10/07/2025
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট গ্ৰাম—জিলিং সেরেং। ৯৫ টি পরিবারের এই গ্রামে স্কুল অনেক দূরে। ফলে বেশিরভাগ শিশুই পড়াশোনার সুযোগ পেত না। ২০১৯ সালে বিয়ের পর এই গ্রামে এসে মালতী দেখলেন—বাচ্চারা স্কুল যায় না, বই খাতা চেনে না। তখনই তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন—“আমি এদের পড়াবো। যতটুকু পারি, যতদূর পারি।”
কথাটা ছড়িয়ে গেল পুরো গ্রামে। গ্রামবাসী এগিয়ে এসে দাঁড়াল মালতীর পাশে। নিজেদের হাতে তুলে দিল দেয়াল। একটা মাটির ঘরেই গড়ে উঠল ছোট্ট পাঠশালা। বিশ্বাস করে নিজের সন্তানদের তুলে দিল মালতীর হাতে। ২০২০ সালে যখন লকডাউনে গোটা দেশ স্তব্ধ, তখন এক আদিবাসী গৃহবধূ, মালতী মুর্মু, নিজের ছোট্ট ২ মাসের শিশুকে কোলে নিয়েই শুরু করলেন এক অনন্য লড়াই—শিক্ষার লড়াই। মাটির ঘর, দুটো ছোট সন্তান, সংসারের দায়িত্ব—সবকিছুর মধ্যেও মালতী হার মানেননি।
ভোরবেলা উঠেই সংসারের কাজ সামলে কোলে নিজের দুধের বাচ্চা, আর পাশে ৪৫টা সাঁওতাল শিশু—যারা তখনও স্বপ্ন দেখতে শেখেনি। মালতী তাদের হাতে তুলে দিলেন বই, খাতা, আর মুখে দিলেন ভাষা। শেখালেন মাতৃভাষা অলচিকি, বাংলা, ইংরেজি—একেবারে বিনামূল্যে।
না, কোনও সরকারি সাহায্য নেই, নেই কোনো খবরের শিরোনাম। আছে শুধু নিজের জেদ আর মানুষের ভালোবাসা। আজ্ঞে হ্যাঁ, কোনও সরকারি সাহায্য ছাড়াই নিজেদের উদ্যোগে চলছে এই মালতির পাঠশালা। গ্রামবাসীরাও মালতি মুর্মুর এই সাধু উদ্যোগে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
পাহাড়ের কোলে এক মাটির একটি ঘর থেকে শিক্ষার আলো জ্বালাচ্ছেন এই আদিবাসী গৃহবধূ। উৎসাহ নিজের হলেও এই কাজে পাশে পেয়েছেন তার স্বামীকে। পাশে পেয়েছেন গ্রামবাসীদের। বর্তমানে এলাকার মানুষের কাছে শিক্ষার অন্যতম ভরসা এই মালতী মুর্মু। শুরুতে কয়েকজন, আর এখন প্রায় ৬০ জন ছাত্রছাত্রী তার কাছে পড়ে—একেবারে বিনামূল্যে।
কিন্তু আফসোস… আমরা এই মালতীকে চিনি না। শোস্যাল মিডিয়ায় যে মেয়েরা নিজেদের শরীর দেখায় আমরা তাদের ভাইরাল করি। কিন্তু এই মেয়েটি—যে নিজের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, সময়, দুধের শিশুর খেলাধুলার মুহূর্ত বিসর্জন দিয়ে অন্যদের সন্তানদের মানুষ করে তুলছেন—তিনি থেকে যান অচেনা, অজানা। সমাজে যারা অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে তারা জনপ্রিয় হচ্ছে কিন্তু যাঁরা নীরবে সমাজ বদলাচ্ছে—তাদের কেউ চিনবে না কেন?
মালতী মুর্মু শুধুই একজন শিক্ষিকা নন, এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যদি মনের জোর থাকে তাহলে সমাজ আর সংসার দুটোই একসঙ্গে পাল্টানো যায়।
দিদিমণি আপনার চরণে শতকোটি প্রণাম। এই দেশে, এই সমাজে আপনার মতো মানুষদেরকে প্রয়োজন। দিদিমণি, আপনাকে কুর্নিশ। আপনি আমাদের দেশের গর্ব।
#মালতীমুর্মু #অযোধ্যা #জিলিংসেরেং