18/10/2025
📌 নেপালের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি(বহুমত) সম্পাদকের সাক্ষাৎকার-
স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য আমাদের সংগ্রাম হোক অগ্রগতির পথে — পশ্চাদগমন বা স্থবিরতার নয়
— ধর্মেন্দ্র বাস্তোলা ‘কাঞ্চন’
সাম্প্রতিক সময়ে নেপালের রাজনীতি এক অনন্য পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, ভাদ্র ২৩ ও ২৪ তারিখের যুব আন্দোলন সরকার পরিবর্তন করেছে, কিন্তু ক্ষমতার মৌলিক চরিত্র একই রয়ে গেছে। সরকার গঠন ও কার্যক্রম এখনো পুরনো সংবিধানের অধীনেই চলছে। যুব আন্দোলনের মূল লক্ষ্যসমূহ এখনো পূরণ হয়নি, এবং সাধারণ জনগণ ক্রমবর্ধমানভাবে অনুভব করছে যে নেপালকে এক গভীর ভূরাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফাল্গুন ২১ তারিখে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে, এবং নির্বাচন কমিশন সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি শুরু করেছে। সব রাজনৈতিক দল নিজেদের কৌশল নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি রাস্তার ভিত্তিতে সংগঠিত দলসমূহ, যেমন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (বহুমত), তারাও নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য পৃথক বা যৌথ পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে, Janmail.com–এর সম্পাদক এইচ.বি. চন্দ্র নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (বহুমত)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড ধর্মেন্দ্র বাস্তোলা ‘কাঞ্চন’-এর সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার নেন। নিচে প্রশ্নোত্তর আকারে সেই সম্পাদিত অংশ তুলে ধরা হলো।
১. Janmail.com: Janmail.com-এ আপনাকে আন্তরিক স্বাগতম।
♦ কাঞ্চন: ধন্যবাদ।
২. Janmail.com: ভাদ্র ২৩ ও ২৪ তারিখে Gen-Z আন্দোলনের অধীনে যে যুব আন্দোলন ঘটেছিল, আপনি সেটিকে কীভাবে দেখেন?
♦ কাঞ্চন: এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে নেপালে বিদ্রোহ সম্ভব, এবং জনগণ চাইলে দ্রুত ক্ষমতা পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
৩. Janmail.com: এই আন্দোলনকে কি আপনি বিপ্লব হিসেবে দেখেন, নাকি শুধু সরকার পরিবর্তন?
♦ কাঞ্চন: রাজনৈতিকভাবে এটি ছিল এক ধরনের পশ্চাদগমন। তবে আন্দোলনের দিক থেকে এটি একটি নতুন শিক্ষা দিয়েছে। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেছে যে আমাদের দল — নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (বহুমত) — যে কৌশল, নীতি ও দিকনির্দেশনা প্রচার করেছিল, তা সঠিক ছিল।
৪. Janmail.com: কীভাবে সেটি প্রমাণিত হলো? একটু বিশদভাবে বলবেন?
♦ কাঞ্চন: সংসদ ও সমাজে চলমান বিতর্কগুলো আপনি জানেন। আমাদের দলের বিশ্লেষণ ও সংগ্রামও এটি নিশ্চিত করে। কেউ কেউ বলেছিলেন, নেপাল শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের মতো হয়ে যাচ্ছে; অন্যরা তা অস্বীকার করেছিলেন। ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতিকে উপেক্ষা করে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল। যা ঘটেছে, তা আমাদের উদ্বেগকেই সত্য প্রমাণ করেছে — যদি আন্দোলনগুলোকে আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পুনর্গঠিত না করা হয়, তবে এর পরিণতি শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের মতোই হবে।
৫. Janmail.com: তাহলে কি যুবকরা বিদেশি হস্তক্ষেপ চেয়েছিল?
♦ কাঞ্চন: একদমই না। নেপালি যুবকরা বিদেশি হস্তক্ষেপ চায়নি। তারা চেয়েছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সংসদীয় রাজনীতির একচেটিয়া পুঁজিবাদী চরিত্র, শাসক দল ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ও কার্টেল, বিদেশে যুবশক্তির প্রতিদিনের প্রবাস, অর্থনৈতিক শোষণ, ভূমি দখল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ, এবং শত শত সামাজিক বিকৃতি বন্ধ হোক।
তবে, এই অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো বাইরের শক্তিগুলোর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যাতে তারা নিজেদের স্বার্থে পরিস্থিতিকে ব্যবহার করতে পারে। এখান থেকেই যুবসমাজ একটি মূল্যবান শিক্ষা পেয়েছে।
৬. Janmail.com: Gen-Z যুবকদের দাবি কি পূরণ হয়েছে?
♦ কাঞ্চন: না। শুরুতে যুবকদের দাবি ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নির্বাচিত নির্বাহী ব্যবস্থা। পরে তারা দুর্নীতি বন্ধ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পদ রাষ্ট্রীয়করণের দাবি তোলে। এই দাবিগুলোর কোনোটিই পূরণ হয়নি। এগুলো অর্জন করতে হলে বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হতো, যা হয়নি।
৭. Janmail.com: আন্দোলনের মূল সমস্যা কী ছিল?
♦ কাঞ্চন: সমস্যা ছিল স্বাধীন সমন্বয়ের অভাব। আন্দোলনের কোনো যথাযথ নেতৃত্ব বা নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। স্বাধীন সংগঠন ছাড়া জনগণের শক্তিকে একত্রিত করা যায় না। যুবকদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য সাংবিধানিক কমিশন বা গণপরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা ঘটেনি। বর্তমান সংবিধানের আমলাতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও জনগণ-বিরোধী চরিত্র যুবকদের চাহিদা পূরণে সম্পূর্ণ অক্ষম।
৮. Janmail.com: যুবকরা খোলা সামাজিক মাধ্যমের দাবিও তুলেছিল। সেটা কি বাস্তবায়িত হয়েছে?
♦ কাঞ্চন: সামাজিক মাধ্যম কেবল একটি উপাদান ছিল, যা কৌশলগতভাবে সরকারকে চাপ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। তারা আংশিকভাবে এতে সফল হয়েছে।
৯. Janmail.com: আপনার দল বর্তমান দেশের অবস্থা কীভাবে বিশ্লেষণ করছে?
♦ কাঞ্চন: আমাদের পার্টির স্থায়ী কমিটি বেশ কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। যুব আন্দোলন নেপালের অবিচারবিরোধী সংগ্রামেরই একটি ধারাবাহিকতা ছিল — সেই মহা জনযুদ্ধের ধারাবাহিকতা, যা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে যেমন তখন হয়েছিল, তেমনই এখনো সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী শক্তিগুলো আন্দোলনকে বিপথগামী করেছে, একে পশ্চাদগমন ও জাতীয় সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বর্তমানে দেশে তিন ধরনের শক্তি রয়েছে — প্রগতিশীল, স্থিতাবস্থাপনাবাদী (status quo), এবং প্রতিক্রিয়াশীল। এর মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিই এখন প্রধান। নেপালের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তবে জনগণ অগ্রগতি চায় — বিপ্লবী পরিবর্তন ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র।
১০. Janmail.com: তাহলে এখন আপনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে দেখছেন?
♦ কাঞ্চন: বর্তমানে নেপালের রাজনীতি এক সংবেদনশীল ও জটিল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক সংকট এবং বৈদেশিক প্রভাবের তীব্রতায় জর্জরিত। শাসক শ্রেণি ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে যে চরম দুর্নীতি ও দলীয় সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য তৈরি হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এই অবস্থায় জনগণ বিকল্প খুঁজছে, আর সেই বিকল্প কেবল বিপ্লবী পরিবর্তনের পথেই সম্ভব।
১১. Janmail.com: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও আসন্ন নির্বাচনের বিষয়ে আপনার দলের অবস্থান কী?
♦ কাঞ্চন: অন্তর্বর্তী সরকার পুরনো সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেই কাজ করছে, তাই এটি জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নয়। যে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে, তা মূলত একই পুরনো শাসক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার আয়োজন মাত্র। বর্তমান সংবিধান জনগণের জন্য নয় — এটি সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, এবং দালাল শ্রেণির স্বার্থে তৈরি।
আমাদের দল বিশ্বাস করে, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন জরুরি, যা শুধুমাত্র জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব।
১২. Janmail.com: তাহলে আপনার দলের পরিকল্পনা কী?
♦ কাঞ্চন: আমাদের দল জনগণের বিপ্লবী ঐক্য ও রাজনৈতিক বিকল্প গঠনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। আমরা দেশে বিদ্যমান শ্রেণিশোষণ, বৈষম্য, দুর্নীতি ও পুঁজিবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গড়ার আহ্বান জানিয়েছি।
আমাদের লক্ষ্য হলো আদর্শিক, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব দিক থেকে বিপ্লবী আন্দোলনকে পুনর্গঠিত করা। আমরা বিশ্বাস করি, কেবল মার্কসবাদ–লেনিনবাদ–মাওবাদই জনগণকে মুক্তির পথে এগিয়ে নিতে পারে।
১৩. Janmail.com: সাম্প্রতিক আন্দোলনের পর আপনারা কি মনে করেন যে যুবসমাজকে আপনারা পাশে পাচ্ছেন?
♦ কাঞ্চন: অবশ্যই। যুবসমাজের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। তারা আজ বুঝতে পারছে, পুরনো রাজনীতির মধ্যে কোনো সমাধান নেই। তারা দুর্নীতি, বেকারত্ব, বিদেশে শ্রমবাজারে ধাক্কা খাওয়া জীবন থেকে মুক্তি চায়।
আমাদের দায়িত্ব হলো, সেই অগঠিত ও অসংগঠিত যুবশক্তিকে একটি বিপ্লবী সংগঠন ও স্পষ্ট দিকনির্দেশনার আওতায় আনা। এজন্যই আমরা মাওবাদী চিন্তাধারাকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পুনর্জাগরিত করার কাজ করছি।
১৪. Janmail.com: আপনি বললেন, দেশ সাম্রাজ্যবাদী সংকটে পড়েছে। এটি আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
♦ কাঞ্চন: নেপাল ভূরাজনৈতিকভাবে একটি সংবেদনশীল জায়গায় অবস্থিত — ভারত ও চীনের মাঝে, এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কৌশলগত প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে। বিদেশি এনজিও ও আইএনজিওগুলোর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন এবং এর নীতিগুলো এই প্রভাবের ফল। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এমনকি গণমাধ্যম পর্যন্ত বিদেশি প্রভাবের আওতায় চলে গেছে।
আমাদের দল দৃঢ়ভাবে বলছে — এই হস্তক্ষেপ প্রতিহত না করলে নেপালের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মারাত্মক বিপদের মুখে পড়বে।
১৫. Janmail.com: এই পরিস্থিতিতে জনগণের সামনে বিকল্প কী?
♦ কাঞ্চন: বিকল্প একটাই — বিপ্লবী অগ্রগতি। জনগণকে নিজেদের শক্তিতে বিশ্বাস করতে হবে। আমাদের পার্টির স্লোগানই হলো: “স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম হোক অগ্রগতির পথে, পশ্চাদগমন বা স্থবিরতার নয়।”
আমরা জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি — সমস্ত প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক, বামপন্থী ও বিপ্লবী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও দালাল পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ গণফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে।
এটাই হলো আজকের ঐতিহাসিক প্রয়োজন।
ধর্মেন্দ্র বাস্তোলা ‘কাঞ্চন’
সাধারণ সম্পাদক,
নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (বহুমত)