18/09/2023
একটি ১৫ তলা বিশিষ্ট ভবনের ৮ তলায় আমরা বাস করি। ভবনটা দেখতে সুন্দর হলেও এখানে সমস্যার কোনো শেষ নেই।
ভবনের সবাই নিজ নিজ ফ্ল্যাটের মালিক হলেও কারো হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। সকল ক্ষমতা জমির মালিকের ছেলে হাসান সাহেবের হাতে! সে মুখে কিছু বলে না! কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়, এটা আমার বাবার জমি! থাকতে হলে আমার কথামতোন থাকতে হবে!
ফ্লাটের মালিকরা তেমন একটা কিছু বলে না! কারণ মালিকের ছেলে কুকুর পালে! আরে পশু কুকুর না! মানুষরূপী পশু কুকুর! বাড়ির কেয়ারটেকার, দারোয়ান, কাজের ছেলে ও ড্রাইভার নিয়ে তার কুকুর বাহিনী! এদের জ্বালায় নিজের বাসায় বসবাস করা বেশ কঠিন! কিন্তু কোথায় আর যাবো?
যাইহোক, এবার আমাদের বাসার প্রধান একটা সমস্যার কথায় আসি। সেটা হলো, আমাদের এই ১৫ তলা ভবনে কোনো লিফট নেই। মানুষের অনেক কষ্ট হয়! তাই একদিন আমরা সবাই মিলে গেলাম জমির মালিকের ছেলে হাসান সাহেবের কাছে। তার কাছে না গিয়েও উপায় নেই। আমাদের ফ্ল্যাট মালিকদের সমিতির নির্বাচিত সভাপতি সে। প্রতি দুই বছর পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবারই সে জিতে! আমরা সবাই জানি কীভাবে জিতে কিন্তু তার কুকুরদের ভয়ে কিছু বলতে পারি না!
হাসান সাহেব আমাদের দাবি শুনে বললেন, আপনারা ভাববেন না! এটা আমার বাবার জায়গা! এই বাড়ি আমার বাবার স্বপ্ন! এই বাড়ির উন্নয়নে আমি সবসময় আপনাদের পাশে আছি! দরকার হলে আমি আমার জীবন দিয়ে দিবো!
৫ তলার বাতেন সাহেব সহজ সরল মানুষ। তিনি মুখ ফসকে বলে ফেললেন, জীবন লাগবে না! আপাতত একটা লিফটের ব্যবস্থা করেন!
হাসান সাহেব চোখ পাকিয়ে তাকালেন! পাশে থাকা তার ড্রাইভার কুকুর ঘাউ করে উঠলেন। বাতেন সাহেব চুপসে গেলেন!
পরদিন হাসান সাহেব থেকে ঘোষণা এলো, এই ভবনের উন্নয়নের জন্য সবাইকে চাঁদা দিতে হবে! চাঁদার পরিমাণ শুনে আমাদের চোখ কপালে উঠলো! কিন্তু উপায় কী? চোখ মহাশূন্যে উঠলেও চাঁদা তো দিতেই হবে! ভবনের উন্নয়ন বলে কথা!
আমরা সবাই মোটা অংকের চাঁদা দিলাম! মনে অনেক আশা, ভবনে লিফট লাগানো হবে! এক চাপে নিজ নিজ ফ্ল্যাটে পৌঁছে যেতে পারবো! আহা! কী মজা হবে! আহা! কী আরাম হবে!
একদিন সকালে দেখলাম, ভবনের প্রতি তলায় ফ্রিজ এনে রাখা হচ্ছে! এই ফ্রিজগুলোতে ঠান্ডা পানি ও কোক পেপসি থাকবে! সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কেউ ক্লান্ত হয়ে গেলে ঠান্ডা পানি ও কোক পেপসি খেয়ে পরাণ জুড়াতে পারবেন! তবে এর জন্য আলাদা দামও দিতে হবে!
প্রতি তলায় ফ্রিজ বসানোর পর বাড়িওয়ালার ছেলে হাসান সাহেবের সাথে দেখা হতেই তিনি এক গাল হেসে বললেন, দেখছেন কী চমৎকার একটা আইডিয়া বের করলাম! এখন আরাম করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবেন!
আমি মিনমিন করে বললাম, এত টাকা দিয়ে এতগুলো ফ্রিজ না কিনে একটা লিফট...
ঘেউ ঘেউ ঘেউ! আমি কথা শেষ করার আগেই বাড়িওয়ালার ছেলের কেয়ারটেকার কুকুরটা আমাকে ভয় দেখালো! আমি চুপ করে গেলাম! কারণ সাত তলার আনিস সাহেবের কাছ থেকে শুনেছি এই ফ্রিজগুলো বাড়িওয়ালার ছেলের শালার দোকান থেকে কেনা হয়েছে! বাড়িওয়ালার ছেলে অনেক টাকা নাকি নিজের পকেটে ঢুকিয়েছে! এখন বেশি কথা বললে আমার পিছনে কুকুর লেলিয়ে দিবে!
কিছুদিন পর বাড়িওয়ালার ছেলে আবারও মোটা অংকের চাঁদা দাবি করলো! আমরা আবারও আশায় বুক বাঁধলাম! এবার নিশ্চয় আমাদের এত দিনের স্বপ্নের লিফটা হয়েই যাবে!
আমরা সময়মতো সব চাঁদা পরিশোধ করলাম!
পরদিন আমরা অবাক হয়ে দেখি, লিফট নয়! প্রতি তলায় ফ্রিজের পাশে বসে পানি খাওয়ার জন্য আরামদায়ক সোফা কেনা হয়েছে! আমরা সবাই অবাক হয়ে আছি! এমন সময় বাড়িওয়ালার ছেলে হাসান সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বললো, আমি দেখেছি আপনারা অনেক কষ্ট করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানি পান করেন! তাই আরাম করে বসে বসে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম! গোপন খবরে জানা যায়, এই সোফাসেট বাড়িওয়ালার ছেলের খালাতো ভাইয়ের দোকান থেকে আনা হয়েছে! এখানেও বেশ বড়ো অংকের ব্যবসা! আমাদের সহ্য ক্ষমতা বেড়েছে! তাই চুপ করে সব সহ্য করছি!
কিন্তু দুই তলার সগীর সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না! তিনি হাউকাউ করে উঠলেন! তিনি বললেন, আমার বাসা দুই তলায়! আমার তো এসব কোনো কাজে আসছে না! তাহলে আমি কেন চাঁদা দিচ্ছি! হাসান সাহেব চোখ পাকিয়ে বললেন, এটা কেমন কথা? আপনি কী এই ভবনের উন্নয়ন চান না! আপনি কী চান না, এই ভবন গুলশান বনানীর ভবন থেকেও সামনে এগিয়ে যাক?
সগীর সাহেব শুনলেন না! হাউকাউ চালিয়েই যেতে থাকলেন! ঠিক তখনই বাড়িওয়ালার ছেলের দুই কুকুর এসে সগীর সাহেবকে ধরে নিয়ে গেলো! দুই দিন সগীর সাহেবের কোনো খবর ছিলো না! তিন দিনের দিন দেখা গেল সগীর সাহেবের মাথায় ব্যান্ডেজ! জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছেন!
আমরা কেউ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়তে চাই না! তাই চুপ করে গেলাম!
কিছুদিন পর আবারও মোটা অংকের চাঁদার নোটিশ! জানা গেল এবার প্রতি তলার ওপেন স্পেসে এসি লাগানো হবে! আমরা যারা সিঁড়ি দিয়ে উঠি তারা যেন সোফায় বসে এসির বাতাস উপভোগ করতে করতে পানি পান করতে পারি! আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, আচ্ছা ওপেন স্পেসে এসি কাজ করবে কী করে? বাতাস সব বের হয়ে যাবে না? কিন্তু মনের প্রশ্ন মনেই চাপা দিলাম! এসির বাতাস বের হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে আমার নিজের বাতাসও বের হয়ে যেতে পারে!
তাই চুপ গেলাম!
©Rohit Hasan Kislu