
17/01/2025
মাঝে মাঝে ভাবি
যদি স্মৃতি প্রতারণা করত
আর পৃথিবী ফিরে যেত আরো আদিম সময়ে
সাড়ে চৌদ্দ’শ বছর আগে।
ধরা যাক একদিন
একটা পুরোনো মানুষ বিক্রির হাটে
একটা অগভীর কূপ আর বয়সের ভারে
হেলে পড়া খেজুর গাছের পাশে
এক অনারব বণিক আমাকে নিলামে তুলল।
এবং এক ধনাঢ্য আরব—
আমাকে ক্রয় করল একেবারে সস্তা দামে।
যেহেতু যুগটা আদিম এবং
আমাকে সে কিনে এনেছে
মানুষ বেচাকেনার হাট থেকে
সুতরাং সে আমার মনিব আর
আমি তার ক্রয়কৃত গোলাম।
আমি তার বেঁধে দেওয়া কাজ করি
পানি টানা, বাগান পরিচর্যা আর মেষ চরানো।
যুগটা আদিম এবং এখানে মানুষই মানুষের প্রভু।
তাই মনিবের সেবা আর শুশ্রূষায়
গুণ আর কীর্তনে
আদেশ আর নির্দেশের ঘূর্ণন চক্রেই কেটে যাচ্ছিল
যাপিত জীবন।
তারপর একদিন
বিষণ্ণ বিকেলের সূর্যটা ঢলে পড়ছিল
পাথুরে পাহাড়ের কোলে।
লু হাওয়ার গায়ে লাগছিল শীতলতার প্রলেপ
আসমান গুটিয়ে নিচ্ছিল তার নীলবরণ চাদর।
এমনই মন উদাস করা একখণ্ড বিকেলবেলায়
হয়তো আধো ঘুম আর আধো জাগরণের
কোনো এক মুহূর্ত হবে সেটা
কতিপয় অপরিচিত শব্দের কলকাকলিতে
সচকিত হয়ে উঠবে আমার কান;
দিঘির জলে ডুব দিয়ে উঠে যেভাবে গা ঝেড়ে নেয় ডুবো-হাঁস।
কয়েকজন মানুষের একটি ছোট্ট কাফেলা
চেহারায় তাদের পথের ক্লান্তি
শরীরে অপুষ্টির অবসাদ
তবু দীপ্তিময় তাদের চোখ
হাস্যোজ্জ্বল তাদের মুখাবয়ব।
তাদের একজন এসে বলবে
‘শোনো ভাই! গোলামি করো শুধু আল্লাহর
তিনি ছাড়া আর কোনো প্রভু নেই, নেই ইশ্বর।’
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আমি জানতে চাইব, ‘আল্লাহ? তিনি কে?’
‘তিনি এক এবং অদ্বিতীয়৷ তাঁর নেই কোনো অংশীদার।
সমস্ত রাজত্ব তাঁরই। তিনিই রাজাধিরাজ।’
‘তিনি কোথায় থাকেন?’
‘রাহমান! তিনি আরশের ওপরে সমাসীন।
বান্দার অতি নিকটেও তাঁর বাস
যতোখানি নিকটে আসলে টের পাওয়া যায় শ্বাসের আওয়াজ।’
‘কে তাঁকে চিনিয়েছেন?’
‘মুহাম্মাদ! তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল;
তাঁর কাছে নাযিল হয়েছে কিতাব।’
‘তিনি কি রাজা?’
‘তা নয়। তাঁর জীবন বড় সাদামাটা!’
‘গরিবদের সাথে মেশেন?’
‘গরিবেরাই তাঁর অধিক অনুসারী।’
‘অভাবীকে খাওয়ান?’
‘নিজের পাত্রেরটুকও তুলে দেন।’
‘কী তাঁর প্রচারিত বাণী?’
‘আহাদ! আহাদ! আল্লাহ এক! আল্লাহ এক!’
তারপর—
আমি ভুলে যাব দুনিয়ার সমস্ত সুর;
সমস্ত গান আর কবিতা বিস্মৃত হয়ে
সেই ‘আহাদ’ শব্দই হয়ে উঠবে আমার একমাত্র ভাষা।
এবং সেই আরব ব্যক্তি
একদিন যে আমাকে কিনেছিল
আদম কেনাবেচার হাট থেকে
একেবারে সস্তা দামে;
আমার পদযুগলে এতোদিন বাঁধা ছিল
যার গোলামির শক্ত শেকল—
আমাকে সে শুইয়ে দিবে তপ্ত বালুকাময় প্রান্তরে।
মাথার ওপরে গনগনে সূর্য
পিটের নিচে কয়লা-পোড়া বালি;
তৃষ্ণায় আমার বুক ফেটে যাবে
তপ্ত বালির বিছানাও ফুলে ফেঁপে উঠবে
আমার গায়ের ঘামে।
তবু আমার ভাষা হারাবে না
‘আহাদ আহাদ বলে কাঁদতে কাঁদতে
অথবা
চিৎকার করতে করতে
নতুবা
ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমি
দুনিয়াকে জানিয়ে দেবো
তোমাদের কারো গোলামিই মানি না আর!
তারপর—
আমার চোখ ভেঙে ঘুম নামবে;
পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত আর ঘর্মাক্ত
ঘুমের আবেশে জড়ানো
স্বপ্নে ধরা দেবেন এক সুদর্শন মানব।
তিনি বলবেন—সুসংবাদ লও!
তোমাকে দান করা হয়েছে বিরল সম্মান!
‘আহাদ আহাদ’ বলে যে কন্ঠকে
উচ্চকিত করেছ আজ
বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভাসিয়ে দিয়েছ
তাওহিদের যে ব্যঞ্জনা
আজ হাত পেতে নাও তার পুরস্কার।
তোমার কন্ঠধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হবে দুনিয়া;
সালাত আর কল্যাণের দিকে তুমিই হবে আহ্বানকারী;
ইসলামের তুমিই হবে মুয়াজ্জিন।
তারপর এক ধনাঢ্য আরব লোক
আবু বাকার—ভারি ভালো মানুষ;
আমাকে পুনরায় ক্রয় করে মুক্ত করে দেবেন।
মানুষের গোলামির শেকল ছেড়ে
আমি গায়ে জড়াব তাওহিদের শেকল
যে শেকলে আমি পেয়ে যাব শ্বাশ্বত মুক্তি!
মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—
যার কন্ঠ থেকে একদিন ধার করেছিলাম ‘আহাদ’ শব্দ
আমাকে দেখে তিনি ভারি উচ্ছ্বসিত হবেন!
তাঁর অবয়বজুড়ে থাকা বেহেস্তের প্রশান্তি
আমার দেহ আর মনে
বইয়ে দেবে খুশির কল্লোল।
তাঁর দুহাতে চুমু খেতে খেতে আমি বলব—
ফিদাকা ইয়া আবি ওয়া উম্মি ইয়া রাসূলাল্লাহ!
আমার পিতা মাতা আপনার তরে কোরবানি হোক
হে আল্লাহর রাসুল!
আলগোছে
তিনি আমাকে বুকে টেনে নেবেন;
বুকে পাথর চাপার যে যন্ত্রণা এতদিন
আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত;
তপ্ত বালুতে দগ্ধ হওয়া যে শরীরে ছিল ব্যথার দহন
নবিজির আলিঙ্গনে সে যন্ত্রণা উধাও হয়ে যাবে।
মাঝে মাঝে ভাবি
যদি স্মৃতি প্রতারণা করত
আর পৃথিবী ফিরে যেত আরও আদিম সময়ে;
সাড়ে চৌদ্দ’শ বছর আগে।
নবিজির দেখা পাওয়ার আশা পেলে
আমি নিঃসংকোচে
হাটে মাঠে বিক্রি হতে রাজি
আরব আর অনারব—
যতো খুশি আমার বুকের ওপর তুলে দিক
শক্ত পাথর।
নবিজির আলিঙ্গন পেলে
বুকে উহুদ পাহাড় উঠে গেলেও ক্ষতি নেই।
আরিফ আজাদ হাফি.