23/03/2024
"তোর বউ আজকে কি করছে জানস? আমার ভাইটারে আধঘন্টা দরজার বাইরে দাঁড় কইরা রাখছে। আবার দেমাগ দেখাইয়া কথাও কয় নাই। এমন বেয়াদব বউ তো আমি আনি নাই। তুই আজকে এর বিহিত করবি, নাহয় আমি এই নুরবানু তোর বাসা ছাইড়া চইলা যামু।"
মায়ের কথায় বেশ চমকে গেছে জাহিদ। তার বউ রিতা তো এমন না। নম্র স্বভাবের মেয়েটা কে হাজার কথা শোনালেও জবাব দেয় না। রাগ করে চিল্লাচিল্লি করলে সে বিড়বিড় করে কী যেন বলবে। কথায় কথায় জবাব না দিলে কতক্ষন একা একা বকা যায়? জাহিদ ও আর রাগ ধরে রাখতে পারে না। মেয়েটার নিষ্পাপ মুখ ভঙ্গিমা দেখে রাগ একদম গলে পানি হয়ে যায়। কিন্তু কিছুদিন ধরে রিতার নামে একেরপর এক অভিযোগ আসছেই। এই কয়েকদিন আগে পাশের বাড়ির ভাবী বললেন, রিতা নাকি তাকে দেমাগ দেখিয়ে এড়িয়ে চলে। তাকে দেখলেই মুখ একদম পানসে করে রাখে। আরেকদিন ফুফু অভিযোগ করলেন, রিতা তার মুখে মুখে তর্ক করেছে। সাথে রিতাকে মহা পণ্ডিত বলে ব্যঙ্গ করতেও ভুললেন না। আজ আবার মা অভিযোগ করলেন, ছোটখাটো নয় ভয়াবহ অভিযোগ। মামা শশুড় কে আধাঘণ্টা ধরে দরজায় দাঁড় করিয়ে
রাখা নিশ্চয় ছোটখাটো অপরাধ নয়।
জাহিদের রাগ আজ তুঙ্গে চলে গেছে। কেবল মাত্র অফিস থেকে ফিরল, ক্লান্ত শরীরে বউয়ের নামে অভিযোগ শুনলে কোন পুরুষের মেজাজ ঠান্ডা থাকবে?
তোমার নামে আর কত অভিযোগ শুনব রি...?
ঘরে প্রবেশের পথেই কথাগুলো বলছিল জাহিদ। কিন্তু নামাজরত রিতা কে দেখে তার মুখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে এলো। কী মায়া মিশিয়ে নামাজ পড়ছে মেয়েটা। নামাজ পড়ার সময় ভূমিকম্প হয়ে গেলেও টের পায় না সে। জাহিদের কথাটাও যে শুনতে পায় নি জাহিদ জানে। নিষ্পাপ মুখখানা জাহিদ অপলক তাকিয়ে দেখল। হঠাৎ টের পেল এতক্ষণের রক্তারক্তি কান্ড ঘটানোর মতো রাগ নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেছে। বরাবরের মতো একই ঘটনা। তবে জাহিদ এবার হার মানলো না। উপরি রাগ নিয়ে সে ফ্রেশ হয়ে এলো। ততক্ষণে রিতার নামাজ শেষ। জাহিদ কে বের হতে দেখেই সে একগাল হেসে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল।
"তুমি অনেকক্ষণ ধরে এসেছ, না? তোমার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে? আমি তোমার পাশে একটু বসে, তারপর খাবার দিচ্ছি।"
'চ' কারান্ত শব্দ করল জাহিদ। এইভাবে কথা বললে মেজাজ দেখানো যায়। তবুও পানিটা শেষ করে রুক্ষ মেজাজে প্রশ্ন করল,
"আজ মামাকে অপমান করেছ কেন?"
বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল রিতা। একসময় মায়াভরা চোখটা ছলছল করে উঠল।
"বিশ্বাস করো আমি মামাকে অপমান করিনি। আমি গোসল করছিলাম, তাই কলিংবেলের শব্দ পাই নি। যখন বের হলাম মামার কন্ঠ শুনে তাড়াহুড়ো করে হিজাব পড়তে দেরী হয়েছে। দরজা খুলেই আমি ক্ষমা চেয়েছি মামার কাছে।"
"মামার সাথে কথা বলো নি কেন?"
"আমি কুশল বিনিময় করে মামাকে নাস্তা দিয়ে নামাজে দাঁড়িয়েছি। সময় চলে যাচ্ছিল, আর মা মামার সাথে কথা বলছিলেন তাই গিয়েছিলাম।"
"এমন করলে মা এভাবে বলতো?"
"তোমার মামা কথা বলার ফাঁকে গাঁয়ে হাত দেন, যা আমার পছন্দ না।"
আচমকা জাহিদের নিভে যাওয়া রাগটা ফেরত এলো। মামার নামে এতবড় অপবাদ সে কিছুতেই মেনে নিবে না। সে ভালো করেই জানে তার মামা রিতাকে মেয়ের মতোই দেখে।
"মুখে লাগাম টানো রিতা, কি বলছো মাথা ঠিক আছে?"
আচানক চিৎকারে কেঁপে উঠল রিতা। সাথে ফুঁপিয়ে উঠল।
"আমি সেভাবে বলিনি জাহিদ, আমাকে বুঝিয়ে বলার সুযোগ দাও। তোমার মামার উদ্দেশ্য খারাপ আমি সেটা বলিনি। উনি স্বাভাবিক ভাবেই স্পর্শ করেন। কিন্তু তোমার মামা আমার মাহরাম নন জাহিদ।তার কাছে এসব আধুনিক, ফ্রিলি'র নমুনা হলেও আমার কাছে তা অস্বাভাবিক। তাই আমি তাকে কষ্ট দিতে চাই নি বলে এড়িয়ে গেছি। আমাকে ভুল বুঝো না জাহিদ। আমি ভুল করলে আবারো ক্ষমা চাইব, এখনি ফোন দিয়ে বলছি দাঁড়াও।"
একাধারে কথাগুলো বলেই রিতা নিজের ফোন খুঁজতে লাগল। চোখ মুখ এতটুকুতেই লাল হয়ে গেছে। জাহিদ চোখ বুঝে নিজেকে শান্ত করল। নিজের ভুল বুঝতে পারলেও তার রাগ কমলো না। এই কথাগুলো জায়গা মতো বললে তারা অভিযোগ করার সুযোগই পেত না। রিতা কে বসালো বিছানায়। মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে।
"হয়েছে আর কাঁদতে হবে না। শুনো রিতা, অন্যকে সম্মান করা এক জিনিস, নিজেকে সম্মান করা আরেক জিনিস। অন্যকে সম্মান করতে গিয়ে নিজেকে অসম্মান করা অন্যায়। তুমি তাদের কষ্ট দিতে চাও নি বলে নিজের মধ্যে কথাগুলো আটকে রেখেছ। এতে তারা তোমাকে মন্দ ভেবেছে, অভিযোগ করার সুযোগ পেয়েছে। তুমি তাদের তৎক্ষণাৎ কথাগুলো বুঝিয়ে বললে তাদের পছন্দ নাহলেও একটু রয়েসয়ে অভিযোগ করতো।"
"আমি ভাবী দের এড়িয়ে চলতে চাই না। কিন্তু তারা এলেই এ ওর নামে দুর্নাম করতে থাকে। কার ঘরে কী সমস্যা, কে কী করল, কার কী গেল; এসব নিয়েই তাদের আলোচনা। তুমি তো জানোই, গীবত করা হারাম। আল্লাহ তাআলা গীবতকারী কে পছন্দ করেন না। ফুফু সেদিন নামাজে ভুল করেছিলেন। আমি সঠিক বলায় তিনি মেনে নেন নি। বরং সাথে নিজেদের কুসংস্কার থেকে আমাকে এটা ওটা বলছিলেন। আমি তাকে যথাসম্ভব বুঝিয়ে বলেছি। কিন্তু এত বছরের ভুল তো, তাদের কাছে ভুল মনে হবে না, হাজার প্রমাণ যুক্তি দেখালেও।"
জাহিদ নিশ্চুপে শুধু বউয়ের নাক টানার শব্দ শুনছে। বুকের ভেতর অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। রিতা কে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলাতে থাকে জাহিদ। আশ্চর্য, কই সেই অস্থিরতা? বরঞ্চ প্রশান্তিতে ভরে গেল বুকটা। এমন বউ কয়জনে পায়? আল্লাহ'র কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করল, অতিরিক্ত রাগ দেখায় নি বলে। না হলে পরে অনুতাপে রিতার সামনেই আসতে পারত না। মনে মনে পণ ও করে নিল, আচানক কোনো কথা শুনেই কাউকে মন্দ ভাববে না। অন্যের কথায় নিজের সংসারে আগুন লাগানো বোকাদের কাজ। জাহিদ বোকা নয়।
হঠাৎ কিছু মনে হতেই সে প্রশ্ন করল,
"কিন্তু রাগ হলে যে বিড়বিড় করো, এইবার তো করলে না?"
শব্দ করে হেসে উঠলো রীতা। জাহিদের বুক থেকে মুখ উঠিয়ে বলল,
"তোমার রাগ হলে আমি তখন ধৈর্য্য ধারণ করার দেয়া করি আল্লাহ'র কাছে। 'ইন্নাল্লাহা মা'আস সাবিরিন' এটা পাঠ করি। আর তোমার রাগ ও ভেনিস হয়ে যায় আমার ধৈর্য্য দেখে।"
তারপর দুজনেই হাসল। কী নির্মল, প্রাণবন্ত সে হাসি! এটাই হয়তো স্বামী স্ত্রীর হালাল ভালোবাসা!
সংসার তো সুন্দর সুখের হয় স্বামী স্ত্রীর উভয়ের অটুট বিশ্বাসে, সমঝোতায়, ভালোবাসায়। আর সংসার সুখের হলে জীবনের স্বাদ উপভোগ করা যায়। অথচ কিছু নারী পুরুষ নিজেদের নির্বোধতার কারণে জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে পারে না। মন মস্তিষ্ক অস্থির থাকে। জীবনের স্বাদ হারিয়ে প্রাণহীন ভাবে বেঁচে থাকে একে অপরের সাথে নিরব যুদ্ধ করে। তারা একে অপরের দিকে চেয়ে হাসে না, অভিমান করে না, একে অপরের যত্ন করে না, অপেক্ষা করে না। তাদের মন শুধু ভুলের মাঝে আটকে থাকে!
#হালাল_ভালোবাসা
~Tahrim Muntahana