02/11/2025
‘মওদূদীর ইসলাম’ বলতে আসলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নাই। মওদূদী রহ. মুসলিমদের জন্য একটা পলিটিকাল ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছেন। কোটি মুসলিম সেই ফ্রেমওয়ার্ককে এডপ্ট করেছে। হাজারো মুসলিম জীবন দিয়েছে, জেল-জুলুম খেটেছে। সেই ফ্রেমওয়ার্ক ভুল কী শুদ্ধ, সেই আলাপে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মওদূদী “নতুন ইসলাম” ইনভেন্ট করেছেন, এইটা ফালতু আলাপ। মওদূদীর আগেও সাইয়েদ কুতুব, হাসান আল বান্নাহরা এরকম ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছেন। এগুলো উনাদের ইজতিহাদ। ইজতিহাদ ভুল হলেও সাওয়াব পাবেন, সঠিক হলে ডাবল সাওয়াব পাবেন। কিন্তু, ‘মওদূদীর ইসলাম’ বলে একটা গ্রুপকে ডিলেজিটিমাইজ করার চেষ্টা করা একটা হঠকারিতা।
জামায়াতের মধ্যে বিভিন্ন আকীদা ও ফিক্বহের অনুসারী আছেন। জামায়াত এই ব্যাপারে বাকি সবার চেয়ে বেশি ইনক্লুসিভ। জামায়াতের মধ্যে হানাফী আছে, সালাফি আছে, আছারী আছে, মাতুরীদীও আছে। কিন্তু, তারা একটা আমব্রেলার নিচে থাকে। সেই আমব্রেলাটা হলো ‘ইকামাতে দ্বীন’ এর আমব্রেলা। অর্থাৎ, বিভিন্ন মাসলাক ও আকীদার মানুষজন দ্বীন ইসলাম কায়েম করার একটা আন্দোলনে একত্রিত হয়েছে একটা জায়গায়। এরা মওদূদীর আকীদা ধারণ করে না। ফলে, এদেরকে মওদূদীর ইসলাম বলার সুযোগ আসলে নাই।
তাহলে মওদূদীর ইসলামটা আসলে কী? মওদূদীর ইসলাম মূলত পলিটিকাল ইসলাম। আমরা দেখেছি কলোনিয়ালিজমের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় মুসলমান তার রাজনৈতিক কর্তাস্বত্তা হারিয়েছে। ক্ষমতা কাঠামো থেকে মুসলমানদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কলোনাইজাররা যাওয়ার পরেও রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়ে গেছে কলোনিয়াল সিস্টেম। এখন এই সিস্টেমের ভেতর সাধারণ মুসলিমরা একরকম অসহায়ের মত। তার ভয়েসের কোনো দাম নাই। মেজরিটি হয়েও তার জীবন হয়ে থাকে কৃতদাসের মত। রাষ্ট্র কীভাবে চলবে সেখানে বক্তব্য দেয়া তো দূর কী বাত, সে নিজে সমাজে কীভাবে চলবে, সেটাও ঠিক করে দেয় সর্বগ্রাসী সেকুলার রাষ্ট্র। আর এই জায়গায় বিদ্রোহ করে মওদূদীর পলিটিকাল ইসলাম। সে রাষ্ট্র কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। সে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায়। মুসলমানের কর্তাসত্ত্বা ফেরত আনতে চায়। ফলে সেকুলার জমিদারিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এদেরকে দমন করা জরুরী হয়ে পড়ে।
এখন, যেহেতু পলিটিকাল ইসলাম ক্রমেই নিপীড়িত মুসলমানের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে পড়ে, তাই একে কেবল পেশিশক্তি দিয়ে দমন করা কঠিন হয়ে যায়। তখনই, অল্টারনেটিভ স্ট্র্যাটেজি নিতে হয়। আওয়ামীলীগ জামায়াতকে দুইটা জিনিস দিয়ে দমন করতো। এক. একাত্তর ইস্যু। দুই. ইসলাম ইস্যু। একাত্তর ইস্যু দিয়ে দীর্ঘকাল আওয়ামীলীগ জামায়াতকে দমন করার চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শক্তি প্রয়োগ করতে সফল হলেও জনমনে সে জামায়াতের ব্যাপারে ঘৃণা উৎপাদন করতে সক্ষম হয়নাই। কারণ, জামায়াতকে সাধারণ মুসলিমরা তাদের ভয়েস হিসেবেই দেখেছে। ফলে, জামায়াতের কণ্ঠরোধ করাকে তারা নিজেদের কণ্ঠরোধ করাই ভাবতো। এজন্য, আওয়ামীলীগ ইসলাম ইস্যুও ব্যবহার করে। তারা বলে, ‘নীল নদের পানি যেমন নীল না, জামায়াতে ইসলামীও তেমন ইসলাম না’। এজন্য তারা এই ‘মওদূদীর ইসলাম’ টার্মটা ব্যবহার করতো। মওদূদীর আকীদা ভ্রান্ত আকীদা। জামায়াতে ইসলামী এই কারণে ভ্রান্ত। এদের ইসলামকে প্রকৃত ইসলাম ভাবা যাবে না। আওয়ামীলীগের এই ন্যারেটিভকে কওমী ঘরানার একটা বড় অংশ তাদের ইসলামী চেতনার জায়গা থেকে সমর্থন দিতো। কেননা, তারা বহু বছর থেকে এটাই জেনে এসেছে যে, মওদূদীর আকীদা আসলেও ভ্রান্ত। ফলে, জামায়াতে ইসলামী একটা ভ্রান্ত দল।
এখন, এই বয়ান বিশ্বাস ও প্রচার করার কারণে জামায়াত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ‘মূলধারার’ ইসলামের তেমন কিছু আসবে যাবে না, এমনটা তারা ভাবতেন। কিন্তু, দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। জামায়াতকে দমন করা শেষে শুরু হলো সাধারণ ইসলামপন্থীদের দমন-পীড়ন। হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্ত্বরে গেল নবীপ্রেমের জন্য। তখন হেফাজতকে বলা হলো, ‘জামায়াতী মুদ্রার অপর পিঠ’। রাতের আঁধারে হত্যা করা হলো শত শত আলেম ওলামা ও মাদ্রাসা ছাত্রদের। এরপর শুরু হলো ইসলামপন্থীদের ‘জ-গি’ বানিয়ে গুম-খুন করা, সামান্য প্রতিবাদ করলেও জেলে ঢুকিয়ে দেয়া। ফলে, মওদূদীর ইসলামকে দমন করার ফলাফল দীর্ঘমেয়াদে রূপ নিলো ইসলাম দমনে। কিন্তু, যতক্ষণে কওমী ঘরানার আলেম-ওলামারা তা বুঝলেন, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেল।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইসলামপন্থীদের জন্য একটা ব্রিদিং স্পেস তৈরি হলো। দেখা গেল, দীর্ঘদিন নির্যাতিত হওয়ার ফলে জামায়াতে-ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল বহুগুণে। গণঅভ্যুত্থানের পরপরই বিভিন্ন পক্ষ পুরনো কায়দায় ৭১ ইস্যু দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করায় সেটা ব্যাকফায়ার করলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিবির ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টরি পেল। ৭১ ইস্যু ব্যর্থ হওয়ায় এখন দ্বিতীয় ট্যাকটিক সামনে আনা হয়েছে। ‘মওদূদীর ইসলাম’ – সেই পুরনো আওয়ামী ন্যারেটিভ। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ এই কথাটি বলেছেন। কোথায় বলেছেন? হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত এক সমাবেশে। আবারও হেফাজত পুরনো ভুলটিই করছে। মনে রাখতে হবে, যারাই ‘মওদূদী ইসলাম’ জুজু এনেছে, তাদের কারো উদ্দেশ্যই ভালো ছিলো না। তাদের আল্টিমেট টার্গেট ছিলো ‘পলিটিকাল ইসলাম’, যখনই কোনো মুসলিম ‘রাজনৈতিক’ হয়ে উঠেছে, তারা কোনো না কোনো কার্ড ব্যবহার করে তাদেরকে ডিলেজিটিমাইজ করার চেষ্টা করেছে। হেফাজত আবারও সেই টোপ গিলছে। ‘এখন বুঝবি না, পরে বুঝবি, সব হারায়ে তারপর বুঝবি’।
নির্যাতিত ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী তার ফেসবুকে একটা স্টোরি দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘জামায়াতবিরোধিতাই পরে ইসলামবিরোধিতায় রূপ নেয়’। এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবলেই হবে এই আরকি।