26/06/2025
আমাদের কুঁড়ের ঘরটা তখন হাসিখুশি একটা সংসার। আমি ছিলাম সেই সংসারের ছোট ছেলে, পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে চার নম্বরে।বাবা ছিলেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ, সারাদিন মাঠে কাজ করতেন। তার স্বপ্ন ছিল একটাই – আমরা যেন পড়াশোনা করি, বিশেষ করে আমি। গ্রামের ছোট্ট স্কুলটার ভেতরের প্রতিটি ধুলোবালিও যেন বাবার সেই স্বপ্ন দেখেছিল।
বাবা সব সময় বলতেন, "পড়াশোনা কর বাপ, পড়াশোনা কর। তাহলে আর আমার মতো কষ্ট করতে হবে না।" তার ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি আর হাতে ফোস্কা পড়া দেখলেই আমার বুক ফেটে যেত। জানতাম, কত কষ্ট করে তিনি টাকা ইনকাম করেন। বাবার সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য আমিও মন দিয়ে পড়াশোনা করতাম, এইচএসসি পর্যন্ত কোনোমতে টেনেটুনে পার হলাম।
কিন্তু ভাগ্য বুঝি অন্য কিছু চেয়েছিল। এইচএসসি শেষ হতেই সংসারের হাল ধরতে হলো। পড়াশোনা আর হলো না। অল্প বয়সেই বিয়ে করে সংসারী হলাম। কাঁধে চেপে বসল এক বিশাল বোঝা। বাবার পরিশ্রমের ছাপ আমার জীবনেও পড়তে শুরু করল। বাবা তখনো বেঁচে ছিলেন, কিন্তু তার শরীর ভেঙে গিয়েছিল। আমার কষ্ট দেখে তিনি হয়তো মনে মনে কাঁদতেন, কিন্তু মুখে কিছু বলতেন না। শুধু দেখতাম, তার চোখ দুটো কেমন যেন ছলছল করত।
জীবন ধারণের জন্য আমাকে বিদেশে পাড়ি জমাতে হলো। ভেবেছিলাম, এখানে এসে হয়তো কিছু একটা করতে পারব, পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাতে পারব। কিন্তু ভাগ্য এখানেও বিরূপ হলো। ব্যবসা করতে গিয়ে বড় ধরনের লোকসানে পড়ে গেলাম। সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল।
বিদেশে আসার কিছুদিন পরেই সেই ভয়াল খবরটা এল। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শেষ মুহূর্তে বাবা আমায় দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু টাকার অভাবে আমি দেশে যেতে পারিনি। আমার বটবৃক্ষের মতো ছায়াটা এক মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল, আর আমি শেষবারের মতো বাবাকে দেখতেও পেলাম না। বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি, আর তার শেষ ইচ্ছাটুকুও রাখতে পারিনি – এই কষ্টটা আমাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
আজও আমি পরিবারের কাউকে সেভাবে খুশি করতে পারিনি। আমার ভাই-বোন, স্ত্রী – সবার চোখে একরাশ প্রশ্ন দেখি। কোনো রকমে জীবনটা চলছে। বাবার স্বপ্ন, আমার অসম্পূর্ণ পড়াশোনা, তার শেষ দেখা না পাওয়ার যন্ত্রণা, আর বিদেশে এসে চরম ব্যর্থতা—সব মিলিয়ে আমি যেন এক অসম্পূর্ণ স্বপ্নের কারিগর। তবুও বুকের গভীরে কোথাও একটা ক্ষীণ আশা জিইয়ে রাখি, হয়তো একদিন সব ঠিক হবে। হয়তো একদিন আমি এই ব্যর্থতার গল্পটা বদলে দিতে পারব।