12/07/2025
বয়ঃসন্ধির আলো-অন্ধকারে অভিভাবক ও শিক্ষকদের দায়
জীবন মানেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল - নিশ্চিতভাবেই এমনটি নয়। তবে বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে এটি শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, অভিভাবকদের জন্যও গর্ব এবং সামাজিক অবস্থান নির্ধারণের একটি প্রতীক। অথচ এই সফলতার পেছনে শিক্ষার্থী একমাত্র দায়ী নয়—বড় দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের।
মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়টি পড়ে বয়ঃসন্ধিকালে—একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও পরিবর্তনময় সময়। এই সময় শারীরিক, মানসিক, আবেগগত পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয় পরিচয় খোঁজার চেষ্টা, চাপ, দ্বিধা, সম্পর্কের জটিলতা। একে অনেকে বলেন “আলো-অন্ধকারের সময়” বা “confusing age”।
✅ মন খারাপের বয়স:
• হরমোনের পরিবর্তন: এর প্রভাব পড়ে মনের ওপর—হঠাৎ বিষণ্নতা, মুড সুইং, হতাশা।
• পরিচয়ের সন্ধান: নিজের ভবিষ্যৎ, পরিচয়, উদ্দেশ্য—এই প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়।
• সম্পর্কের জটিলতা: বন্ধু, পরিবার কিংবা ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়।
• পড়ালেখা ও সামাজিক চাপ: পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা যেন মাথার ওপর বিশাল এক পাহাড়।
✅ আবার এটাও শুধুই দুঃসময়ের বয়স নয়:
• সৃজনশীলতার বিস্ফোরণ: অনেকের চিন্তা ও কল্পনার ক্ষমতা তুঙ্গে ওঠে।
• স্বপ্ন গড়ার সময়: এই বয়সেই তৈরি হয় “আমি কী হতে চাই”।
• বন্ধুত্বের গভীরতা: জীবনের গভীর ও স্থায়ী বন্ধুত্বের বীজ বপিত হয় এই বয়সেই।
• আত্ম-অনুসন্ধান: নিজেকে বোঝার সময়, নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার সময়।
এই সময় তাই শুধুই মন খারাপের সময় নয়—এটি সম্ভাবনার সময়ও। কিন্তু এই সম্ভাবনা বিকাশের জন্য প্রয়োজন সহানুভূতিশীল অভিভাবক এবং আন্তরিক শিক্ষক।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই সহায়ক পরিবেশ অনুপস্থিত।
পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো শেখার মূল্যায়ন, দক্ষতা যাচাই, উন্নতির সুযোগ তৈরি এবং ভবিষ্যতের প্রস্তুতি। কিন্তু যখন ফলাফল প্রত্যাশিত না হয়, তখন দায়ভার শিক্ষার্থীর উপর চাপিয়ে না দিয়ে আমাদের প্রথমে প্রশ্ন করতে হবে—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের ভূমিকাই বা কতটা সফল ছিল?
আজ অনেক শিক্ষকের সময় কাটে শিক্ষক সংগঠন, রাজনীতি, কিংবা দাবিদাওয়া নিয়ে মিটিং-সিটিং-তদবিরে। প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে থাকেন এমন কিছু নষ্ট রাজনৈতিক ক্ষমতাবান এবং অনুরূপ ক্ষমতাবান সরকারি কর্মচারী, যারা ব্যস্ত থাকেন নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে।
আমরা সবাই জানি শিক্ষার এই অধপতনের শুরু এবছরে না, অনেক আগেই নিম্নমুখী হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো:
• কবে এটি উর্ধ্বমুখী হবে? ক্ষমতাবান, যারা নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্যে ব্যস্ত।
• কবে শিক্ষকদের মধ্যে আত্মসমালোচনার বোধ জাগবে?
• কবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের আন্তরিক পাঠদান শুরু হবে?
• কবে বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষা ও ফলাফল প্রদান হবে?
• কবে ফেল করা শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষকের দুঃখবোধ থাকবে, কেবল ছাত্রের ব্যর্থতাকে নয়, নিজেকে দায়ী মনে করবেন শিক্ষক?
• কবে বন্ধ হবে ভর্তি ও নিয়োগ বানিজ্য?
• কবে হবে শিক্ষানীতির / নীতির সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন এবং গুনগত শিক্ষার বাস্তব চর্চা?
রাজনীতি নিয়ে কমিশন হয়, সভা-সেমিনার হয়, আইন হয়। কিন্তু শিক্ষার জন্য আমরা কবে সত্যিকারের আলোচনায় বসব?
সব শিক্ষার্থী নেতা হবে না, হওয়াও উচিত নয়। আবার সবাই ভালো রেজাল্টও করবে না—তবে তারা যেন জীবনের কাছে হেরে না যায়, এটুকু নিশ্চয়তা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের, বিশেষ করে শিক্ষক, অভিভাবক এবং রাষ্ট্রের।