08/06/2024
গ্রামের নাম কাশীপুর৷
গ্রাম ছোট, জমিদার আরও ছোট, তবুও দাপটে তাঁর প্রজারা টু শব্দটি করিতে পারে না৷—
এমনই প্ৰতাপ!
ছোট ছেলের জন্মতিথি পূজা৷ পূজা সারিয়া তর্করত্ন দ্বিপ্রহর বেলায় বাড়ি ফিরিতেছিলেন।
বৈশাখ শেষ হইয়া আসে, কিন্তু মেঘের ছায়াটুকু কোথাও নাই, অনাবৃষ্টির আকাশ হইতে
যেন আগুন ঝরিয়া পড়িতেছে। সম্মুখের দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলিয়া পুড়িয়া ফুটিফাটা
হইয়া আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়া ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হইয়া উড়িয়া
যাইতেছে৷ অগ্নিশিখার মত তাহাদের সর্পিল ঊর্ধ্বগতির প্রতি চাহিয়া থাকিলে মাথা
ঝিমঝিম করে—যেন নেশা লাগে৷
ইহারই সীমানায় পথের ধারে গফুর জোলার বাড়ি৷ তাহার মাটির প্রাচীর পড়িয়া গিয়া প্রাঙ্গণ আসিয়া পথে মিশিয়াছে,এবং অন্তঃপুরের লজ্জাসম্ভ্রম পথিকের করুণায় আত্মসমর্পণ
করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছে৷
পথের ধারে একটা পিটালি গাছের ছায়ায় দাঁড়াইয়া তর্করত্ন উচ্চকণ্ঠে ডাক দিলেন,
ওরে, ও গফরা, বলি, ঘরে আছিস?
তাহার বছর-দশেকের মেয়ে দুয়ারে দাঁড়াইয়া সাড়া দিল,
কেন বাবাকে? বাবার যে জ্বর
জ্বর! ডেকে দে হারামজাদাকে। পাষণ্ড! ম্লেচ্ছ!
হাঁক-ডাকে গফুর মিঞা ঘর হইতে বাহির হইয়া জ্বরে কাঁপিতে কাঁপিতে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। ভাঙ্গা প্রাচীরের গা ঘেঁষিয়া একটা পুরাতন বাবলা গাছ—তাহার ডালে বাঁধা একটা ষাঁড়৷
তর্করত্ন ষাড় কে দেখাইয়া কহিলেন, ওটা হচ্চে কি শুনি?
এটা হিঁদুর গাঁ, ব্রাহ্মণ জমিদার, সে খেয়াল আছে?
তাঁর মুখখানা রাগে ও রৌদ্রের ঝাঁজে রক্তবর্ণ, সুতরাং সে মুখ দিয়া তপ্ত খর বাক্যই বাহির হইবে, কিন্তু হেতুটা বুঝিতে না পারিয়া গফুর শুধু চাহিয়া রহিল৷
তর্করত্ন বলিলেন, সকালে যাবার সময় দেখে গেছি বাঁধা, দুপুরে ফেরবার পথে দেখচি তেমনি ঠায় বাঁধা৷ গোহত্যা হলে যে কর্তা তোকে জ্যান্ত কবর দেবে৷ সে যে-সে বামুন নয়!
গফুর কহিল- কি কোরব বাবাঠাকুর, বড় লাচারে পড়ে গেছি৷ ক'দিন থেকে গায়ে জ্বর, দড়ি ধরে যে দু-খুঁটো খাইয়ে আনব—তা মাথা ঘুরে পড়ে যাই৷
তর্করত্ন কহিল -তবে ছেড়ে দে না, আপনি চরাই করে আসুক।
গফুর জবাবে বললো -কোথায় ছাড়ব বাবাঠাকুর, লোকের ধান এখনো সব ঝাড়া হয়নি—খামারে পড়ে খড় এখনো গাদি দেওয়া হয়নি, মাঠের আলগুলো সব জ্বলে গেল—কোথাও একমুঠো ঘাস নেই৷ কার ধানে মুখ দেবে, কার গাদা ফেড়ে খাবে—
ক্যামনে ছাড়ি বাবাঠাকুর?
তর্করত্ন একটু নরম হইয়া কহিলেন, না ছাড়িস ত ঠাণ্ডায় কোথাও বেঁধে দিয়ে দু'-আঁটি বিচুলি ফেলে দে না ততক্ষণ চিবোক।
তোর মেয়ে ভাত রাঁধেনি? ফ্যানে-জলে দে না এক গামলা খাক৷
গফুর জবাব দিল না৷
নিরুপায়ের মত তর্করত্নের মুখের পানে চাহিয়া তাহার নিজের মুখ দিয়া শুধু একটা
দীর্ঘনিঃশ্বাস বাহির হইয়া আসিল৷
তর্করত্ন বলিলেন, তাও নেই বুঝি? কি করলি খড়? ভাগে এবার যা পেলি সমস্ত বেচে পেটায় নমঃ? গরুটার জন্যেও এক আঁটি ফেলে রাখতে নেই? ব্যাটা কসাই! এই নিষ্ঠুর অভিযোগে গফুরের যেন বাকরোধ হইয়া গেল৷
ক্ষণেক পরে ধীরে ধীরে কহিল, কাহন-খানেক খড় এবার ভাগে পেয়েছিলাম, কিন্তু গেল সনের বকেয়া বলে কর্তামশায় সব ধরে রাখলেন৷ কেঁদেকেটে হাতেপায়ে পড়ে বললাম, বাবুমশাই, হাকিম তুমি, তোমার রাজত্বি ছেড়ে আর পালাবো কোথায়, আমাকে পণ-দশেক বিচুলিও না হয়
দাও। চালে খড় নেই—একখানি ঘর, বাপ-বেটিতে থাকি,তাও না হয় তালপাতার গোঁজা-গাঁজা দিয়ে এ বর্ষাটা কাটিয়ে দেব, কিন্তু, না খেতে পেয়ে আমার মহেশ মরে যাবে৷
তর্করত্ন হাসিয়া কহিলেন, ইস! সাধ করে আবার নাম রাখা হয়েছে মহেশ! হেসে বাঁচিনে!
কিন্তু এ বিদ্রুপ গফুরের কানে গেল না, সে বলিতে লাগিল, কিন্তু হাকিমের দয়া হল না। মাস-দুয়ের খোরাকের মত ধান দুটি আমাদের দিলেন, কিন্তু বেবাক খড় সরকারে গাদা হয়ে
গেল, ও আমার কুটোটি পেলে না৷—বলিতে বলিতে কণ্ঠস্বর তাহার অশ্রুভারে ভারী হইয়৷ উঠিল৷ কিন্তু তর্করত্নের তাহাতে করুণার উদয় হইল না
কহিলেন, আচ্ছা মানুষ ত তুই—খেয়ে রেখেছিস, দিবি নে? জমিদার কি তোকে ঘর থেকে খাওয়াবে নাকি?
তোরা ত রামরাজত্বে বাস করিস—ছোটলোক কিনা, তাই তাঁর নিন্দে করে মরিস।
গফুর লজ্জিত হইয়া বলিল, নিন্দে কোরব কেন বাবাঠাকুর, নিন্দে তাঁর আমরা করি নে৷ কিন্তু কোথা থেকে দিই বল ত?
বিঘে-চারেক জমি ভাগে করি, কিন্তু উপরি উপরি দু’সন অজন্ম৷—মাঠের ধান মাঠে শুকিয়ে গেল—বাপ-বেটিতে দুবেলা দুটো পেট ভরে খেতে পর্যন্ত পাইনে৷
ঘরের পানে চেয়ে দেখ, বিষ্টি-বাদলে মেয়েটাকে নিয়ে কোণে বসে রাত কাটাই, পা ছড়িয়ে শোবার ঠাঁই মেলে না৷
মহেশকে একটিবার তাকিয়ে দেখ, পাঁজরা গোনা যাচ্ছে,—দাও না ঠাকুরমশাই, কাহন-দুই ধার, গরুটাকে দু'দিন পেটপুরে খেতে দিই—বলিতে বলিতেই সে ধপ করিয়া ব্রাহ্মণের
পায়ের কাছে বসিয়া পড়িল৷
তর্করত্ন তীরবৎ দু' পা পিছাইয়া গিয়া কহিলেন, আ মর, ছুঁয়ে ফেলবি না কি?
না বাবাঠাকুর, ছোঁব কেন, ছোঁব না৷ কিন্তু দাও এবার আমাকে কাহন-দুই খড়৷
তোমার চার-চারটে গাদ৷ সেদিন দেখে এসেচি—এ ক'টি দিলে তুমি টেরও পাবে না৷ আমরা
না খেয়ে মরি ক্ষেতি নেই, কিন্তু ও আমার অবলা জীব—কথা বলতে পারে না, শুধু চেয়ে থাকে, আর চোখ দিয়ে জল পড়ে৷
তর্করত্ন কহিলেন, ধার নিবি, শুধবি কি করে শুনি?গফুর আশান্বিত হইয়া ব্যগ্রস্বরে বলিয়া উঠিল, যেমন করে
পারি শুধবো বাবাঠাকুর, তোমাকে ফাঁকি দেব না৷ তর্করত্ন মুখে একপ্রকার শব্দ করিয়া গফুরের ব্যাকুলকণ্ঠের অনুকরণ করিয়া কহিলেন, ফাঁকি দেব না! যেমন করে পারি
শুধবো!
রসিক নাগর! যা যা সর, পথ ছাড়৷ ঘরে যাই বেলা বয়ে গেল৷ এই বলিয়া তিনি একটু মুচকিয়া হাসিয়া পা বাড়াইয়াই সহসা সভয়ে পিছাইয়া গিয়া সক্রোধে বলিয়া উঠিলেন, আ মর, শিঙ নেড়ে আসে যে, গুঁতোবে না কি!
গফুর উঠিয়া দাঁড়াইল৷
ঠাকুরের হাতে ফলমূল ও ভিজা চালের পুঁটুলি ছিল, সেইটা দেখাইয়া কহিল, গন্ধ পেয়েচে
এক মুঠো খেতে চায়—
তর্করত্ন কহিল- খেতে চায়? তা বটে! যেমন চাষ৷ তার তেমনি বলদ। খড় জোটে না, চাল-কলা খাওয়া চাই! নে নে, পথ থেকে সরিয়ে বাঁধ৷ যে শিঙ, কোন দিন দেখচি কাকে খুন করবে৷ এই
বলিয়া তর্করত্ন পাশ কাটাইয়া হনহন করিয়া চলিয়া গেলেন৷
গফুর সেদিক হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া মহেশের মুখের দিকে চাহিয়৷ রহিল৷ তাহার নিবিড় গভীর কালো চোখদুটি বেদনা ও ক্ষুধায় ভরা,
কহিল, তোকে দিলে না এক মুঠো?
ওদের অনেক আছে তবু দেয় না। না দিক গে,
—তাহার গলা বুজিয়া আসিল, তার পরে চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল! কাছে আসিয়া নীরবে ধীরে ধীরে তাহার গলায় মাথায় পিঠে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে চুপি চুপি বলিতে লাগিল,
মহেশ, তুই আমার ছেলে, তুই আমাদের আট সন প্রিতিপালন করে বুড়ো হয়েছিস, তোকে
আমি পেটপুরে খেতে দিতে পারি নে—কিন্তু, তুই ত জানিস
তোকে আমি কত ভালবাসি।
মহেশ প্রত্যুত্তরে শুধু গলা বাড়াইয়া আরামে চোখ বুজিয়া রহিল৷
পার্ট -২ পড়তে চোখ রাখুন এই পেইজে অথবা পুরো গল্প অডিও শুনতে ইউটিউবে শুনুন-
https://youtu.be/jkFoy2hOQjQ?si=hJ_Meue5oi0ZxwF7