সায়েন্স ফিকশন - Science Fictions
- Página Inicial
- Portugal
- Lisbon
- সায়েন্স ফিকশন - Science Fictions
--সায়েন্স ফিকশন ও কল্পকাহিনী পড়ুন, তত্ত ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আরো বেশি জানুন।
আমাদের পেজে লেখা পাঠানোর বিশেষ কোন নিয়ম নাই। আপনি যদি মনে করেন আপনার লেখা সায়েন্স ফিকশন ভালো, শেয়ার করার মত উপযোগী তাহলে আপনার লেখা আমাদের পেজের ইনবক্স এ পাঠাতে পারেন । কোন কবিতা শেয়ার করা হয়না তাই কবিতা না পাঠালেই ভালো । লেখা পাঠাবার পর অপেক্ষা করুন ২৪ ঘন্টার মধ্যে আপনার মেসেজ সিন না হলে আবার মেসেজ দিন ধন্যবাদ ।
21/09/2023
পারমাণবিক বোমা কতটা ভয়ংকর হয় তার একটি নমুনা।

30/08/2023
জিনোম জনম (২য় পর্ব)
লিখেছেনঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
খাবার টেবিলে তিনা বলল, আজকে খুব বিচিত্র একটা চিঠি এসেছে।
রিশ সুপের বাটি থেকে এক চামচ গরম সুপ মুখে নিয়ে বলল, বিচিত্র?
হ্যাঁ। চিঠিতে কী লেখা জান?
কী?
দাঁড়াও, আমি পড়ে শোনাই। বলে তিনা একটা কাগজ হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে :
আপনি শুনে আনন্দিত হবেন যে শহরতলির শিশুদের মূলধারার জীবনের সাথে পরিচিত করার লক্ষ্যে আয়োজিত একটি প্রোগ্রামে আপনাদের সন্তানকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। সেই প্রোগ্রামের আওতায় আগামী সপ্তাহে তাকে চিড়িয়াখানা, জাদুঘর এবং একটি স্কুলে পরিদর্শনের জন্যে নেয়া হবে। এই পরিদর্শনের যাবতীয় দায়িত্ব নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠান বহন করবে। যোগাযোগ করার জন্যে বিনীত অনুরোধ করা যাচ্ছে।
রিশ মাথা নেড়ে বলল, ভাঁওতাবাজি।
রিকি খুব মনোযোগ দিয়ে তার বাবা-মায়ের কথা শুনছিল। রিশের কথা শুনে বলল, কেন বাবা? এটা ভাঁওতাবাজি কেন? ভাঁওতাবাজি মানে কী?
যখন একটা কিছু বলা হয় কিন্তু উদ্দেশ্য থাকে অন্য কিছু, সেটা হচ্ছে ভাঁওতাবাজি।
এরা ভাঁওতাবাজি কেন করবে?
পার্বত্য অঞ্চলে যে বড়লোক মানুষগুলো থাকে তারা আসলে অন্যরকম। আমাদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা কখনোই আমাদের জন্যে ভালো কিছু করে না।
কেন করে না বাবা?
আমাদেরকে তারা তাদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে না। তাই হঠাৎ করে যদি দেখি তাদের আমাদের বাচ্চাদের জন্যে মায়া উথলে উঠেছে তা হলে বুঝতে হবে এর ভেতরে অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে।
তিনা রিকির প্লেটে এক টুকরো রুটি তুলে দিয়ে বলল, তা হলে তুমি এখানে রিকিকে পাঠাতে চাও না?
রিশ আরো এক চামচ সুপ খেয়ে বলল, কেমন করে পাঠাব? সামনের সপ্তাহে আমাদের ফ্যাক্টরির একটা জরুরি চালান সামাল দিতে হবে-আমি কেমন করে রিকিকে নিয়ে যাব?
তিনা বলল, আসলে আমি যোগাযোগ করেছিলাম। মানুষগুলো বলেছে তারাই নিয়ে যাবে, সবকিছু দেখিয়ে ফিরিয়ে দেবে। দুই দিনের প্রোগ্রাম, প্রথম দিন চিড়িয়াখানা আর মিউজিয়াম। দ্বিতীয় দিন স্কুল।
রিশ কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। রিকি ডাকল, বাবা।
বল।
আমি যেতে চাই বাবা।
যেতে চাস?
হ্যাঁ। আমি কোনোদিন চিড়িয়াখানা দেখি নি।
রিশ বলল, দেখিস নি সেটা খুব ভালো। দেখলে মন খারাপ হয়ে যাবে।
কেন বাবা? মন খারাপ কেন হবে?
তুই যখন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াস তখন দেখেছিস সেখানে পশুপাখিগুলো মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। চিড়িয়াখানায় সেই একই পশুপাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখে।
তিনা হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি একটু বেশি বেশি বলছ। বনে জঙ্গলে রিকি আর কয়টা পশুপাখি দেখেছে? চিড়িয়াখানায় কত রকম প্রাণী আছে! বাঘ সিংহ হাতি জলহস্তী সাপ কুমির-কী নেই?
রিকি আবার বলল, বাবা আমি চিড়িয়াখানা দেখতে চাই।
রিশ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চিড়িয়াখানা জাদুঘর ঠিক আছে। আমার আসল আপত্তিটা হচ্ছে স্কুলে।
কেন বাবা? স্কুলে আপত্তি কেন?
বড়লোকের ছেলেমেয়েদের স্কুল-দেখে তোর মন খারাপ হবে। তোক তো আমরা স্কুলেই পাঠাতে পারি না-কোনো স্কুলই নেই তোর জন্যে!
রিকি মাথা নাড়ল, না বাবা। আমার মন খারাপ হবে না।
রিশ কিছুক্ষণ রিকির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সত্যিই যেতে চাস?
হ্যাঁ বাবা।
ঠিক আছে। যা তা হলে। মনে হয় জীবনে সব রকমেরই অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। হলই না হয় একটা খারাপ অভিজ্ঞতা।
তিনা মৃদু কণ্ঠে বলল, রিশ। তুমি যদি আসলেই না চাও তা হলে রিকিকে পাঠানোর কোনো দরকার নেই। আমরাই কখনো একবার রিকিকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব হয়।
থাক। যেতে চাইছে যখন যাক।
রিকি খাবার টেবিলে বসে তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। আনন্দের হাসি।
১১.
গাড়িটা একটা বড় বিল্ডিংয়ের সামনে থামতেই রিকি তার পাশে বসে থাকা ক্ৰানাকে জিজ্ঞেস করল, এটা চিড়িয়াখানা?
ক্ৰানা ইতস্তত করে বলল, না। এটা চিড়িয়াখানা না।
আমাদের আগে না চিড়িয়াখানায় যাবার কথা? তারপর জাদুঘর?
কানা জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, আসলে পরিকল্পনায় একটু পরিবর্তন হয়েছে। দুই দিনের প্রোগ্রাম ছিল সেটাকে একদিনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তার মানে আমরা চিড়িয়াখানায় যাব না? জাদুঘরে যাব না?
ক্ৰানা শুকনো গলায় বলল, না। আমরা শুধু দ্বিতীয় দিনের প্রোগ্রামে যাব। সেজন্যে এই স্কুলে এসেছি।
রিকির চোখে-মুখে আশা ভঙ্গের একটা স্পষ্ট ছাপ এসে পড়ল, সে সেটা লুকানোর চেষ্টা করল না। ক্রানার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে আমার বাবা আসলে ঠিকই বলেছিল।
ক্ৰানা ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার বাবা কী বলেছিল?
আমার বাবা বলেছিল, আসলে পুরোটা ভাঁওতাবাজি।
ক্রানা ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, কেন? ভাঁওতাবাজি কেন হবে?
কেউ যদি একটা জিনিসের কথা বলে অন্য একটা জিনিস করে সেটাকে বলে ভাঁওতাবাজি। তোমরা ভাঁওতাবাজি করেছ।
ক্ৰানা কঠিন গলায় বলল, বাজে কথা বোলা না ছেলে।
আমার নাম রিকি।
ঠিক আছে রিকি। এস আমার সাথে।
রিকি ক্ৰানার পিছু পিছু হেঁটে যায়। সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠে, করিডোর ধরে হেঁটে যায় এবং শেষে একটা বড় ঘরের সামনে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতরে মাঝামাঝি বেশ কয়েকটা ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল সেখানে রিকির বয়সী ছেলেমেয়েরা বসে আছে। তাদের সামনে হাসি খুশি চেহারার একজন মহিলা কথা বলছিল। ক্রানার সাথে রিকিকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল। গলার স্বরে একটা আনন্দের ভাব ফুটিয়ে বলল, এস। এস তুমি, ভেতরে এস। তারপর সামনের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ সবাই। আজকে তোমাদের সাথে কে এসেছে। একটা ছেলে। তোমাদের বয়সী একটা ছেলে।
ক্ৰানা রিকির হাত ধরে ক্লাস ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে। ছোট ঘোট চেয়ার-টেবিলে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিকির দিকে তাকিয়ে রইল-রিকি ঠিক কী করবে বুঝতে পারে না। এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।
হাসি-খুশি মহিলাটি বলল, তোমাদের মনে আছে এ সপ্তাহে আমরা কী নিয়ে আলোচনা করছিলাম? বুদ্ধিমত্তা! শুরু করেছি মাছ দিয়ে, একটা এঞ্জেল ফিশ আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি। তারপর ছিল একটা গিরগিটি। শীতল দেহের এক ধরনের সরীসৃপ। এরপর ছিল পাখি, দেখে বোঝা যায় না কিন্তু আমরা আবিষ্কার করেছি পাখির বুদ্ধিমত্তা অনেক। পাখির পরে ছিল বুদ্ধিমত্তার উপরের দিকের একটা প্রাণী, সেটা কুকুর ছানা। সেটাকে নিয়ে আমাদের অনেক মজা হয়েছে। তাই না?
কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে বাচ্চাগুলো হাসি-খুশি মহিলার কথায় সাড়া দিল না। মহিলাটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কুকুর ছানার পর আমরা এনেছি শিম্পাঞ্জি। তোমাদের বলেছি শিম্পাঞ্জির জিনোম শতকরা নিরানব্বই ভাগ আমাদের মতো কাজেই তার বুদ্ধিমত্তাও অনেকটা আমাদের মতো। শিম্পাঞ্জির পর আমরা এনেছি একটা ছেলে! তোমরা আজকে এই ছেলেটার বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করবে। ঠিক আছে?
এবারেও সামনে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো হাসি-খুশি শিক্ষিকার কথার উত্তর দিল। মহিলাটি অবিশ্যি সেটি নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, এই ছেলেটিকে আমরা তোমাদের সাথে রেখে যাচ্ছি। এই ছেলেটির সাথে তোমাদের একটা খুব বড় পার্থক্য আছে। সেটি কী। বলতে পারবে?
পার্থক্যটা কী বাচ্চাগুলো অনুমান করতে পারছিল কিন্তু তবু কেউ উত্তর দিল না। হাসি খুশি মহিলা বলল, পার্থক্যটা হচ্ছে তোমাদের জিনোমে। এই ছেলেটির জিনোম সাধারণ তোমাদের জিনোম অসাধারণ। এই ছেলেটির জিনোম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই-তোমাদের আছে। আমি চাই তোমরা সবাই মিলে এই ছেলেটিকে পরীক্ষা কর। তোমরা সারা দিন পাবে, বিকেলে আমি তোমাদের রিপোর্ট নেব। ঠিক আছে?
বাচ্চাগুলো এবারেও হাসি-খুশি মহিলার কথার উত্তর দিল না।
শিক্ষিকা আর ক্রানা চলে যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল। রিকি নিজের ভেতরে এক ধরনের অপমান, ক্রোধ এবং দুঃখ অনুভব করে। তার ছোট জীবনে এর আগে কখনোই সে এরকম অনুভব করে নি। সে কী করবে বুঝতে পারছিল না ইচ্ছে করছিল ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু সে জানে তার ছুটে পালিয়ে যাবার কোনো জায়গা নেই। রিকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘরটা পরীক্ষা করল, ঝকঝকে আলোকোজ্জ্বল একটা ঘর। বড় বড় জানালা, উঁচু ছাদ। ঘরের পাশে নানা ধরনের সৃজনশীল খেলনা। ছবি আঁকার ইজেল, কম্পিউটার, বড় বড় মনিটর এবং যন্ত্রপাতি। সামনে বসে থাকা বাচ্চাগুলোকে সে এবারে লক্ষ করে। সবাই তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। রিকি কী করবে বুঝতে না পেরে বলল, এটা। একটা ভাঁওতাবাজি।
নীল জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ?
আমি বলেছি এটা একটা ভাঁওতাবাজি।
ভাঁওতাবাজি?
হ্যাঁ।
ভাঁওতাবাজি মানে কী?
একটা জিনিস করার কথা বলে অন্য একটা জিনিস করাকে বলে ভাঁওতাবাজি।
কালো চুলের মেয়েটি বলল, তোমার সাথে একটা জিনিস করার কথা বলে অন্য জিনিস করেছে?
হ্যাঁ। রিকি বলল, আমাকে বলেছিল চিড়িয়াখানা নিয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে না এনে এখানে এনেছে। ভাঁওতাবাজি করেছে।
লাল চুলের মেয়েটি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বড়রা সব সময়েই ভাঁওতাবাজি করে। তাই না?
অনেকেই রাজি হয়ে মাথা নাড়ল। কোন বড় মানুষ কার সাথে কী ভাঁওতাবাজি করেছে সেটা নিয়ে সবাই কথা বলতে রু করছিল তখন ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলের ছেলেটা বলল, ভালোই হয়েছে তোমাকে চিড়িয়াখানায় নেয় নাই। জায়গাটা খুবই হাস্যকর। খুবই দুর্গন্ধ। বাঘ সিংহ হাতি বাথরুম করে রাখে তো।
ছেলেটার কথা শুনে অনেকেই হেসে উঠল। একজন বলল, কিন্তু চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচাটা অনেক মজার। বানরগুলো অনেক বদরামো করে। দেখে কী মজা লাগে! তাই না?
রিকি বলল, আমি বানরের বাঁদরামো দেখেছি।
কোথায় দেখেছ?
আমাদের বাসা থেকে জঙ্গলে যাওয়া যায়। সেখানে বানর আছে। ছোট একটা। বানরের বাচ্চা আমার খুব বন্ধু।
সাথে সাথে সবগুলো বাচ্চা চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর নীল জিজ্ঞেস করল, বানরের বাচ্চা তোমার বন্ধু?
হ্যাঁ।
বানরের বাচ্চা কেমন করে তোমার বন্ধু হল? তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছ। তাই না?
রিকি মুখ শক্ত করে বলল, আমি মোটেও বানিয়ে বানিয়ে বলছি না। আমার সাথে চল, আমি তোমাকে এখনই দেখাব।
বাচ্চাগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। একজন বলল, কী দেখাবে?
বানরের বাচ্চাটা আমার বন্ধু আমি সেটা দেখাব। আমাকে দেখলেই সেটা আমার কাছে এসে ঘাড়ে বসে। কথা বলে।
কথা বলে? নীল বলল, মিথ্যা কথা।
মোটেও মিথ্যা কথা না।
তোমার সাথে কী কথা বলে?
কিচিমিচি করে বলে, আমি বুঝি না।
বাচ্চাগুলো এতক্ষণ তাদের চেয়ারে বসেছিল, এবারে কয়েকজন উঠে এল, রিকিকে কাছে থেকে দেখল। কালো চুলের মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?
রিকি। তোমার নাম কী?
মাতিষা।
নীল এগিয়ে এসে বলল, আমার নাম নীল।
আমার নাম কিয়া।
আমার নাম লন- হঠাৎ করে সবাই একসাথে নিজের নাম বলতে শুরু করল, রিকি খুক করে হেসে বলল, আমি তোমাদের সবার নাম মনে রাখতে পারব না।
কোনো দরকার নাই মনে রাখার। আমরা যদি একসাথে খেলি তা হলেই নাম মনে হয়ে যাবে। তাই না?
সবাই মাথা নাড়ল।
লাল চুলের মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, কী খেলবে নীল।
রকেট মেশিন খেলতে পারি। নীল রিকিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি রকেট মেশিন খেলা জানো?
না।
তা হলে কোনটা জান?
আমি কোনো খেলা জানি না।
তুমি কোনো খেলা জান না?
না।
তা হলে তুমি কী কর?
আমি জঙ্গলে বেড়াই। না হলে হ্রদে ভেলা নিয়ে ভাসি। মাঝে মাঝে আকাশে উড়ি।
কী কর? মাতিষা নামের মেয়েটা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী কর তুমি?
আকাশে উড়ি।
তুমি কি পাখি যে আকাশে উড়ো?
রিকি হেসে বলল, ধুর বোকা! আমি কি বলেছি আমি পাখির মতো পাখা দিয়ে উড়ি? আমি গ্লাইডার দিয়ে উড়ি!
নীল মাথা নেড়ে বলল, গ্লাইডার! কী দারুণ!
হ্যাঁ। আমার বাবা বানিয়েছে। ভেতরে ঝুলে পাহাড়ের ওপর থেকে ছুটে লাফ দিতে হয় তখন সেটা আকাশে ভেসে ভেসে নিচে নামে। দুপুরবেলা যদি গরম বাতাস ওপরে উঠতে থাকে তখন অনেকক্ষণ আসা যায়।
কিয়া নামের মেয়েটা বলল, তোমার ভয় করে না।
রিকি হিহি করে হেসে বলল, ধুর! বোকা মেয়ে! ভয় করবে কেন? গ্লাইডার কখনো পড়ে যায় না। কিন্তু আমার মা ভয় পায়।
কিয়া গম্ভীর মুখে বলল, তয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
রিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমার মা অনেক কিছু ভয় পায়। মাকড়সাকে ভয় পায়। টিকটিকিকে ভয় পায়। সাপকে ভয় পায়।
মাতিষা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সাপকে ভয় পাও না?
কেন ভয় পাব?
যদি কামড় দেয়।
কেন কামড় দেবে শুধু শুধু? সাপকে বিরক্ত না করলে সে মোটেও কামড়াবে না। তা ছাড়া এখানে যে সাপ থাকে তাদের বিষ নেই।
তুমি কেমন করে জান?
জানি। আমি তো জঙ্গলে ঘুরি–সেই জন্যে এগুলো জানতে হয়।
নীল তীক্ষ্ণ চোখে রিকির দিকে তাকিয়েছিল এবারে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা যদি তোমার সাথে জঙ্গলে যেতে চাই, গ্লাইডারে উড়তে চাই তুমি আমাদের নেবে?
কেন নেব না।
মাতিষা মাথা নাড়ল, বলল, বড়রা আমার কোনোদিন যেতে দেবে না। বলবে। সিমুলেশনে নাই।
কিয়া বলল, আমার আর সিমুলেশন মতো চলতে ইচ্ছা করে না।
আমারও করে না।
নীল বলল, চল আমরা সবাই রিকির সাথে পালিয়ে যাই।
সবাই চোখ বড় বড় করে নীলের দিকে তাকাল, পালিয়ে যাবে?
হ্যাঁ। আমার খুবই গ্লাইডারে উড়ার ইচ্ছে করছে।
কিয়া বলল, আমার বানরের বাচ্চা দেখার ইচ্ছে করছে। সেটা খামচি দেবে না তো?
রিকি বলল, আমার সাথে থাকলে দেবে না।
মাতিষা বলল, আমার ভেলায় উঠতে ইচ্ছে করছে। ভেলা ডুবে যাবে না তো?
রিকি দাঁত বের করে হাসল, বলল, ভেলা কখনো ডুবে না। নৌকা ডুবে যায় কিন্তু ভেলা ডুবে না।
মাতিষা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি শুধু টেলিভিশনে হ্রদের ছবি দেখেছি। সত্যিকারের হ্রদ দেখি নাই। হ্রদ দেখতে কি খুবই সুন্দর?
রিকি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। খুবই সুন্দর। হ্রদের নিচে একটা শহর ডুবে আছে। সেটা দেখলে তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তোমরা সাঁতার জানো তো?
জানি। কিন্তু আমি শুধু সুইমিংপুলে সাঁতার কেটেছি। পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ। ইয়াক থুঃ!
হ্রদের পানিতে কোনো গন্ধ নাই।
মাতিষা মুখ শক্ত করে বলল, আমিও পালাতে চাই।
নীল বলল, কারা কারা পালাতে চাও হাত তুল।
রিকি অবাক হয়ে দেখল সবাই হাত তুলেছে। নীল গম্ভীর হয়ে বলল, চমৎকার! তা হলে একটা পরিকল্পনা করতে হবে। বড়রা কোনোদিনও আমাদের পালাতে দিবে না।
লন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। তারা সিমুলেশনের বাইরে কিছুই করতে চায় না।
শান্তশিষ্ট চেহারার একজন বলল, যদি বড়রা আমাদের ওপর রাগ হয়?
তা হলে আমরাও বড়দের ওপর রাগ হব। বলব, আমরা সিমুলেশন মানি না। তখন সবাই ভয় পেয়ে যাবে। তারা সিমুলেশনকে খুব ভয় পায়।
মাতিষা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বড়রা খুবই বোকা।
সবাই মাথা নাড়ল, একজন বলল, হ্যাঁ, তাদের বোকামির তুলনা নেই।
নীল ভুরু কুঁচকে বলল, রবিবার।
রবিবার কী?
আমরা রবিবার পালাব। মনে আছে রবিবার আমাদের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট দেখতে যাওয়ার কথা?
হ্যাঁ। মনে আছে।
আমরা সেখানে না গিয়ে রিকির বাসায় চলে যাব।
কীভাবে?
নীল দাঁত বের করে হাসল, বলল, চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করব।
অন্যেরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ চিন্তা করে বুদ্ধি বের করব।
চল, এখন তা হলে আমরা খেলি।
এস, আমরা রিকিকে রকেট মেশিন খেলাটা শিখিয়ে দেই।
হ্যাঁ। রকেট মেশিন খুবই মজার একটা খেলা।
কিয়া মনে করিয়ে দিল, আমাদের যে রিকির বুদ্ধিমত্তার ওপর একটা রিপোর্ট লিখতে হবে?
সেটা আমরা বানিয়ে বানিয়ে লিখে ফেলব।
কিয়া দাঁত বের করে হেসে বলল, তারা বুঝতেও পারবে না যে আমরা বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি!
এরপর সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রকেট মেশিন খেলতে শুরু করল, যা একটা মজা হল সেটা বলার মতো নয়।
১২.
হাসি-খুশি শিক্ষিকার কাছে বাচ্চাগুলো যে রিপোর্টটি দিল সেটা ছিল এরকম :
রিকি নামের ছেলেটির বুদ্ধিমত্তা খুবই নিচু শ্ৰেণীর। সে আমাদের বলেছে তার সাথে ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে। ভাঁওতাবাজি শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক নয় এই ছেলেটা সেটা জানে না। তাকে বলা হয়েছিল যে তাকে চিড়িয়াখানা এবং জাদুঘরে নেয়া হবে কিন্তু সেখানে না নিয়ে তাকে আমাদের স্কুলে আনা হয়েছে। ছেলেটির বুদ্ধিমত্তা খুবই কম কারণ সে বুঝতে পারে নাই যে তাকে আসলে কখনোই চিড়িয়াখানা নেয়া হবে না। সে নিম্নাঞ্চলের একজন সাধারণ ছেলে তাকে চিড়িয়াখানায় নেয়ার কোন কারণ নেই–এই অতি সাধারণ বিষয়টাই তার বোঝার কোনো ক্ষমতা নেই। বড় মানুষেরা সব সময়েই আমাদেরকে ন্যায়নীতির কথা বলে কিন্তু তারা নিজেরা সেগুলো বিশ্বাস করে না এবং তারা সেগুলো পালন করে না। আমাদের বুদ্ধিমত্তা চল্লিশ থেকে আশি ইউনিটের ভেতর তাই আমরা এই ব্যাপারগুলো চট করে বুঝে ফেলি। কিন্তু রিকি নামক ছেলেটা সেটা বুঝতে পারে। নাই কারণ তার বুদ্ধিমত্তা খুবই কম।
আমরা আমাদের সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে স্কুলে লেখাপড়া করি বলে আমাদের প্রতিভার বিকাশ হচ্ছে। রিকির প্রতিভা বিকাশের কোনো সুযোগ নেই কারণ সে কখনো স্কুলে যেতে পারে না। সময় কাটানোর জন্য সে জঙ্গল পাহাড় এবং হ্রদে ঘুরে বেড়ায়, বানরের সাথে তার বন্ধুত্ব। যার বানরের সাথে বন্ধুত্ব তার বুদ্ধিমত্তা নিশ্চয়ই খুব কম।
রিকি কোনো অ্যালজেবরা জানে না, কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে না, টাচ প্যাড ব্যবহার করে ছবি আঁকতে পারে না, রকেট মেশিন বা অন্য কোনো খেলা জানে না। এরকম কোনো ছেলে থাকা সম্ভব আমরা সেটি জানতাম না, রিকিকে নিজের চোখে দেখে এটা আমরা জানতে পেরেছি…
হাসি-খুশি শিক্ষিকা পুরো রিপোর্টটি মন দিয়ে পড়ে একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। রিপোর্টটিতে একটুও ভুল তথ্য নেই কিন্তু পড়ে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। মনে হয় এখানে যা লেখা হয়েছে তার বাইরেও কিছু একটা আছে। পুরো রিপোর্টটি যেন এক ধরনের তামাশা ছোট ছোট বাচ্চাগুলো যেন বড় মানুষদের নিয়ে এক ধরনের তামাশা করছে।
ঠিক কোথায় সেটা ধরতে পারছে না।
হাসি-খুশি শিক্ষিকা অনেক দিন পর হঠাৎ করে একটু বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে না ঠিক কোথায় কিন্তু মনে হতে থাকে কোথায় যেন একটা কিছু ঠিক নেই।
১৩.
স্কুল বাসটি সময়মতো ছেড়ে দিল। আজ রবিবার, বারো জন অত্যন্ত প্রতিভাবান শিশুকে স্থানীয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে নিয়ে যাবার কথা। বারো জন শিশু তাদের বাসে শান্ত হয়ে বসে আছে, তাদের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই অত্যন্ত উত্তেজিত। সবাই পরিকল্পনা করে অজি রিকির কাছে পালিয়ে যাবে।
বাস ড্রাইভার তার জি.পি.এসে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের ঠিকানা প্রবেশ করিয়ে বাসটি চালাতে শুরু করে। যেদিকে যাবার কথা বাসটি সেদিকেই যেতে থাকে, ড্রাইভার স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে বাসটাকে শুধু নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখে।
নীল এরকম সময়ে তার পকেট থেকে ছোট কম্পিউটারটা বের করে, আজকে তার সাথে সে একটা ওয়্যারলেস ইন্টারফেস লাগিয়ে এনেছে। বাসের পিছনে বসে সে বাস ড্রাইভারের জি.পি.এসে গন্তব্য স্থানটি পাল্টে দিল-নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের পরিবর্তে নগর কেন্দ্রের রেলস্টেশন। বাস ড্রাইভার জানতেও পারল না সে বারোটি অসম্ভব প্রতিভাবান বাচ্চাকে রেলস্টেশনে নিয়ে যাচ্ছে।
নীল এবারে সবাইকে কাছাকাছি ডাকল-তারা কাছে আসতেই সে ফিসফিস করে বলল, সবার মনে আছে তো কী করতে হবে?
মাতিষ ঝঙ্কার দিয়ে বলল, মনে থাকবে না কেন?
নীল মুখটা গম্ভীর করে বলল, এটা আমাদের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার কাজেই কোনো যেন ভুল না হয়। রেলস্টেশনে থামতেই আমি ইলেকট্রনিক বোতাম টিপে দরজা খুলে দেব এক দৌড়ে সবাই নেমে যাবে। যাবার সময় বলব আমরা যাচ্ছি শপিং সেন্টার আসলে শপিং সেন্টারের পাশ দিয়ে যাব রেলস্টেশন।
মাতিষা বলল, জানি। আমরা সব জানি।
নীল মাথা নেড়ে বলল, তবু আরেকবার পুরোটা ঝালাই করে নেই। স্টেশন কাউন্টারে গিয়ে সবাই ভিড় করে দাঁড়াবে, হইচই করে টিকেট কিনবে বিনোদন পার্কের। মনে আছে তো?
মনে আছে। মনে আছে।
ঠিক এই সময়ে আমি আর কিয়া ঘুরে ঘুরে মেশিনগুলো থেকে তেতাল্লিশ নম্বর স্টেশনের টিকেট কিনব। সেটা হচ্ছে রিকির এলাকার স্টেশন। ঠিক আছে?
ঠিক আছে!
তারপর আমরা সবাই মিলে একসাথে ছুটতে ছুটতে হাসতে হাসতে বিনোদন পার্কের কথা বলতে বলতে যাব-কাজেই সবাই ধরে নেবে আমরা যাচ্ছি বিনোদন পার্কে। পরে যখন আমাদের খোঁজ করতে আসবে সবাই যাবে বিনোদন পার্কে।
কিয়া হিহি করে হেসে বলল, কী মজাটাই না হবে!
হ্যাঁ। নীল গম্ভীর হয়ে বলল, যদি সবকিছু ঠিক ঠিক করে করতে পারি তা হলে অনেক মজা হবে।
লন বলল, এবারে বাকিটা আরেকবার বলে দাও।
বাকিটা সোজা। একসাথে আমাদের বারো জনকে দেখলেই সেটা সবাই মনে রাখবে তাই আমরা প্ল্যাটফর্মের দিকে রওনা দেবার সময় আলাদা হয়ে যাব। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সাত নম্বর ট্র্যাক। আমরা সেখানে পৌঁছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাব, যেন কেউ কাউকে চিনি না। সবাই উঠব আলাদা আলাদা বগিতে। কেউ আমাদের আলাদা করে লক্ষ করবে না।
নীল হাতের কম্পিউটারটা একবার দেখে বলল, তেতাল্লিশ নম্বর স্টেশনে নেমে সবাই বাইরে চলে আসবে রিকি বলেছে বাকি দায়িত্ব তার।
মাতিষা বলল, যদি রিকি বাকিটা করতে না পারে?
পারবে না কেন? নিশ্চয়ই পারবে। সেদিন দেখ নাই রিকির কত বুদ্ধি? আমাদের সবার যত বুদ্ধি রিকির একার তত বুদ্ধি।
মাতিষা মাথা নাড়ল। বলল, তার অনেক সুবিধা-সে বনে জঙ্গলে ঘুরে মাথার বুদ্ধি বাড়াতে পারে। আমরা শুধু একটা ঘরে বসে থাকি আমাদের কপালটাই খারাপ।
লন বলল, আর কপাল খারাপ থাকবে না। আমরাও এখন থেকে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব।
নীল তার কম্পিউটারের দিকে চোখ রাখছিল, সে এবারে চাপা গলায় বলল, সবাই এখন নিজের সিটে যাও, আমরা রেলস্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছি। আর মনে রেখো সবার ভিডিফোন বন্ধ করে দাও কেউ যেন আমাদের ট্র্যাক করতে না পারে।
সবাই নিঃশব্দে নিজেদের সিটে গিয়ে বসল, তাদের মুখের দিকে তাকালে কেউ বুঝতেও পারবে না যে কিছুক্ষণের ভেতরেই তারা এত বড় একটা কাও কল্পতে যাচ্ছে।
ঠিক এরকম সময় বাস ড্রাইভার ব্রেক কষে বাসটা থামিয়ে একটা বিস্ময়ের শব্দ করল। নীল জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে!
আশ্চর্য ব্যাপার! বিশাল দেহের ড্রাইভার হাত নেড়ে বলল, আমি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে রওনা দিয়েছিলাম-চলে এসেছি রেলস্টেশনে!
নীল এবং তার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল। ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, কী হল? তোমরা সবাই উঠেছ কেন? বস। যার যার সিটে বস।
নীল ইলেকট্রনিক সুইচটা টিপে ধরতেই শব্দ করে বাসের দুটি দরজা খুলে গেল। সবাই হুড়মুড় করে নামতে থাকে, বাস ড্রাইভার চোখ কপালে তুলে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতে থাকে-–সিট বেল্টে বাধা বাস ড্রাইভার তার বেন্ট খুলে উঠতে উঠতে যেটুকু সময় লাগে তার মাঝে সবাই বাস থেকে নেমে ছুটতে শুরু করেছে। বাস ড্রাইভার আতঙ্কিত মুখে বলল, কোথায় যাও তোমরা? কোথায় যাও?
শেষ ছেলেটি গলা উঁচিয়ে বলল, শপিং সেন্টার। তারপর মুহূর্তের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বাস ড্রাইভার কী করবে বুঝতে না পেরে বাসের সিঁড়িতে বসে পড়ে। পকেট থেকে ভিডিফোন বের করে সে কাঁপা হাতে ডায়াল করতে থাকে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বাচ্চাগুলো এই বাস থেকে নেমে গেছে, আজকে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে। শুধু তার না, আরো অনেকের সর্বনাশ হবে!
১৪.
গুস্তাভ তার পিকআপ ট্রাকের পিছনের টায়ারে একটা লাথি দিয়ে সেটাকে পরীক্ষা করে মুখ দিয়ে সন্তুষ্টির একটা শব্দ করে রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি সত্যি তোমার বন্ধুরা আসবে তো?
রিকি হাতে কিল দিয়ে বলল, একশবার আসবে।
এত ছোট ছোট বাচ্চা কেমন করে আসবে? কোনো ঝামেলায় না পড়ে যায়!
রিকি দাঁত বের করে হাসল, বলল, ছোট বাচ্চা হলে কী হবে? তাদের মাথার বুদ্ধি বড় মানুষ থেকে অনেক বেশি।
গুস্তাভ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সেইটাই হচ্ছে বিপদ। ছোট মানুষের বুদ্ধি যদি বড় মানুষ থেকে বেশি হয় তা হলে সেইটা খুব বড় বিপদ।
কেন বড় বিপদ কেন?
বড় মানুষেরা ভুল করে আর সেই জন্যে ছোট মানুষদের একশ রকম ঝামেলা হয়।
ঠিক এই সময় একটা ট্রেনের চাপা গর্জন শোনা গেল, মাটিতে একটা মৃদু কম্পন শোনা যায় এবং একসময় শব্দটা মিলিয়ে আসে।
গুস্তাভ পিচিক করে রাস্তার পাশে থুতু ফেলে বলল, নয়টা বাহান্নর ট্রেন এসেছে। দেখা যাক তোমার বন্ধুরা আসতে পেরেছে নাকি!
কিছুক্ষণ পরেই প্যাসেঞ্জাররা বের হয়ে আসতে থাকে এবং তাদের মাঝে ছোট একটা বাচ্চাকে গুটিগুটি এগিয়ে আসতে দেখা গেল। বাচ্চাটির চোখে-মুখে উদ্বেগের একটা চিহ্ন স্পষ্ট, রাস্তার পাশে রিকিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তে তার সমস্ত উদ্বেগ দূর হয়ে গেল। বাচ্চাটি ছুটে রিকির কাছে এসে বলল, তুমি এসেছ? আমরা যা দুশ্চিন্তায় ছিলাম!
রিকি বলল, কোনো দুশ্চিন্তা নাই। পিকআপ ট্রাকের পিছনে উঠে শুয়ে পড় যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়!
বাচ্চাটি পিকআপ ট্রাকের পিছনে উঠতে উঠতেই একজন দুইজন করে অন্য বাচ্চারাও উদ্বিগ্ন মুখে বের হতে শুরু করল। রিকি তাদের সবাইকে পিকআপ ট্রাকের পিছনে তুলতে থাকে। সবার শেষে এল নীল, সে ছুটে এসে রিকির হাত ধরে বলল, সবকিছু ঠিক আছে?
রিকি বুড়ো আঙুল উপরে তুলে বলল, শতকরা একশ দশ ভাগ!
চমৎকার। চল তা হলে যাই।
পিকআপ ট্রাকের মেঝেতে সবাই গাদাগাদি করে শুয়ে আছে, গুস্তাভ সবাইকে একনজর দেখে গোঁফে একবার হাত বুলিয়ে বলল, এই ট্রাকে করে আমি শহরে হাঁস-মুরগি নিয়েছি, শাক-সবজি নিয়েছি, বালু-পাথর নিয়েছি কিন্তু এরকম কার্গো কখনো নিই নি!
রিকি বলল, ভালোই তো হল এখন তোমার লিস্টিটা আরো বড় হল!
তা হয়েছে কিন্তু ধরা না পড়ে যাই।
ধরা পড়বে না গুস্তাভ। আমরা সবাই মাথা নিচু করে শুয়ে থাকব কেউ দেখবে না।
গুস্তাভ পিকআপের পিছনের ডালাটা বন্ধ করতে করতে বলল, শহরতলিটা পার হলেই সোজা হয়ে বসতে পারবে। জঙ্গলের রাস্তায় আজকাল কোনো মানুষজন যায় না।
পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় পিকআপ, ঝাঁকুনিতে সবার শরীর থেকে হাড় এবং মাংস আলাদা হয়ে যাবার অবস্থা কিন্তু কেউ সেটা নিয়ে কোনো অভিযোগ করল না। বরং তারা হাসিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল, দেখে মনে হতে লাগল খানাখন্দে ভরা রাস্তায় লক্কড়ঝক্কড় একটা পিকআপে করে ঝাঁকুনি খেয়ে খেয়ে তার মেঝেতে শুয়ে থেকে যাবার মতো আনন্দ বুঝি আর কিছুতে নেই।
কিছুক্ষণের মাঝেই ড্রাইভিং সিট থেকে গুস্তাভ চিৎকার করে বলল, এখন তোমরা উঠে বসতে পার। জঙ্গলের রাস্তায় চলে এসেছি।
সাথে সাথে সবাই উঠে বসে, বাতাসে তাদের চুল উড়তে থাকে, তারা সবিস্ময়ে বাইরে তাকায়। দুই পাশে ঘন অরণ্য একসময় সেখানে মানুষের বসতি ছিল হঠাৎ করে ঝোঁপঝাড় লতাগুলো ঢাকা একটি দুটি ধসে যাওয়া বাড়িঘর সেটি মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে রাস্তা খারাপ থের্কে আরো খারাপ হতে থাকে। বড় একটা ঝাঁকুনি খেয়ে পিকআপের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবার পর গুস্তাভ রাস্তার পাশে পিকআপটা থামিয়ে বলল, আমার গাড়ি আর যাবে না! তোমাদের এখানেই নামতে হবে গো।
সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, পিকআপের ডালাটা খোলা মাত্রই তারা লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করে। একজন আরেক জনকে ধাক্কা দিতে দিতে তারা সবিস্ময়ে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকে। নীল পুরো পিকআপটা একপাক ঘুরে দেখে নিয়ে গুস্তাভকে জিজ্ঞেস করল, তোমার এই গাড়িটা কোন বছরের?
গুস্তাভ তার গোঁফে হাত বুলিয়ে বলল, কঠিন প্রশ্ন করেছ।
কেন? এটা কঠিন প্রশ্ন কেন?
তার কারণ আমার পিকআপের চেসিস বাইশ সনের, ইঞ্জিন ছাব্বিশ সনের, ফুয়েল সিস্টেম তেইশ সনের, ট্রান্সমিশন চব্বিশ সনের আর চাকাগুলো এই সেদিন লাগিয়েছি-তা হলে তোমরাই বল গাড়িটা কোন বছরের।
কিয়া হিহি করে হেসে বলল, সবগুলো বছর যোগ দিয়ে গড় করে ফেলতে হবে।
নীল বলল, আমি আগে কখনো এরকম গাড়ি দেখি নাই।
গুস্তাভ হাসতে হাসতে বলল, তোমরা যেখান থেকে এসেছ সেখানে এরকম গাড়ি দেখার কথা না। শুধু গাড়ি না আরো অনেক কিছু দেখার কথা না!
রিকি এগিয়ে এসে বলল, আমাদের হাতে সময় বেশি নাই। চল আমরা শুরু করে দিই, আমাদের কিন্তু অনেক দূর হাঁটতে হবে। আগে কোথায় যাবে বল।
সবাই চিৎকার করে তাদের পছন্দের জায়গার কথা বলতে যাচ্ছিল নীল হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিল, বলল, না। এভাবে হবে না। একেকজনের পছন্দ একেক জায়গায় কাজেই সেভাবে হবে না। রিকি ঠিক করুক সে আমাদের কোথায় নিতে চায়। আমরা সবাই রিকির পিছু পিছু যাব।
ঠিক আছে।
রিকি হচ্ছে আমাদের লিডার।
সবাই চিৎকার করে বলল, রিকি হচ্ছে আমাদের লিডার।
রিকি বনের রাস্তাটা দেখে বলল, আমরা এই পথ দিয়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে বনে ঢুকে যাব। সেখান দিয়ে পাহাড়ে উঠে প্রথমে গ্লাইডারে উড়ব। তারপর সেখান থেকে হ্রদে গিয়ে ভেলা। ঠিক আছে?
সবাই সমস্বরে বলল, ঠিক আছে।
গুস্তাভর পিকআপটা চলে যাওয়া পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করে তারপর তারা বনের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে। প্রথমে মাতিষা মৃদু স্বরে এবং একটু পরে গলা ছেড়ে গান গাইতে থাকে-সবাই তার সাথে গলা মেলায়।
নির্জন বনভূমি হঠাৎ করে কিছু শি গানের সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে।
১৫.
প্রিন্সিপাল কেটির মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। সে আর্তকণ্ঠে বলল, কী বলছ তুমি?
ড্রাইভার বলল, আমি ঠিকই বলছি প্রিন্সিপাল। বাসটা যাবার কথা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে-সেটা চলে এল রেলস্টেশনে।
প্রিন্সিপাল কেটি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, তুমি কোথায় বাস নিয়ে যাচ্ছ সেটি দেখবে না?
কখনোই তো দেখি না, জি.পি.এস আমাদের নিয়ে আসে। কেমন করে যে গন্তব্যটা পাল্টে গেল!
প্রিন্সিপাল কেটির মাথায় তখন হাজারো রকম আশঙ্কার কথা উঁকি দিচ্ছে, সে ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিল না। বিড়বিড় করে বলল, তুমি বাচ্চাগুলোকে নামতে দিলে কেন?
আমি কী নামতে দিয়েছি? কিছু বোঝার আগেই ইলেকট্রনিক দরজা খুলে সবাই নেমে গেল। বলল শপিংমলে যাচ্ছে।
শপিংমল? এই বাচ্চারা শপিংমলে কেন যাবে?
আমি জানি না প্রিন্সিপাল কেটি। কী করতে হয় আপনি করেন।
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, কী করব আমি জানি না তবে তুমি জেনে রাখ যদি এই বাচ্চাদের কারো কিছু হয় তা হলে তুমি আমি কিংবা এই স্কুলের কারো কিন্তু রক্ষা নাই। বুঝেছ?
কিছুক্ষণের মাঝেই স্কুল কম্পাউন্ডে অনেকগুলো পুলিশ, সেনাবাহিনীর এবং অভিভাবকদের গাড়ি এসে হাজির হল। প্রিন্সিপাল কেটি তার অফিসে অসহায়ভাবে বসে রইল এবং তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
রন সরাসরি অফিস থেকে চলে এসেছে। তার শরীরে পূর্ণ সামরিক পোশাক, এই পোশাকে তাকে একজন অপরিচিত মানুষের মতো দেখায়। তার মুখ পাথরের মতো কঠিন। সে চাপা এবং হিংস্র গলায় বলল, আপনারা দাবি করেন যে আপনাদের স্কুল আমাদের সন্তানদের পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়েছে। তা হলে কোথায় আপনাদের দায়িত্ববোধ? আমাদের ছেলেমেয়েরা কোথায়?
প্রিন্সিপাল কেটি দুর্বল গলায় বলল, আমি আপনাদের বলেছি-এই বারো জন শিশু পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান শিশু। এরা যদি কোনো একটা পরিকল্পনা করে কিছু একটা করে তা হলে আমরা দূরে থাকুক আপনারা সবাই মিলেও তাদের থামাতে পারবেন না।
আপনি বলছেন তারা পরিকল্পনা করে পালিয়ে গেছে?
হ্যাঁ। আমার তাই ধারণা। খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে তারা পালিয়ে গেছে।
রন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমাদের সন্তানেরা এতদিন ঠিকভাবে থেকে হঠাৎ করে কেন খেপে উঠল? কেন তারা স্কুল থেকে পালিয়ে গেল? কী করেছেন আপনারা তাদের?
আমরা কিছুই করি নি! ঠিক যেভাবে তাদের লেখাপড়া করানোর কথা, যখন যেটা যেভাবে শেখানোর কথা হুবহু সেভাবে শিখিয়ে আসছি। পুরো ব্যাপারটা আমাদের কাছেও একটা রহস্য।
কাঁদো কাঁদো গলায় একজন মা বলল, আমারশান্তশিষ্ট মেয়ে পালিয়ে গেছে? আমি বিশ্বাস করতে পারি না। ভিডিফোনটা পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছে। কী আশ্চর্য।
ঠিক এরকম সময় পুলিশের এক কর্মকর্তার ভিডিফোন বেজে ওঠে, সে নিচু গলায়। কিছুক্ষণ কথা বলে হাসিমুখে ঘরের সবার দিকে তাকাল। বলল, খোঁজ পাওয়া গেছে।
খোঁজ পাওয়া গেছে? সত্যি? রন অবাক হয়ে পুলিশ কর্মকর্তার দিকে তাকাল। কোথায় আছে তারা।
স্টেশনে খোঁজ নিয়

26/08/2023
জিনোম জনম (১ম পর্ব)
লিখেছেনঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল
কম বয়সী একটা মেয়ে খুট করে দরজাটা খুলে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, এস, এস। তোমরা ভেতরে এস, আমরা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি।
মেয়ের মুখের হাসি এবং কথাটুকু মেপে মেপে বলা কিন্তু তারপরেও ভঙ্গিটাতে এক ধরনের আন্তরিকতা ছিল, দরজার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রন এবং তার কম বয়সী স্ত্রী নিহা সেটা অনুভব করতে পারে। রন নিহার হাত ধরে ঘরের ভেতরে ঢুকে চারদিক একনজর দেখে বলল, বাহ! কী সুন্দর।
ঘরের ভেতরটুকু খুব সুন্দর করে সাজানো, কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে অনেক দূরের পর্বতমালাকে দেখা যায়। ঘরের অর্ধস্বচ্ছ দেয়ালের ভেতর থেকে এক ধরনের কোমল আলো বের হয়ে ঘরটাকে মায়াময় করে রেখেছে। প্রশস্ত ঘরের মাঝামাঝি কালো গ্রানাইটের একটা টেবিল, টেবিলটাকে ঘিরে কয়েকটা আরামদায়ক চেয়ার। কম বয়সী মেয়েটি দুটো চেয়ার একটু টেনে সরিয়ে এনে রন এবং নিহাকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে বলল, তোমরা কী খাবে বল। আমাদের কাছে বিষুবীয় অঞ্চলের সতিকারের কফি আছে। তোমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি আল্পস পর্বতের ঢালে জন্মানো আঙুরের রস আছে। যদি স্নায়ু উত্তেজনক কোনো পানীয় চাও আমরা সেটাও দিতে পারি।
রন মাথা নেড়ে বলল, আমার কিছুই লাগবে না। আমাকে একটু পানি দিলেই হবে। এই শুকনো সময়টাতে একটু পরপরই কেমন যেন গলা শুকিয়ে যায়।
নিহা বলল, আমি বিষুবীয় এলাকার কফি খেতে পারি। এটা সত্যিকারের কফি তো?
কম বয়সী মেয়েটি বলল, হ্যাঁ এটা সত্যিকারের কফি। তুমি এক চুমুক খেলেই বুঝতে পারবে।
নিহা হাসিমুখে বলল, চমৎকার!
তোমার কফিতে আর কিছু দেব? ভালো ক্রিম কিংবা কোনো ধরনের সিরাপ। সাথে আরো কিছু খেতে চাও?
নিহা হেসে বলল, না। আর কিছু লাগবে না। তোমার কথা শুনে মনে হতে পারে আমরা বুঝি নিম্নাঞ্চলের বুভুক্ষু মানুষ-তোমাদের এখানে কিছু খেতে এসেছি!
কম বয়সী মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল যেন নিহা খুব মজার একটা কথা বলেছে। কথাটি আসলে হেসে ওঠার মতো কথা নয়। নিম্নাঞ্চলে অনগ্রসর মানুষেরা থাকে। এ বছর সেখানে খাবারের ঘাটতি হয়েছে। অনেক মানুষ সেখানে অনাহারে-অর্ধাহারে আছে-ব্যাপারটিতে কৌতুকের কিছু নেই।
রন বলল, আমরা কি তা হলে কাজের কথা শুরু করে দেব?
কম বয়সী মেয়েটি বলল, অবশ্যই। অবশ্যই কাজের কথা শুরু করে দেব। তোমরা এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তোমাদের এক মিনিট সময় অপচয় করা রীতিমতো দওযোগ্য অপরাধ।
নিহা রনের দিকে তাকিয়ে একটু আদুরে গলায় বলল, রন। তুমি কিন্তু আমাকে তাড়া দিতে পারবে না। আমি কিন্তু আজকে সময় নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি।
রন মুখে হাসি টেনে বলল, আমি তাড়া দেব না নিহা। একটা সন্তান বেছে নেয়া চাট্টিখানি কথা নয়-তুমি তোমার সময় নাও। তোমার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে সন্তানটি ডিজাইন করে নাও।
কম বয়সী মেয়েটি বলল, আমি তা হলে আমাদের চিফ ডিজাইনারকে ডেকে আনছি। মেয়েটি গলা নামিয়ে বলল, আপনারা যেহেতু আমাদের কাছে এসেছেন আমি। অনুমান করছি আপনারা নিশ্চয়ই আমাদের চিফ ডিজাইনার উগুরুর নাম শুনেই এসেছেন?
নিহা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। তার নাম শুনেছি। নেটওয়ার্কে তার কাজের বর্ণনা পড়েছি। কিছু অসাধারণ কাজ আছে তার।
কম বয়সী মেয়েটি বলল, উগুরু যে বাচ্চাগুলো ডিজাইন করেছেন আমি লিখে দিতে পারি আজ থেকে বিশ বছর পরে তারা এই পৃথিবীটার দায়িত্ব নেবে। আর্টস বলেন, বিজ্ঞান বলেন, প্রযুক্তি বলেন, স্পোর্টস বলেন সব জায়গায় তারা হবে পৃথিবীর সেরা।
রন মাথা নাড়ল, বলল, সে জন্যেই আমরা এখানে এসেছি।
কম বয়সী মেয়েটি বলল, আপনারা বসুন, আমি উগুরুকে ডেকে আনছি।
উওরু নাম শুনে নিহার চোখের সামনে যে চেহারভেসে উঠেছিল মানুষটি দেখতে ঠিক সেরকম। মাথায় এলোমেলো হলদে চুল, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। কোটরাগত জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। অত্যন্ত দামি পোশাক অত্যন্ত অগোছালোভাবে পরে থাকা এবং মুখে এক ধরনের নিরাসক্ত ঔদাসীন্য যেটাকে ঔদ্ধত্য বলে ভুল হতে পারে।
উগুরু রন এবং নিহার সামনে বসে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের কোম্পানিতে আপনাদের অভিবাদন
রন বলল, আমাদের সময় দেয়ার জন্যে আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
উগুরু বলল, আমি যেটুকু বুঝতে পারছি আপনি নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত মানুষ। প্রতিরক্ষা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সময় বলতে গেলে কিছুই থাকে না।
রন বলল, আমারও নেই। কিন্তু আমার স্ত্রীর জন্যে আমি আজকে সময় বের করে এনেছি।
চমৎকার। উরু একটু ঝুঁকে মুখে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করে, কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তার মুখে সেটি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না। সেই অবস্থাতেই উগুরু বলল, আমি নিশ্চিত আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের কোম্পানির কাজ প্রথম শ্রেণীর কাজ কিন্তু সেটি যে কোনো হিসেবে অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ।
রন মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি।
এর আগেও অনেকে আমার কাছে এসেছেন কিন্তু খরচের পরিমাণটা জানার পর পিছিয়ে গেছেন।
রনের মুখে সামরিক বাহিনীর মানুষের উপযোগী এক ধরনের কাঠিন্য ফুটে ওঠে, সে মাথা নেড়ে বলল, আমি পিছিয়ে যাব না।
চমৎকার! উগুরু আবার একটু হাসার চেষ্টা করল এবং তার হাসিটি এবারে বেশ খানিকটা সাফল্যের মুখ দেখল। উরু মুখের দাড়িটি অন্যমনস্কভাবে চুলকাতে চুলকাতে বলল, আপনারা কী ধরনের সন্তান চাইছেন? সফল শোবিজ তারকা? স্পোর্টসম্যান? নাকি অন্য কিছু?
নিহা লাজুক মুখে বলল, আমরা কি একসাথে অনেক কিছু চাইতে পারি না? একই সাথে সুন্দর চেহারা এবং প্রতিভাবান এবং মেধাবী!
অবশ্যই চাইতে পারেন। একটি শিশুর জীবনের নীলনকশা থাকে তার জিনে। ক্রোমোজোমগুলোর মাঝে সেগুলো লুকিয়ে আছে। বিজ্ঞানীরা সেগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। আমরাও সেগুলো বের করার চেষ্টা করছি। কোন ক্রোমোজোমে কোন জিনটার মাঝে একটা শিশুর কোন বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে থাকে সেটা আমাদের চাইতে ভালো করে কেউ জানে না। আপনারা বলবেন, আমরা সেই জিনটা আপনাদের পছন্দমতো পাল্টে দেব।
নিহা মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার!
উগুরু তার আঙুলের সাথে জুড়ে থাকা লেখার মডিউলটা স্পর্শ করে বলল, তা হলে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করি, এটি নিশ্চয়ই আপনাদের প্রথম সন্তান?
হ্যাঁ। রন বলল, আমরা মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সন্তান নেয়ার সরকারি অনুমতি পেয়েছি।
ছেলে না মেয়ে? কী চান আপনারা?
রন সোজা হয়ে বলল, ছেলে। অবশ্যই ছেলে। কথা শেষ করে সে নিহার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না নিহা?
নিহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ আমরা প্রথম সন্তান হিসেবে একটি ছেলে চাই।
তার শারীরিক গঠনের ব্যাপারে আপনাদের নির্দিষ্ট কিছু চাওয়ার আছে?
নিহা বলল, হ্যাঁ। লম্বা আর সুগঠিত।
চুলের রঙ?
সোনালি।
চোখ?
নীল। অবশ্যই নীল। নিহা মাথা নেড়ে বলল, মেঘমুক্ত আকাশের মতো নীল।
গায়ের রঙ?
তামাটে। ফর্সা রঙ যখন রোদে পুড়ে একটু তামাটে হয় সেরকম।
উগুরু অন্যমনস্কভাবে তার দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, গত শতাব্দীর কিছু চলচ্চিত্র অভিনেতা, কিছু ক্রীড়াবিদের জিনোম আমাদের কাছে আছে। আমরা অ্যালবামগুলো দেখাচ্ছি। আপনারা তার মাঝে থেকে বেছে নিতে পারেন।
নিহা বড় বড় চোখ করে বলল, সত্যি?
সত্যি।
রন নিহার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমাদের সন্তান কি দেখতে আমাদের মতো হওয়া উচিত না? চলচ্চিত্র অভিনেতার মতো কেন হবে?
নিহা হিহি করে হাসতে থাকে এবং তার মাঝে উগুরু বলে, আপনাদের সন্তান। আপনাদের মতোই হবে-আমরা শুধু সেটাকে বিন্যস্ত করে দেব! চুলের রঙ, চোখের রঙ এই সব। আমাদের সিমুলেশান প্যাকেজ আপনাদের দেখিয়ে দেবে সে দেখতে কেমন হবে! ছোট থাকতে কেমন হবে বড় হলে কেমন হবে!
নিহা বলল, আমি আমার শখের কথা বলতে পারি?
অবশ্যই। অবশ্যই বলতে পারেন।
আমি চাই আমার ছেলে দেখতে যেরকম সুদর্শন হবে ঠিক সেরকম তার ভেতর অনেক গুণ থাকবে। সে ছবি আঁকতে পারবে। গান গাইতে পারবে তার ভেতরে লেখার ক্ষমতা থাকবে। পৃথিবীর বর্তমান সময়টা হচ্ছে বিজ্ঞানের সময়-তাই আমি চাই তার ভেতরে যেন বিজ্ঞানের মেধা থাকে। সে যেন সত্যিকারের গণিতবিদ হয়। একই সঙ্গে আমি চাই সে যেন। হয় তেজস্বী আর সাহসী। তার ভেতরে যেন একটা সহজাত নেতৃত্বের ভাব থাকে।
রন হা হা করে হেসে বলল, সোজা কথায় তুমি চাও তোমার ছেলে হবে একজন মহাপুরুষ!
নিহা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, কেন? তাতে দোষের কী আছে? আমি কি চাইতে পারি যে আমার ছেলে একজন মহাপুরুষ হোক?
উগুরু বলল, অবশ্যই চাইতে পারেন। আগে সেটি ছিল মায়েদের স্বপ্ন-এখন সেটি আর স্বপ্ন নয় এখন সেটি আমাদের হাতের মুঠোয়।
নিহা উৎসুক চোখে বলল, তা হলে আমি কি সত্যি সত্যি এরকম একজন সন্তান পেতে পারি?
অবশ্যই পারেন। উগুরু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমরা গত কয়েক শতাব্দীর পৃথিবীর সব বড় বড় কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, ক্রীড়াবিদ, অভিনেতা, দার্শনিক, নেতা, নেত্রীর জিনোম সগ্রহ করেছি। তাদের ভেতরে ঠিক কোন জিনটি আলাদাভাবে তাদের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়েছে সেটা আলাদা করেছি। সেই জিনটি বিকশিত করতে হলে আর অন্য কোন জিনের সহযোগিতার দরকার আমরা সেগুলোও বের করেছি। কাজেই আপনারা যেটা চাইবেন আমরা সেটা আপনাদের সন্তানের মাঝে দিয়ে দেব!
নিহা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, সত্যি সত্যি সেটাই দিতে পারবেন?
অবশ্যই! উগুরু মাথা নেড়ে বলল আমাদের কাছে আইনস্টাইন থেকে শুরু করে নেলসন ম্যান্ডেলা, জ্যাক নিকলসন থেকে শুরু করে মাও জে ডং টনি মরিসন থেকে শুরু করে বিল গেটস সবার জিনোম আছে। উগরু হঠাৎ মাথা ঝুঁকিয়ে নিচু গলায় বলল, আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। আমরা হিটলারের জিনোমও সগ্রহ করেছি!
হিটলার? কেন? হিটলার কেন?
এমনিই। হতেও তো পারে কোনো একজন নিও নাৎসি কেউ তার সন্তানের ভেতর হিটলারের ছায়া দেখতে চাইবে! যাই হোক যেটা বলছিলাম আপনারা ঠিক কী চাইছেন বলে দেন আমরা আপনার সন্তানকে ডিজাইন করে দেব। সবচেয়ে বড় কথা আপনারা যে সন্তানটি পাবেন সে হবে সম্পূর্ণভাবে নীরোগ-তাকে কোনো রোগ-ব্যাধি আক্রমণ করবে না। তা ছাড়া
তা ছাড়া কী?
আমাদের কোম্পানি থেকে আমরা আপনাদের সার্টিফিকেট দেব।
সার্টিফিকেট?
হ্যাঁ উগুরু মাথা নেড়ে বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আমরা যদি একটি শিশু ডিজাইন করে তাকে সার্টিফিকেট দেই সেটা সব জায়গায় গ্রহণ করা হয়। আপনাদের সন্তান স্কুলে সবচেয়ে বেশি সুযোগ পাবে। লেখাপড়ায় তাকে সবচেয়ে আগে নেয়া হবে-যখন সে তার জীবন শুরু করবে তখন তার ধারেকাছে কেউ থাকবে না। একজন সন্তানের জন্যে এর চাইতে বড়। বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।
রন মাথা নিচু করে বলল, আমরা জানি। সে জন্যেই আমরা আপনাদের কাছে এসেছি।
উগুরু তার কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, তা হলে চলুন আমরা কাজ শুরু করি। ভেতরে আমাদের বড় ডিসপ্লে রয়েছে সেখানে আমরা পুরো প্রক্রিয়াটি সিমুলেট করতে পারি। আপনাদের দুজনের ক্রোমোজোমগুলো নিয়ে আপনাদের সামনেই আপনাদের সন্তানকে ডিজাইন করব। সন্তান জন্ম দেবার আগেই আপনারা আপনাদের সন্তানদের দেখতে পাবেন।
নিহা রনের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল, চল রন। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না!
রন বলল, চল। কিন্তু তোমার সন্তানের জন্য তোমাকে অন্তত নয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।
০২.
রিশ গামলার পানি দিয়ে রগড়ে রগড়ে শরীরের কালি তুলতে তুলতে বলল, তিনা। আজকে রাতে আমরা কী খাচ্ছি?
রিশের স্ত্রী তিনা কাপড় ভাঁজ করে তুলতে তুলতে বলল, মনে নেই? আজ আমরা বাইরে খেতে যাব?
রিশের সত্যি মনে ছিল না, সে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। সে জন্য আমি কিছু রাধি নি।
কোথায় যাবে ঠিক করেছ?
তিনা হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমরা কি আর পার্বত্য অঞ্চলে খেতে যাব? এই আশপাশে কোথাও বসে খেয়ে নেব।
রিশ একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেল। তারা নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র মানুষ, হঠাৎ করে খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে। আশপাশে অনেক মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে আছে এরকম সময় বাইরে যেতে যেতে এক ধরনের অপরাধবোধের জন্ম হয় কিন্তু দিন-রাত পরিশ্রম করতে করতে মাঝে মাঝেই দুজনের ইচ্ছে করে বাইরে কোথাও সুন্দর একটা জায়গায় বসে খেতে। অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বলতে। হালকা কোনো বিনোদনে সময় কাটিয়ে দিতে।
রিশ তার তেলকালি মাখা কাপড় পাল্টে পরিষ্কার কাপড় পরে বলল, তিনা, আমিও রেডি। চল, যাই। যা খিদে পেয়েছে মনে হয় একটা আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।
তিনা খিলখিল করে হেসে বলল, যদি খেতেই চাও তা হলে আস্ত ঘোড়া কেন, অন্য কিছু খাও! ঘোড়া কি একটা ধাওয়ার জিনিস হল?
রিশ বলল, এটা একটা কথার কথা! ঘোড়া কি কোথাও আছে? চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও কি ঘোড়া দেখেছ কখনো?
সেজন্যই তো বলছি-দুই চারটে যা কোনোমতে টিকে আছে সেটাও যদি খেয়ে ফেলতে চাও তা হলে কেমন করে হবে?
কিছুক্ষণের মাঝেই তিনা বাইরে যাবার পোশাক পরে বের হয়ে এল। তাকে একনজর দেখে রিশ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার খুব দুর্ভাগ্য যে তুমি নিম্নাঞ্চলে জন্ম নিয়েছ! যদি তোমার পার্বত্য অঞ্চলে জন্ম হত তা হলে নিশ্চয়ই সামরিক অফিসারের সাথে বিয়ে হত। গলায় হীরার নেকলেস পরে তুমি এক পার্টি থেকে আরেক পার্টিতে যেতে!
তিনা হাসতে হাসতে বলল, ভাগ্যিস আমার পার্বত্য অঞ্চলে জন্ম হয় নি! আমি পার্টি দুই চোখে দেখতে পারি না!
রিশ তিনার হাত ধরে বলল, আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় তোমার খুবই দুর্ভাগ্য যে আমার মতো চালচুলোহীন একজন মানুষের সাথে বিয়ে হয়েছে! তোমার এর চাইতে ভালো একটা জীবন পাবার কথা ছিল।
তিনা রিশের মুখমণ্ডল স্পর্শ করে বলল, তুমি যখন নাটকের ব্যর্থ নায়কদের মতো কথা বল তখন সেটা শুনতে আমার ভারি মজা লাগে! অনেক হয়েছে-এখন চল।
ঘরে তালা লাগিয়ে দুজন যখন বাইরে এসেছে তখন শহরের রাস্তায় সান্ধ্যকালীন উত্তেজনাটুকু শুরু হয়েছে। ফুটপাতে মাদকসেবী ছিন্নমূল মানুষ বসে বসে বিড়বিড় করে কথা বলছে। উজ্জ্বল পোশাকপরা কিছু তরুণী কৃত্রিম ফুল বিক্রি করছে। পথের পাশে উত্তেজক পানীয়ের দোকানে হতচ্ছাড়া ধরনের কিছু মানুষের জটলা। পথের পাশে দ্রুতলয়ের সঙ্গীতের সাথে সাথে কিছু নৃত্যপ্রেমিক মানুষের ভিড়। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে কয়েকটি দোকান চারদিকে অনেক মানুষ। খুব ভালো করে খুঁজলেও কিন্তু কোথাও একটি শিশুকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। নিম্নাঞ্চলে শিশুর খুব অভাব।
রিশ আর তিনা তাদের পছন্দের একটা ছোট রেস্টুরেন্টে জানালার পাশে একটা টেবিলে এসে বসে। টেবিলের প্যানেলে স্পর্শ করে খাবার অর্ডার দিয়ে তারা তাদের পানীয়ে চুমুক দেয়। রিশ চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, তিনা, তোমাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে!
তিনা খিলখিল করে হেসে বলল, আমি আগেও দেখেছি–পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেবার সাথে সাথে তোমার আমাকে সুন্দর লাগতে থাকে!
এরকম সৌন্দর্য নিয়ে তোমার আমার মতো একজন কাঠখোট্টা মানুষকে বিয়ে করা ঠিক হয় নি। তোমার নাটকে কিংবা চলচ্চিত্রে অভিনয় করা উচিত ছিল!
তিনা রহস্য করে বলল, তার কি সময় শেষ হয়ে গেছে? আমি তো এখনো নাটকে না হয় চলচ্চিত্রে চলে যেতে পারি!
রিশ মাথা নেড়ে বলল, উঁহু! আমি তোমাকে এখন আর কোথাও যেতে দেব না। আমি সারা দিন ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। বড় মেশিনগুলো চালিয়ে চালিয়ে সময় কাটাই আর ভাবি কখন আমি বাসায় আসব আর কখন তোমার সাথে দেখা হবে!
তিনা বলল, আমাদের ফ্যাক্টরিতে একটা ছেলে কাজ করে, সে কী বলেছে জান?
কী বলেছে?
সে নাকি পড়েছে যে পুরুষ মানুষেরা কখনো একটি মেয়েকে নিয়ে সুখী হতে পারে! কত দিন পরেই তার মন উঠে যায় তখন তারা অন্য মেয়েদের পিছনে ছোটে। ভ্রমরের মতো।
রিশ বলল, হতে পারে। আমি তো আর বেশি লেখাপড়া করি নি তাই আমি জানি না পুরুষ মানুষদের কেমন হওয়া উচিত। আমি তাই আমার মতন রয়ে গেছি। এখনো ভ্রমরের মতো হতে পারি নি।
তিনা বলল, আমিও তাই চাই। তুমি যেন সব সময় তোমার মতো থাক কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
রিশ তার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, কী হল তিনা, তুমি অন্য কিছু ভাবছ?
তিনা রিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ রিশ, আমি আজকে তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলার জন্যে এখানে ডেকে এনেছি।
বিশেষ কথা? বিশ সোজা হয়ে বসে বলল, আমাকে বলবে?
হ্যাঁ।
কী কথা?
তিনা দুর্বলভাবে একটু হেসে বলল, আমি একটা সন্তানের জন্ম দিতে চাই। আমি মা হতে চাই।
রিশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হল তিনা কী বলেছে সেটা সে বুঝতে পারে নি। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তু-তুমি সন্তান জন্ম দিতে চাও? আমার আর তোমার সন্তান?
হ্যাঁ। তিনা এবার বেশ জোর দিয়ে বলল, আমার আর তোমার সন্তান।
কিন্তু সেটা তো অসম্ভব। সন্তান জন্ম দিতে হলে অনেক কিছু থাকতে হয়। আমাদের কিছু নেই-আমাদের কখনো অনুমতি দেবে না!
দেবে।
দেবে?
হ্যাঁ। বিয়ের পর থেকে আমি একটু একটু করে ইউনিট জমাচ্ছি-একজন সন্তান চাইলে তার ব্যাংকে যত ইউনিট থাকতে হয় আমার সেটা আছে!
রিশ চোখ কপালে তুলে বলল, সত্যি?
তিনা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ সত্যি। সে একটু এগিয়ে রিশের হাত স্পর্শ করে বলল, রিশ, আমি তোমাকে কখনো ভালোমন্দ খেতে দিই নি। ভালো পোশাক কিনতে দিই নি। আমরা কখনো কোথাও বেড়াতে যাই নি। কখনো আমি কোনো প্রসাধন কিনি নি। কোনো গয়না কিনি নি-দাঁতে দাঁত কামড়ে আমি শুধু ইউনিট জমিয়ে গেছি। দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমি ওভারটাইম কাজ করেছি। আমি তোমাকে দিয়ে ওভারটাইম করিয়েছি। যখন অসুখ করেছে তখন ডাক্তারের কাছে যাই নি। উৎসব আনন্দে কাউকে কোনো উপহার দিই নি-যক্ষের মতো ইউনিট জমিয়ে গেছি! তুমি বিশ্বাস করবে কি না আমি জানি না আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন দশ হাজার ইউনিট জমা হয়েছে-আমরা এখন সন্তানের জন্যে আবেদন করতে পারি।
দশ হাজার?
হ্যাঁ, দশ হাজার!
কিন্তু রিশ ইতস্তত করে বলল, কিন্তু…
কিন্তু কী?
শুধু সন্তান জন্ম দিলেই তো হবে না। তাকে মানুষ করতে হবে না?
হ্যাঁ। তিনা মাথা নাড়ল, অবশ্যই সন্তানকে মানুষ করতে হবে। তুমি আর আমি মিলে আমাদের সন্তানকে মানুষ করতে পারব না? আদর দিয়ে ভালবাসা দিয়ে স্নেহ দিয়ে।
তিনা, তুমি তো খুব ভালো করে জান এখন সন্তান জন্ম দেবার আগে সবাই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যায়। তারা সুস্থ সবল নীরোগ প্রতিভাবান সন্তান ডিজাইন করে দেয়। লক্ষ লক্ষ ইউনিট খরচ করে সেই সব প্রতিভাবান সন্তানেরা জন্ম নেয়। তারা বড় হয়ে বিজ্ঞানী হয় ইঞ্জিনিয়ার হয়। কবি-সাহিত্যিক লেখক হয়! আমাদের সন্তান তো সেরকম কিছু হবে না–সে হবে খুব সাধারণ একজন মানুষ-
তিনা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমাদের সন্তান হবে খুব সাধারণ একজন মানুষ। ঠিক আমাদের মতো। আমার মতো আর তোমার মতো। সে আমাদের সাথে থাকবে আমরা তাকে বুক আগলে বড় করব। বড় হয়ে আমাদের মতো কোনো ফ্যাক্টরিতে চাকরি করবে। যদি সে ছেলে হয় তা হলে টুকটুকে একজন মেয়েকে বিয়ে করবে-আমরা উৎসবের দিন উপহার নিয়ে তাদের দেখতে যাব। যদি মেয়ে হয় সে বড় হয়ে তোমার মতো একজন সুদর্শন হৃদয়বান মানুষ খুঁজে নেবে-তারা উৎসবের দিন আমাদের দেখতে আসবে।
রিশ তার পানীয়ের গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল, তিনা, তুমি কি জান তুমি কী সাংঘাতিক কথা বলছ? একটি সন্তান কত বড় দায়িত্ব তুমি জান? শুধু বেঁচে থাকার জন্যে আমি আর তুমি কত কষ্ট করি তুমি ভেবে দেখেছ? সেই কঠোর পৃথিবীতে তুমি একটা শিশু আনতে চাইছ? যেই শিশুর জন্ম হবে একেবারে অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে। জীবনের প্রতিটি পদে তাকে অবহেলা করা হবে। সে স্কুলে ঢুকতে পারবে না-যদি বা ঢুকে সে পাস করতে পারবে না। শিক্ষা নিতে পারবে না-বন্ধুরা তাকে তাচ্ছিল্য করবে। শিক্ষকরা অবেহলা করবে। বড় হবে এক ধরনের হীনম্মন্যতা নিয়ে। তার জন্যে জীবনের কোনো সুযোগ থাকবে না-কোনো আশা থাকবে না-কোনো স্বপ্ন থাকবে না। কে জানে হয়তো তোমার কিংবা আমার কোনো একটা ব্যাধি তার শরীরে ঢুকে যাবে। হয়তো
তিনা বাধা দিয়ে বলল, এভাবে বোলো না রিশ। আমাদের সন্তান হবে ঠিক তোমার আর আমার মতো। আমরা যেরকম স্বপ্ন দেখি সে ঠিক সেরকম স্বপ্ন দেখবে। আমরা যেরকম কঠিন একটা জীবনে যুদ্ধ করতে করতে একজন আরেকজনের ভেতরে সাহস খুঁজে পাই সেও সেরকম সাহস খুঁজে পাবে! আমাদের সন্তান সাধারণ একজন মানুষ হয়ে বড় হবে। কিন্তু তাতে সমস্যা কী? একসময় কি সাধারণ মানুষ এই পৃথিবীকে এগিয়ে নেয় নি!
রিশ বিষণ্ণ মুখে বলল, কিন্তু তিনা এখন সেই পৃথিবী নেই। এখন পৃথিবীর মানুষ পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। যাদের অর্থবিত্ত আছে, তারা একভাগ। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে প্রতিভাবান, বুদ্ধিমান। অন্যভাগ হতদরিদ্রতারা কোনোমতে শুধু টিকে থাকে। তারা পৃথিবীর সৌভাগ্যবান মানুষের জীবনের আনন্দটুকু নিশ্চিত করার জন্যে দিন থেকে রাত অবধি পরিশ্রম করে আমি সেই জীবনে একজন শিশুকে আনতে চাই না তিনা। আমার নিজের সন্তানকে সেই কঠোর কঠিন একটা জীবন দিতে চাই না
তিনা রিশের দুই হাত জাপটে ধরে বলল, রিশ! তুমি না কোরো না। দোহাই তোমার-আমি সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছি আমার একটা সন্তান হবে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরব। সে আমার বুকের ভেতর ছোট ছোট হাত-পা নেড়ে খেলা করবে। দাঁতহীন মাঢ়ী দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে। আমি তাকে কোলে নিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়াব। আমি তার জন্যে ছোট ছোট জামা বানাব। সেই লাল টুকটুকে জামা পরে সে খিলখিল করে হাসবে। তুমি না কোরো না রিশ তুমি না কোরো না।
রিশ তিনার হাত ধরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি আমার কাছে কখনোই কিছু চাও নি তিনা। আমার কিছু দেবার ক্ষমতা নেই সে জন্যেই বুঝি চাও নি! এই প্রথম তুমি আমার কাছে কিছু চেয়েছ–আমি তোমাকে কেমন করে না করব?
সত্যি তুমি রাজি হয়েছ?
সত্যি।
মন খারাপ করে রাজি হয়েছ?
না। মন খারাপ করে না। খুশি হয়ে রাজি হয়েছি। তিনা তুমি জান আমি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি। এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুমি যদি আনন্দ পাও-আমি তা হলে আনন্দ পাই। তুমি যখন মন খারাপ কর তখন আমার মন খারাপ হয়ে যায়! তুমি যেটা চাইবে, যেভাবে চাইবে সেটাই হবে। সেভাবেই হবে!
তিনা রিশের হাত ধরে রেখে বলল, একদিন ছিলাম শুধু তুমি আর আমি। এখন হব আমরা তিনজন। তুমি আমি আর রিকি।
রিকি?
তিনা লাজুক মুখে হেসে বলল, হ্যাঁ। যদি আমাদের ছেলে হয় তা হলে আমরা তার নাম রাখব রিকি। মেয়ে হলে কিয়া।
রিশ চোখ বড় বড় করে বলল, নাম পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। নাম পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে।
রিশ হাসতে হাসতে তার পানীয়ের গ্লাসটি তুলে নেয়।
০৩.
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি চোখ বড় বড় করে তিনার দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক বার চেষ্টা করে বলল, তুমি কী বলছ? তুমি স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেবে?
হ্যাঁ। আমি স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেব
তুমি কি জান কেউ স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেয় না? যখন ঐণটার বয়স তিন থেকে চার মাস হয় তখনই এটাকে জন্ম দিয়ে হাসপাতালের সেলে তার শরীরে রক্ত সরবরাহ করে তাকে বড় করা হয়?
তিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি। কিন্তু আমি তবুও স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দিতে চাই।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, না। স্বাভাবিক উপায়ে মায়ের বাচ্চা জন্ম দেয়া কী ভয়ংকর কষ্ট তুমি জান না। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চিকিৎসাবিজ্ঞান এই পদ্ধতি বের করেছে। এই পদ্ধতিতে ভ্রণ হিসেবে বাচ্চার জন্ম দেয়া হয়। দ্রুণটির আকার ছোট বলে মায়ের কোনো কষ্ট হয় না।
তিনা বলল, আমি সেটাও জানি। আমি এই বিষয়গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি।
তা হলে তুমি কেন স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেবার কথা বলছ?
দুটি কারণে। প্রথম কারণ হচ্ছে এটাই প্রকৃতির বেছে নেয়া উপায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই নূতন প্রক্রিয়া বের করার আগে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এই প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দিয়েছে কাজেই এটা নিশ্চয়ই একটা গ্রহণযোগ্য উপায়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে জ্বণ হিসেবে সন্তানের জন্ম দিয়ে হাসপাতালে কৃত্রিম পরিবেশে তাকে বড় করতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন আমরা সেই পরিমাণ অর্থ অপচয় করতে চাই না।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার যদি প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকে তা হলে তুমি কেন সন্তান জন্ম দিতে চাইছ?
সন্তান জন্ম দেবার জন্যে রাষ্ট্রীয় নিয়মে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন আমাদের সেই পরিমাণ অর্থ আছে। কিন্তু আমি কৃত্রিম উপায়ে সন্তানের জন্ম দিতে চাই না। আমি সন্তানকে নিজের শরীরে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধারণ করতে চাই। আমি মনে করি একজন মায়ের সেই অধিকার আছে।
মহিলাটি হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমি যদি আগে জানতাম তুমি এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেবে তা হলে আমি কখনোই তোমাকে মা হতে দিতাম না!
তিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি। তাই আমার এই সিদ্ধান্তের কথাটি আগে বলি নি।
তিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখন যাই? আমার সন্তান জন্মানোর আগে আগে আমি আসব-তখন হয়তো একজন ডাক্তারের প্রয়োজন হবে।
মহিলাটি কঠিন মুখে বলল, একেবারে না এলেই ভালো। পুরোটাই নিজে নিজে করে ফেলতে পার না?
রিশ এতক্ষণ তিনার পাশে বসেছিল, একটি কথাও বলে নি। এবার সে প্রথম মুখ খুলল, বলল, যদি প্রয়োজন হয় আমরা সেটাও করে ফেলতে পারব। তুমি নিশ্চয়ই জান নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র মানুষেরা কিন্তু তোমাদের সাহায্য ছাড়াই বেঁচে আছে!
মহিলাটি কোনো কথা বলল না, রিশ আর তিনা হাত ধরে বের হয়ে যাবার পর মহিলাটি সঁতে দাঁত ঘষে বিড়বিড় করে বলল, পৃথিবীটাকে তোমাদের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে সেটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই মঙ্গল। তোমাদের জন্যেও আমাদের জন্যেও।
০৪.
রন নিহার হাত ধরে বলল, তোমার কেমন লাগছে নিহা?
নিহা বলল, ভালো। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি আমার সন্তানের জন্ম দিয়েছি।
হ্যাঁ, কিন্তু সে এখনো আমাদের সন্তান হয়ে ওঠে নি। সে এখনো একটা ঐণ। ডাক্তারেরা তাকে একটা কাচের জারের ভেতর তরলে ডুবিয়ে রেখেছে। তার শরীরে রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করছে।
কখন এটা শেষ হবে?
আমি জানি না।
যখন শেষ হবে, তখন কি আমরা তাকে দেখতে পাব?
চাইলে নিশ্চয়ই দেখতে পারব। কিন্তু
কিন্তু কী?
রন ইতস্তত করে বলল, ডাক্তারেরা চায় না জ্বণ হিসেবে আমরা তাকে দেখি। এখনো সে দেখতে মানবশিশুর মতো নয়। এখন তাকে দেখলে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
নিহা বলল, আমার নিজের সন্তানকে দেখে আমার মোটেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না।
রন নিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, নিশ্চয়ই হবে না। তবুও আমার মনে হয় আমরা ছয় মাস পরেই তাকে দেখি। তখন সে সত্যিকারের মানবশিশু হয়ে যাবে।
নিহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার সন্তান আমার শরীরের ভেতর বড় হচ্ছিল, সেটা চিন্তা করেই আমি নিজের ভেতর এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করেছি। এখন সে আমার শরীরের ভেতরে নেই তাকে দেখতেও পাব না-চিন্তা করে মন খারাপ লাগছে। আমার কী মনে হয় জান?
কী?
আমার মনে হয় প্রাচীনকালের নিয়মটাই ভালো ছিল। তখন মায়েরা তাদের সন্তানকে নিজের ভেতর ধারণ করত। তাকে পূর্ণ মানবশিশু হিসেবে জন্ম দিত।
রন শব্দ করে হেসে বলল, একজন পূর্ণাঙ্গ শিশুকে জন্ম দেয়া কত কঠিন তুমি জান? সেটি কী ভয়ংকর যন্ত্রণা তুমি জান?
কিন্তু একসময় তো পৃথিবীর সব শিশু এভাবেই জন্ম নিত!
একসময় আরো অনেক কিছু হত নিহা। মহামারী হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেত। প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিত। মানসিক রোগীকে চারদেয়ালের ভেতর বন্ধ করে রাখা
নিহা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার সন্তানকে জন্ম দিয়ে নিজেকে কেমন জানি খালি খালি মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কী যেন হারিয়ে গেল।
ওটা কিছু নয়। রন নিহার হাত ধরে বলল, ডাক্তার বলেছে শরীরে হরমোনের তারতম্য থেকে এটা হয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিহা কোনো কথা না বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। ঠিক কী কারণ জানা নেই তার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
০৫.
তিনার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রিশের মুখ ভয়ার্ত এবং রক্তশূন্য। দুই হাতে শক্ত করে সে তিনার একটা হাত ধরে রেখেছে। হঠাৎ চমকে উঠে বলল, ঐ যে-শব্দ হল না? মনে হয় ডাক্তার এসে গেছে।
তিনার যন্ত্রণাকাতর মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, না রিশ। কোনো শব্দ হয় নি। কোনো ডাক্তার আসে নি। আমি জানি কোনো ডাক্তার আসবে না।
কেন আসবে না?
আসবে না, কারণ আমাদের জন্যে কারো মনে কোনো ভালবাসা নেই, রিশ। তুমি আমাকে বলেছিলে পৃথিবীর মানুষ এখন দুই ভাগে ভাগ হয়েছে-সুখী আর হতভাগা! আমরা হতভাগা দলের।
রিশ কাঁপা গলায় বলল, এখন এভাবে কথা বোলো না তিনা।
ঠিক আছে বলব না। কিন্তু তোমাকে আমার সাহায্য করতে হবে। পারবে না?
পারব।
পৃথিবীর কোটি কোটি মা এভাবে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আমিও দেব।
অবশ্যই দেবে।
কী করতে হবে আমি তোমাকে বলব। তুমি শুধু আমার পাশে থাক।
আমি তোমার পাশে আছি তিনা।
আমি যদি যন্ত্রণায় চিৎকার করি তুমি ভয় পাবে না তো?
রিশ বলল, না। আমি ভয় পাব না।
আমার ব্যথাটা একটু পরে পরেই আসছে। আমার মনে হয় আর কিছুক্ষণের মাঝেই আমি আমার বাচ্চাটার জন্ম দেব।
ঠিক আছে তিনা। তোমার কোনো ভয় নেই। আমি আছি।
আমি জানি তুমি আছ।
তুমি ঠিকই বলেছ তিনা। পৃথিবীর কোটি কোটি মা এভাবে সন্তান জন্ম দিয়েছে। তুমিও পারবে।
তিনা যন্ত্রণার একটা প্রবল ধাক্কা দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে সহ্য করতে করতে বলল, পারব। নিশ্চয়ই পারব।
রিশ অনুভব করে একটু আগে তার ভেতরে যে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক এসে ভর করেছিল সেটা কেটে যাচ্ছে। তার বদলে তার নিজের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এসে ভর করছে। নিজের ভেতর সে এক ধরনের শক্তি অনুভব করতে শুরু করেছে। সে পারবে। নিশ্চয়ই সে তিনাকে তার সন্তানের জন্ম দিতে সাহায্য করতে পারবে।
ভয়ংকর যন্ত্রণা ঢেউয়ের মতো আসতে থাকে। তিনা সেই যন্ত্রণা সহ্য করে অপেক্ষা করে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার শরীরের ভেতর বেড়ে ওঠা সন্তানকে পৃথিবীর আলো বাতাসে নিয়ে আসার জন্যে অপেক্ষা করে।
অমানুষিক একটা যন্ত্রণায় তার চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে যেতে চায়। চোখের ওপর একটা লাল পর্দা কাঁপতে থাকে। তিনা কিছু চিন্তা করতে পারে না, কিছু ভাবতে পারে না। পৃথিবীর আদিমতম অনুভূতির ওপর ভর করে সে তার সন্তানকে জন্ম দেয়ার চেষ্টা করে যায়। ভয়ংকর যন্ত্রণায় সে অচেতন হয়ে যেতে চায় তার ভেতরেও চেতনাকে জোর করে ধরে রাখে- যখন মনে হয় সে আর পারবে না ঠিক তখন হঠাৎ করে সমস্ত যন্ত্রণা মুহূর্তের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং পরের মুহূর্তে সে একটি শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পেল। তিনার ঘামে ভেজা সমস্ত শরীর তখন থরথর করে কাপছে। সে হাত তুলে বলল, রিশ, আমার বাচ্চাটাকে আমার কাছে দাও। আমার বুকের মাঝে দাও।
রিশ রক্তমাখা সন্তানটিকে দুই হাতে ধরে সাবধানে তিনার বুকের ওপর শুইয়ে দিল। তিনা দুই হাতে তাকে গভীর ভালবাসায় আঁকড়ে ধরে। রক্ত ক্লেদ মাখা শিশুটি তখনো তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। তিনা জানে এই কান্না কোনো দুঃখের কান্না নয়, কোনো যন্ত্রণার কান্না নয়। পৃথিবীর বাতাস বুকে টেনে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রথম প্রক্রিয়া হচ্ছে এই কান্না। সে সুস্থ সবল একটা শিশুর জন্ম দিয়েছে।
তিনা গভীর ভালবাসায় তার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তার এখনো বিশ্বাস হয় না সে তার নিজের শরীরের ভেতর তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটা মানবশিশুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানবশিশুটি একান্তভাবেই তার। তার আর রিশের।
০৬.
ছোট একটা ব্যাসিনেটে একটা শিশু শুয়ে শুয়ে হাত-পা নাড়ছে, নিহা অপলক শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। রনের হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, এটি আমাদের সন্তান?
হ্যাঁ। এটি আমাদের সন্তান। দেখছ না কী সুন্দর নীল চোখ, আকাশের মতো নীল, ঠিক যেরকম তুমি বলেছিলে।
নিহা মাথা নাড়ল, বলল, মাথায় এখন কোনো চুল নেই। যখন চুল উঠবে সেটা হবে সোনালি। তাই না?
হ্যাঁ।
আমা
Endereço
Lisbon
Telefone
Website
Notificações
Seja o primeiro a receber as novidades e deixe-nos enviar-lhe um email quando সায়েন্স ফিকশন - Science Fictions publica notícias e promoções. O seu endereço de email não será utilizado para qualquer outro propósito, e pode cancelar a subscrição a qualquer momento.
Entre Em Contato Com O Negócio
Envie uma mensagem para সায়েন্স ফিকশন - Science Fictions: