
06/04/2025
অপ্রত্যাশিত বন্ধুত্ব (পর্ব ৩ )
বাপ্পি ঠাণ্ডা হয়ে বসে আছে স্ক্রিনের সামনে। বুকের ভেতর এক অজানা উত্তেজনা আর ভয় একসাথে খেলে যাচ্ছে। তার হাতে আর মুখে ঘাম জমেছে, কিন্তু তবুও সে চ্যাট উইন্ডোর সেই লেখা থেকে চোখ সরাতে পারছে না।
অপরিচিত ব্যক্তি: “তুমি কি তোমার সহপাঠীদের দেখতে চাও? রাকিব, তন্ময়, সুমন, আফরিন... তোমাকে যারা কষ্ট দিয়েছে?”
বাপ্পির চোখ বড় হয়ে যায়। সে যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না—কি বলতে চাইছে সে?
বাপ্পি: “দেখতে চাচ্ছি বলতে? ঠিক বুঝলাম না?”
অপরিচিত ব্যক্তি: “ওদের বর্তমান অবস্থা দেখতে চাও?”
হাত কাঁপতে থাকে বাপ্পির। ঠোঁট শুকিয়ে আসে।
বাপ্পি: “মানে? কিভাবে? তুমি বলছো কি? কীভাবে তুমি দেখাবে?”
অপরিচিত ব্যক্তি: “সেটা না হয় পরে বলি। আগে বলো—তুমি দেখতে চাও কি না?”
বাপ্পির মনে ভয়ের চেয়ে কৌতূহল বেশি কাজ করছিল তখন। সে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিঃশ্বাস ফেলে লিখল:
বাপ্পি: “হ্যাঁ, আমি দেখতে চাই।”
সাথে সাথেই স্ক্রিনে একটা ভিডিও পাঠানো হলো। থাম্বনেইলটা ঝাপসা, অন্ধকার। ভিডিওটা চালাতেই শুরু হলো নরক দর্শন।
প্রথমেই দেখা গেলো রাকিব—স্কুলের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছেলেটা—সে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটা পরিত্যক্ত ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। ঘরের এক কোণ থেকে হেঁটে এলো একটা ছায়ামূর্তি। তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু তার হাতে ছিলো একটা রুস্টেড লোহার রড। মুহূর্তের মধ্যে রডটা আছড়ে পড়লো রাকিবের হাঁটুতে। হাড় চুরমার হয়ে যাওয়ার কর্কশ শব্দ ভেসে এলো, আর রাকিবের মুখে চিৎকার!
দৃশ্য বদলালো।
এইবার তন্ময়—যে প্রতিদিন বাপ্পির টিফিন ফেলে দিতো। তার মুখে স্কচটেপ, চোখ খুলে রাখা হয়েছে তীব্র আলোয়। ধীরে ধীরে, ব্লেড দিয়ে তার আঙ্গুলগুলো কাটা হচ্ছে। ক্যামেরা ঠাণ্ডা, কোনো কম্পন নেই। যেন কেউ ঠান্ডা মাথায় এসব করেই চলেছে।
সুমন, যে তার ব্যাগে ময়লা ঢেলে দিতো, তাকেও দেখা গেলো। কিন্তু সে ঝুলছে—উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, আর তার শরীরের নিচে বিশাল এক পিঁপড়ার খামার। একটা একটা করে গায়ের চামড়া কেটে পিঁপড়াগুলোকে দেয়া হচ্ছে।
সবশেষে আফরিন—যে সামনে বন্ধুর অভিনয় করলেও পেছনে বাপ্পিকে অপমান করতো। তাকে দেখা গেলো একটা আয়নার সামনে। কে যেন বলছে, “তোমার সৌন্দর্য তোমার অহংকার ছিলো, তাই না?” এরপর, আয়না ভেঙে হাতে একটি কাঁচের টুকরো তুলে নিয়ে কেউ ধীরে ধীরে আফরিনের মুখে কেটে দিচ্ছে। একটা, দুইটা, তিনটা...
বাপ্পির শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, চোখ ফেটে পানি পড়ছিলো—ভয়ে না আনন্দে, সেটা সে নিজেও জানে না।
কিন্তু একটা মুহূর্ত আসে... যখন তন্ময়ের কান্না, রাকিবের হাড় ভাঙার শব্দ, আফরিনের মুখ কাটা—সব মিলে বাপ্পির মুখে একটা মুচকি হাসি খেলে গেল।
প্রথমবার... জীবনে প্রথমবার তার মনে হলো সে প্রতিশোধ পেয়েছে।
বাপ্পি: “তুমি... তুমি এটা করেছো?”
অপরিচিত ব্যক্তি: "আমি শুধুই তোমার ইচ্ছার বাস্তব রূপ, বাপ্পি।”
বাপ্পি: “ধন্যবাদ! আমি কখনো ভাবিনি কেউ এমনভাবে আমার পাশে দাঁড়াবে...”
অপরিচিত ব্যক্তি: “তুমি এখন একা নও। তোমার পাশে আমি আছি। আমি তোমার বন্ধু। এই দুনিয়াতে একমাত্র আমিই তোমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত...”
হঠাৎ বাপ্পি দেখতে পেলো, তার ফেসবুকে একটা friend request এসেছে। কিন্তু কোনো নাম নেই। কোনো প্রোফাইল ছবি নেই। সেই অপরিচিত ব্যক্তির profile ছিল এইটা। শুধু একটা কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে আগুনের লাল ছায়া।
সে লিখলো: “তুমি কে?”
একটা রিপ্লাই এল।
“তোমার ভেতরের অন্ধকার... যার নাম দেয় ‘Lucifer’।”
স্ক্রিন হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসে। মনিটরের আলো কমে আসে। কোথা থেকে যেন একটা গন্ধ—জ্বলন্ত কিছু, ধূপের মতো, কিন্তু তাতে মিশে আছে পচা মাংসের দুর্গন্ধ।
বাপ্পির গলা শুকিয়ে যায়। কীবোর্ডে হাত রেখে বসে থাকে নিঃশব্দে।
স্ক্রিনে ভেসে ওঠে শেষ একটি মেসেজ—
Lucifer:“তোমার আত্মা এখন আমার। বিনিময়ে তুমি পেয়েছো শান্তি... আর আমি থাকবো সবসময়.... তোমার পাশে ।”
_______________
সেদিন রাতের পর থেকে বাপ্পি আর স্কুলে যায়নি।
তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা থাকলেও, কেউ আর কখনো তাকে অনলাইনে দেখেনি। শুধু সেই পুরনো প্রোফাইলে একটিই লাইন লেখা—
"He’s not gone. He just crossed over."
অন্যদিকে, রাকিব, তন্ময়, সুমন, আর আফরিন—তারা এখন জীবিত, কিন্তু যেন মৃতের চেয়েও ভয়ানক অবস্থায়।
তাদের চোখে কোনো দৃষ্টি নেই, শুধু ফাঁকা তাকিয়ে থাকে এক দিকে। মুখে কথা নেই, শরীর নড়ে না—তারা দিনের পর দিন একই জায়গায় বসে থাকে, কখনো মাটিতে আঁকিবুঁকি কাটে অদ্ভুত সব প্রতীক দিয়ে। কেউ দেয়ালে নিজের নখ দিয়ে আঁচড় কাটে, কেউ আবার সারারাত শুধু ফিসফিস করে বলে:
“সে আসবে... সে তো কথা দিয়েছে...”
ডাক্তাররা বলে, এটা কোনো মানসিক রোগ না—এটা এমন কিছু, যার কোনো নাম নেই।
তাদের মা-বাবারা অস্থির।
পুলিশ, সাইকিয়াট্রিস্ট, এমনকি ওঝা—সব ঘুরে হতাশ হয়ে গেছে।
রাতের পর রাত ধরে তাদের মা-বাবা রাস্তার মোড়ে, হাসপাতালের করিডোরে, মন্দির-মসজিদে প্রার্থনায় বসে থাকে।
কিন্তু ছেলেরা যেন কারও ডাক শোনে না।
তারা এক অজানা জায়গার দিকে চেয়ে শুধু বলে—
“আমার বন্ধু আসবে... ও আমাকে ছাড়বে না...”
(শেষ )