ্বলজ্বল করে চলেছে বাংলাদেশের প্রতি।
●
__________________________________________
বাবার কাছ থেকে এক এক করে সব শুনবো। সংরক্ষণ করবো একটি সুতো'কে, যে সুতো রাজনৈতিক দলাদলির কারণে একদিন ছিঁড়ে গিয়েছিল কাঁটাতারের অছিলায়।
__________________________________________