12/06/2024
এক গ্রামে ছিল দুই বন্ধু। তারা ছিল বড়ই গরীব। তারা ফাঁদ পেতে বন-মোরগ ধরত, শামুক-ঝিনুক-কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করত।
তাদের প্রায় নয়-দশ দিনের খোরাকী নিয়ে গভীর জঙ্গলে যেতে হতো।বন-মোরগ, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, কচ্ছপইত্যাদি পেলে বাড়ী এসে কিছু বিক্রি করত আর কিছু নিজেরা রান্না-বান্না করে খেত। এভাবে তাদের দিন কাটছিল অনেক দুঃখে।
একদিন তারা জঙ্গল থেকে বাড়ী ফিরছিল। জঙ্গলে জঙ্গলে দিন-রাত কাটাতে কাটাতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছিল।
পথিমধ্যে হঠাৎ শুনতে পেল লোকালয়ের শব্দ, হৈ-হুল্লোর। এক বন্ধু উঁচু গাছের ডগায় উঠে চারিদিকে দেখল, সত্যি তারা এসে গেছে এক গ্রামের নিকট।
তারা খুব দ্রুত পথ চলতে চলতে পৌঁছে গেল সেই গ্রামে। গ্রামের প্রবেশ পথে সুন্দর এক বৌদ্ধ বিহার। বিহারে কয়েকজন ভিক্ষু আর বেশ কয়েকজন বালক শিক্ষানবীশ। তারা এক রাত থাকার জন্য বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুর নিকট অনুমতি চাইল।
থাকার জন্য স্থান দেখিয়ে দিল বড় রান্না ঘরটি। সন্ধ্যা হতে না হতে গ্রামের লোকজনের আওয়াজ, গরু-মহিষের ঘন্টির শব্দ, শিশুদের কান্নাকাটির আওয়াজ সবই বন্ধ হয়ে গেল। চারিদিকে ঝি ঝি পোকার শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই।
রাতে তারা রান্না শুরু করে দিল, রান্নাবান্নার পর মিটিমিটি চেরাগের আলোয় রান্না ঘরেই খেতে বসল। এমন সময় বিরাট গম্ভীর গলায় একটি কণ্ঠ বিহারের ভিক্ষুর শয়নকক্ষ থেকে ভেসে এলো। তখন তারা শামুক রান্না করা চুষে চুষে খাচ্ছিল।
এই তোরা চুক চুক করে কি চুষে খাচ্ছিস্, চুক চুক চুক আমাকে একটু দে …….।
দুই বন্ধুর আর বুঝতে বাকী রইল না, এটা প্রেত ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ তারা জানে ভিক্ষুরা রাতে খায় না। তাছাড়া এর কণ্ঠ বিকট, কর্কষ আর গম্ভীর। তারা ভয়ে ভয়ে বলল, আসতেছি।তোদের আসতে হবে না, আমার এইখানে তুলে দে।
এই কথা বলার পর পরই একটি বিরাট জিহ্বার অগ্রভাগ রান্না ঘরে প্রবেশ করল। জিহ্বার সেকি ভয়ানক বিশ্রী গন্ধ। আর তা জলে ভেজা, লালসার জল টপটপ করে পড়ছে।
সঙ্গে সঙ্গে ওরা ভয়ে কতক শামুক জিহ্বায় তুলে দিল। প্রেত ভিক্ষু কট্টর মটর করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেই পূর্বের ন্যায় আবার চাইতে লাগল।
শামুক শেষ হলে ঝিনুক, ঝিনুক শেষ হলে কাঁকড়া জিহ্বায় তুলে দিল। এবার দেবার কিছু নেই। ওদিকে ভোর হতে অনেক বাকী। এমন সময় তাদের সাথে করে আনা মোরগটি কোর কোর আওয়াজ করল। প্রেতটি আবার শুরু করল, তাঁরে, কোর কিরে, আমাকে কোর একটু দে।
ওরা এবার সময় কাটানোর জন্য প্রথমে মোরগের পালক, পরে চামড়া, পরে মাংস ইত্যাদি অল্প অল্প করে দিতে লাগল। তারা জানত যে ভোর হলে ভূত-প্রেতের শক্তি কমে যায়, আর মানুষের শক্তি বৃদ্ধি পায়। তাই তারা মোরগের মাংস অল্প অল্প করে দিয়ে সময় কাটাতে লাগল ।
হারে, মানুষের বাচ্চারা, তোরা কি করছিস, কোরক কি শেষ? দিবি, না আমায় বেরিয়ে আসতে হবে, দে দে ……… তাড়াতাড়ি দে।
এ দিকে দুই বেচারা ভয়ে জড়সড়। রান্না ঘরের এক কোণায়। দেবার মত তাদের আর কিছুই নেই। ওরা দুই জন নিরস্ত্র আর ওদিকে ভূত। ভয় করে লাভ নেই।
ওরাদু’জনে ফন্দি আঁটল, যদি ভূতের সাথে লড়তেই হয়, তাহলে এক সঙ্গে দু’জনে লড়বেনা, লড়বে পালাক্রমে। তারপর আবার ভূতের শাসানি।
হ্যাঁরে ! মানুষের বাচ্চারা, দে.. দে আমাকে কিছু খেতে দে। নইলে ভাল হবে না বলছি। এবার তারাও প্রস্তুত। প্রথমে একজন তৈরী হয়ে রইল। অপরজন এক কোণে নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এবার দুই বন্ধুও বলল, তবে আয়, তোর একদিন কি আমাদের একদিন।
এইভাবে পালাক্রমে লড়ে চলল। অথচ দুই বন্ধুর কেউই ক্লান্ত হলো না।
ওদিকে ভোর যত হতে লাগল, একাকী ভূত ক্লান্ত হতে লাগল, শক্তি কমে যেতে লাগল। এক পর্যায়ে ভূত হাঁফাতে হাঁপাতে বলল, আমায় ছেড়ে দে ভাই তোরা, আমাকে মাফ কর, ভাই।
তোর মাফ নেই, তুই আমাদের সব খেয়েছিস, আর আমাদের খুব ভয় দেখিয়েছি, এবার তোর রক্ষা নেই।
এই বলে ভূতের কাটা বগলে চেপে ধরে চালাতে লাগল তার ন্যাড়া মাথায় শত শত ঘুষি। অবশেষে ভূত বলল, আমাকে তোরা ছেড়ে দে, তোদের আমি একটি সোনার পাতিল আর একটি রূপোর পাতিল দেব, সিড়ির গোড়ায় মাটির নীচে পোঁতা আছে। এক বন্ধুকে অন্য বন্ধু, যা দেখে আয়, সত্যি কি-না বন্ধু।অন্য বন্ধু গিয়ে দেখে, হঁ যা হঁ, ঠিক কথা ছেড়ে দে, ছেড়ে দে।
তখন সূর্য উঠেছে, ভূতটাকে ছেড়ে দিল, সিঁড়ির গোড়া থেকে সোনা-রূপার পাতিলগুলো তুলে নিল। দুই বন্ধুবাড়ী ফিরে গিয়ে সোনা-রূপার পাতিল বিক্রিকরে হয়ে গেল বিরাট জমিদার। বাকী জীবন দান-দক্ষিণা করে আরাম-আয়েসে কাটিয়ে দিল।