
08/10/2025
একজন গুপ্ত শিবিরের গুপ্তনামা-
ছবিতে যাকে দেখছেন তিনি ঝিনাইদহ উপজেলার কালিগঞ্জ পৌরসভার চাপালী গ্রামে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন সদস্য ছিলেন। ছিলেন পৌরসভা শিবিরের সভাপতিও। উনার নাম আবু জার গিফারী। উনার বয়স ২২। পড়াশোনা করতেন কে সি (কেসবচন্দ্র) কলেজে, অনার্স ২য় বর্ষে।
সেদিন ছিলো ১৮ মার্চ শুক্রবার। আবু জার গিফারীর অভ্যাস ছিলো তিনি প্রতি জুমআর দিনে আজানের সাথে সাথেই মসজিদে চলে যেতেন। সেদিনও তিনি তার এই নিয়মিত আমলটি অব্যাহত করলেন।
পাঞ্জাবি পরে তিনি তার আম্মাকে বললেন, মা কিছু খেতে দাও। উনার মা বললেন, বাবা এখনো তো রান্না হয়নি আর ঘরে খাবারের মত তেমন কিছু নেই।' আমাদের আবু জার ভাই একটা মুচকি হাসি দিলেন।
হাসি দিয়ে মাকে বললেন, “আচ্ছা আম্মা, জুমআর নামাজ শেষে বাড়ি এসে খেয়ে নেবো, দোয়া করো আমি নামাজে গেলাম।”
এই যে মাকে বলে গেলেন, 'দোয়া করো নামাজে যাই।' এই বিদায়টাই ছিলো আবু জার গিফারী ভাইয়ের তাঁর মায়ের সাথে বলা শেষ কথা। কিভাবে এটিই শেষ কথা? এখন তা বলছি।
জুমআর নামাজ শেষ হলো। আবু জার গিফারী বাড়ীতে ফিরবেন বলে মসজিদ থেকে রওনা দিলেন। হঠাৎ রাস্তায় দেখা গেলো ডিবি পুলিশ। সাথে সাথে এরা গাড়ী থেকে নেমে আবু জারকে তুলে নিয়ে যেতে চায়।
কিছু বুঝে উঠার আগেই টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। নেয়ার কালে অনেক চিল্লাচিল্লি হয়, আওয়াজ শুনে আবু জার এর ফুফু ও মা বের হোন বাড়ী থেকে। মা অনেক কাকুতিমিনতি করেন ডিবি পুলিশকে। কিন্তু তারা শুনেনা।
শেষ পর্যন্ত কলিজার টুকরা ছেলেকে বাঁচানোর জন্য মা ডিবি পুলিশের পায়ে ধরলেন। পায়ে ধরে বললেন, আমার সোনার বাবাকে তোমরা ছেড়ে দাও, কোথায় নিয়ে যাবা?
এতেও তাদের কর্ণপাত হলোনা তাদের। কি পরিমাণ নিষ্ঠুর হলে এমনটা সম্ভব! উলটো সেই মাকে জোরে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে আবু জারকে মোটরসাইকেলে তুলে নেয়। সাথে সাথে বেঁধে নিলো দু’টি হাত, নড়াচড়া করার মতো শক্তিটুকুও কেড়ে নিলো তার থেকে।
এমনভাবে তারা ধরলো, মুখে মায়ের সাথে শেষ কথাটা বলার মতো সুযোগও দিলো না। আবু যর ভাই শুধু বললেন, 'মাগো ও মা দোয়া করো আমার জন্য।'
এলাকার মানুষ ভয়ে, ক্ষোভে নির্বাক হয়ে রইলো।
আবু জার গিফারীর দোষ উনি শিবির করেন। এভাবে একে একে ২৬ টি দিন চলে গেলো। তার খোঁজ নাই। যেন আয়নাঘরে তাকে রাখা হয়েছে।
মা খোঁজ নেন। প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন খোঁজ নেন কিন্তু আবু জার তো আর পাওয়া যায়না। এরমধ্যে একটি দিনও বাদ যায়নি ওরা নির্যাতন করেনি তার উপর। অবশেষে ১৩ এপ্রিল রাতে ফজরের আগে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
কোথায় গুলি করেছে জানেন? একেবারে যে জায়গাটি দিয়ে সিজদা করা হয় সেই কপালের মাঝখানে।
তাকে হত্যা করেই শেষ হয়নি। তারা লাশটি পাশের নর্দমায় ফেলে রাখে তারা। সাথে আরেকটি লাশ ছিলো। তাঁর নাম শামীম মাহমুদ। উনাকে তুলে নিয়েছিলো ২৩ মার্চ।
আহ! খেতে চাইলেন ভাত, হয়ে গেলেন লাশ!
অর্ধেকটা শরীর কাদামাটি ও অর্ধেক শরীর পানিতে পরে রইলো। সকাল হলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। আমি খবরটি দেখি ফেইসবুকে সকাল ১১ টায়। দেখি প্রিয় আবু জার ভাইয়ের নিথর দেহ পরে আছে একটি ঠেলাগাড়িতে। মা আসলেন। এসে কি বললেন, জানেন?
শহীদ আবুজার গিফারীর মা চোখের পানি মুছতে মুছতে কান্না করছেন আর বলছেন, “বাবা আমার নামাজ শেষে বাড়ি আসবে খাবার খাবে। এই বুঝি আসছে আমার সোনা মানিক। আমার সোনা ২৬ দিন পর লাশ হয়ে আমার বুকে ফিরে আসছে।”
মা আরো বললেন, বাবারে নবীর সাহাবী আবু জার গিফারীর নামের সাথে শখ করে তোমার নাম আবু জার গিফারী রেখেছিলাম। বাবা তুমি শহীদ হয়েছো। তুমি শহীদ হয়েছো। আল্লাহ তুমি আমার বাবাকে শহীদ হিসেবে কবুল করো।
আমাদের প্রিয় শহীদ আবু জার গিফারী ভাইকে এলাকার সবাই ভালোবাসতেন। তার মা তাকে এক মুঠো ভাত দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ২৬ দিন পর লাশ হয়ে ফিরে আসেন।
আমাদের শহীদ আবু জার গিফারী রহমতুল্লাহি আলাইহি। মায়ের হাতের শেষ লোকমা ভাত টুকুও জুটলো না তার। জালেমরা তাকে শহীদ করে দিলো।
শহীদ আবু জার গিফারী রহ. শহীদ হওয়ার ৩ মাস আগে ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, “ওগো দয়াময় অসীম ও অপার শহীদি মরণ দিয়ো মিনতি আমার।’’
মহান রব সেই আশা পূরণ করেছেন। এটাই ছিলো সেই গুপ্ত শিবিরের ইতিহাস।
(কমেন্টে কিছু চিত্র দিচ্ছি)
- Saifullah Mohammad Tufayal