09/12/2025
রোকেয়ার জন্মদিন 'উদযাপন'-এ ইসলাম নিয়ে তার বিশেষ উক্তিগুলো-
“আমাদিগকে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে “ঈশ্বরের আদেশপত্র” বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশজনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই আপনাকে ঈশ্বরপ্রেরিত দূত কিংবা দেবতা বলিয়া প্রকাশ করিয়া অসভ্য বর্বরদিগকে শাসন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন।...
ক্রমে জগতের বুদ্ধি বেশি হওয়ায় সুচতুর প্রতিভাশালী পুরুষ দেখিলেন যে, পয়গম্বর” বলিলে আর লোকে বিশ্বাস করে না। তখন মহাত্মা ঈশা আপনাকে দেবতার অংশবিশেষ (ঈশ্বরপুত্র !) বলিয়া পরিচিত করিয়া ইঞ্জিল গ্রন্থ রচনা করিলেন। তাহাতে লেখা হইল, ‘নারী পুরুষের সম্পূর্ণ অধীনা—নারীর সম্পত্তিতে স্বামী সম্পূর্ণ অধিকারা।’ আর বুদ্ধি—বিবেকহীনা নারী তাই মানিয়া লইল।
তারপর মহাত্মা মহম্মদ আইন প্রস্তুত করিলেন যে, ‘রমণী সর্ব্বদাই নরের অধীনা থাকিবে, বিবাহের পূর্ব্বে পিতা কিংবা ভ্রাতার অধীনা, বিবাহের পর স্বামীর অধীনা, স্বামী অভাবে পুত্রের অধীনা থাকিবে।’ আর মূর্খ নারী নত মস্তকে ঐ বিধান মানিয়া লইল।
ভগিনি, তোমরা দেখিতেছ এই ধর্ম্মশাস্ত্রগুলি পুরুষরচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পাও, কোন স্ত্রী মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতে। ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বরপ্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণীশাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত কেবল এসিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া “রমণীজাতিকে নরের অধীন থাকিতে হইবে” ঈশ্বরের এই আদেশ শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এসিয়ারই ঈশ্বর? আমেরিকার কি তাঁহার রাজত্ব ছিল না? ঈশ্বরদত্ত জল বায়ু ত সকল দেশেই আছে—কেবল দূতগণ সৰ্ব্বদেশময় ব্যাপ্ত হন নাই কেন? যে কথা পুরাকালে অসভ্য বর্ব্বরগণ বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহা বর্ত্তমান কালের সুসভ্যগণ যদি বিশ্বাস করেন, তবে সভ্যতায় ও অসভ্যতায় প্রভেদ কি? যাহা হউক এখন আমরা আর ধর্ম্মের নামে নতমস্তকে নরের প্রভুত্ব সহিব না।
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৬১০-৬১১, ৫৯৪]
দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারি নাই, তাহার প্রধান কারণ এই যে, যখনই কোনো ভগিনী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্ম্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে ! আমরা প্রথমতঃ যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্ম্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য্য করিয়াছি।
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৬১০]
“এখন মুসলমান সমাজে প্রবেশ করা যাউক। মুসলমানের মতে আমরা পুরুষের ‘অর্দ্ধেক’, অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্যা। অথবা দুইটি ভ্রাতা ও একটি ভগিনী একত্র হইলে আমরা ‘আড়াই জন’ হই!...আপনারা ‘মুহম্মদীয় আইনে’ দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্দ্ধেক ভাগ পাইবে।...
[কিন্তু] আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের ‘অর্দ্ধেক’ নই। তাহা হইলে এইরুপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইত—পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ মাস!!...আমরা জননীর স্নেহ মমতা ভ্রাতার সমানই ভোগ করি। মাতৃহৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই।
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ২৯,৩১]
যিনি যত বেশি পর্দ্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেঁচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশি শরীফ।
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৩৮৫]
ট্রেণ আসিবার সময় জনৈক ইংরাজ কর্মচারী ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে হাজী সাহেবকে বলিলেন, “মুন্সি ! তোমারা আসবাব হিয়াসে হাটা লো। আভি ট্রেণ আয়েগা—প্লাটফরম পর খালি আদমি রহেগা—আসবাব নেহি রহেগা।” হাজী সাহেব যোড়হস্তে বলিলেন, “হুজুর, ঐ সব আসবাব নাহি—আওরত হায়।” কর্মচারিটী পুনরায় একটা “বস্তায়” জুতার ঠোকর মারিয়া বলিলেন, “হা, হা--এই সব আসবাব হাটা লো।” বিবিরা পর্দার অনুরোধে জুতার গুতা খাইয়াও টু শব্দটী করেন নাই।
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা 387]
[এক মহিলা] কোনো বাঙ্গালী ভদ্রলোকের বাড়ী শাদীর নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন। তাঁহাকে [বোরকা সহ] দেখিবামাত্র সেখানকার ছেলে-মেয়েরা ভয়ে চীৎকার করিয়া কে কোথায় পলাইবে, তাহার ঠিক নাই।
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৪০০]
[সেই মহিলা] একবার কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। তাঁহারা চারি পাঁচ জনে বোরকাসহ খোলা মোটরে বাহির হইলে পথের ছেলেরা বলিত, “ওমা! ওগুলো কি গো?” একে অপরকে বলে “চুপ কর!-এই রাত্রিকালে ওগুলো ভূত না হয়ে যায় না।” বাতাসে বোরকার নেকাব একটু আধটু উড়িতে দেখিলে বলিত— “দেখরে দেখ। ভূতগুলোর শুঁড় নড়ে—! বাবারে! পালা রে!”
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৪০০-৪০১]
পথের লোক রোরুদ্যমান শিশুকে চুপ করাইবার নিমিত্ত তাঁহাদের দিকে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বলিত,—“চুপ কর, ঐ দেখ মক্কা মদিনা যায়,—ঐ!”-ঘেরাটোপ জড়ানো জুজুবুড়ী,—ওরাই মক্কা মদিনা!!”
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৪০১]
“গত বৎসর পর্য্যন্ত আমি আলীগড়ে ছিলাম। যেহেতু সেখানকার ষ্টেশন একরূপ জাঁকজমকে ই. আই. আর. লাইনে অদ্বিতীয় বোধ হয়, সেই জন্য আমি প্রত্যহই পদব্রজে ভ্রমণের সময় ষ্টেশনে যাইতাম। সেখানে অন্যান্য তামাসার মধ্যে অনেকগুলি ১৩শ শতাব্দীর বোরকা আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছিল। আর খোদা মিথ্যা না বলান, প্রত্যেক বোরকাই কোনো না কোনো প্রকার কৌতুকাবহ ছিল।”
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৪১২]
রোকেয়ার আফসোস,
“কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে
কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে!”
[রোকেয়া রচনাবলি, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৪১৪]
[সচরাচর কিছু শেয়ার করার কথা বলি না। তবে এটা কপি পেস্ট করে শেয়ার করতে পারেন সকলে।]