08/10/2023
ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী ও ইমাম আবুল হাসান আশআরী
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মহান দুই মুখপাত্র
মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ইমাম মাতুরীদী
ইমাম মাতুরীদীর নাম মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন মাহমুদ। উপনাম আবু মানসুর। সমরকন্দের নিকটবর্তী একটি মহল্লার নাম মাতুরীদ। তিনি সেখানকার অধিবাসী ছিলেন। সেদিকে সম্পৃক্ত করেই তাঁকে মাতুরীদী বলা হয়। বিভিন্ন শক্তিশালী আলামত থেকে বোঝা যায়, ২৪০ হিজরীর কাছাকাছি সময়ে তাঁর জন্ম হয়ে থাকবে। ওফাত হয়েছে ৩৩৩ হিজরীতে।
তাঁর উসতাযগণের মধ্যে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে মুকাতিল রাহ. (২৪৮ হি.), ইমাম আবু নসর ‘ইয়াযী, ইমাম নুসাইর ইবনে ইয়াহইয়া বলখী (২৬৮ হি.) এবং ইমাম আবু বকর আহমদ ইবনে ইসহাক জুযজানী রাহ.-এর কথা বিশেষভাবে আলোচিত হয়।
আবু বকর জুযজানী হলেন ইমাম আবু সুলাইমান জুযজানীর শাগরিদ, যিনি ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শায়বানী (১৮৯ হি.)-এর শাগরিদ। আর ইমাম মুহাম্মাদ হলেন ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম সুফিয়ান সাওরীসহ হাদীস, ফিকহ ও আকাইদের অনেক ইমামের শাগরিদ।
এমনিভাবে মুহাম্মাদ ইবনে মুকাতিল রাযী সরাসরি ইমাম মুহাম্মাদের শাগরিদ। অপর দিকে নুসাইর ইবনে ইয়াহইয়া ইমাম আবু সুলায়মান জুযজানীরও শাগরিদ আবার ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সামাআরও শাগরিদ। মুহাম্মাদ ইবনে সামাআ ইমাম আবু ইউসুফের শাগরিদ আর তিনি ইমাম আবু হানীফার শাগরিদ।
মাতুরীদী রাহ.-এর বিশিষ্ট উসতায ইমাম আবু নসর ‘ইয়াযী, যিনি ফকীহ হওয়ার পাশাপাশি অনেক বড় মুজাহিদ ছিলেন। এমনকি জীবনের শেষে তিনি আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাতের মহাসৌভাগ্যও লাভ করেন। তিনিও ফিকহশাস্ত্রে ইমাম আবু বকর জুযজানীর শাগরিদ ছিলেন।
এসব বলার উদ্দেশ্য হল, ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী রাহ.-এর ইলমী সনদ খায়রুল কুরূনের ইমামগণের সঙ্গে যুক্ত। তিনি উসূলুদ্দীন (ইসলামী আকাইদ), হাদীস, তাফসীর, ফিকহ ও উসূলের ইলম আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইমামগণের নিকট হাসিল করেছেন। আর আমৃত্যু তিনি এই নির্ভরযোগ্য ইলমই তাঁর কিতাবসমূহে প্রচার করে গিয়েছেন।
তাঁর মূল ব্যস্ততা ছিল বিভিন্ন ভ্রান্ত ফেরকার খ-ন করা এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের পথ ও আদর্শকে দলীলের মাধ্যমে শক্তিশালী করা। সেজন্যই মুসলিম উম্মাহ তাঁকে ‘ইমামুল হুদা’ উপাধিতে স্মরণ করে। তাঁর কিতাবসমূহের মধ্যে تأويلات أهل السنة ও كتاب التوحيد মুদ্রিত হয়েছে।১
ইমাম আশআরী
ইমাম আশআরী রাহ.-এর উপনাম আবুল হাসান। নাম আলী ইবনে ইসমাঈল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশিষ্ট সাহাবী আবু মূসা আশআরী রা.-এর বংশধর। জন্ম ২৬০হি. আর ওফাত ৩২৪ হি.। বসরার অধিবাসী।
এটা একটা আশ্চর্য বিষয় যে, আবুল হাসান আশআরী রাহ. প্রথমে মু‘তাযিলা ফেরকার বড় ব্যক্তিত্ব আবু আলী জুব্বায়ীর শাগরিদ ও তার আকীদার অনুসারী ছিলেন। আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে পরবর্তীতে তাঁর কাছে মু‘তাযিলাদের গোমরাহী স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে তিনি প্রকাশ্যে তওবা করে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদায় ফিরে আসেন এবং মু‘তাযিলাদের ভ্রান্ত আকীদাসমূহের খ-নে কলম ধরেন। তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকাইদের সমর্থনে এবং বিভিন্ন বাতিল ফেরকার সংশয়সমূহের অপনোদনে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কিতাব রচনা করেন। তার কিতাবসমূহের মধ্যে
‘আলইবানা আন উসূলিদ দিয়ানা’(الإبانة عن أصول الديانة) ,
‘আল লুমা ফির রদ্দি আলা আহলিয যায়গি ওয়াল বিদা’(اللمع في الرد على أهل الزيغ والبدع) ,
‘মাকালাতুল ইসলামিয়্যীন ওয়াখতিলাফুল মুসাল্লীন’ ((مقالات الإسلاميين واختلاف المصلين
‘ইসতিহসানুল খওযি ফী ইলমিল কালাম’ (استحسان الخوض في علم الكلام) ইত্যাদি ছাপা হয়েছে।
আবুল হাসান আশআরী রাহ. ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর ইলম হাসিল করেছেন তাঁর সমসাময়িক শাফেয়ী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ আবু ইসহাক মারওয়াযী থেকে। তিনি আবুল আব্বাস ইবনে সুরাইজের শাগরিদ। ইবনে সুরাইজ হলেন ইমাম আবুল কাসেম আনমাতীর শাগরিদ আর তিনি ইমাম মুযানীর। আর মুযানী ছিলেন ইমাম শাফেয়ীর বিশিষ্ট শাগরিদ।
আবুল হাসান আশআরীর অন্যান্য উসতাযগণের মধ্যে যাকারিয়া সাজী (৩০৭ হি.), আবু খলীফা জুমাহী (২০৬ হি.-৩০৫ হি.), আবদুর রহমান ইবনে খালাফ বসরী (২৭৯ হি.) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এঁদের মধ্যে যাকারিয়া সাজী বহুত বড় হাফিযুল হাদীস এবং মুফতী ছিলেন। তিনি ইলমে ফিকহ হাসিল করেছেন ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর দুই শাগরিদ রবী‘ ও মুযানী রাহ. থেকে।
শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. লিখেছেন-
كان من أئمة الحديث، أخذ عنه أبو الحسن الأشعري مقالة السلف في الصفات، واعتمد عليها أبوالحسن في عدة تآليف.
যাকারিয়া সাজী ইলমে হাদীসের ইমামগণের মধ্যে অন্যতম। আবুল হাসান আশআরী আল্লাহ তাআলার সিফাত সংক্রান্ত বিষয়ে সালাফের নীতি তাঁর থেকেই গ্রহণ করেছেন এবং তিনি তাঁর বিভিন্ন কিতাবে এই নীতিরই অনুসরণ করেছেন। -সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, খ. ১৪ পৃ. ১৯৮
ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী বয়সে ইমাম আবুল হাসান আশআরীর বড় ছিলেন। তাঁর জন্ম ইমাম আশআরীর আগে হয়েছিল, তবে ওফাত হয়েছিল পরে। ওদিকে আশআরী রাহ.-এর মত তাঁর জীবনে দুই ভাগ ছিল না; তিনি শুরু থেকে ওফাত অবধি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি ও আদর্শের উপর অবিচল ছিলেন।
আলআকীদাতুত তহাবিয়্যা
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের এই ইমামদ্বয় ছিলেন ইমাম আবু জাফর তহাবী রাহ.-এর সমসাময়িক। ইমাম আবু জাফর তহাবী হিজরী তৃতীয় শতকের শেষার্ধে ও চতুর্থ শতকের প্রথম এক-চতুর্থাংশে মিসরে ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকহের বড় ইমামগণের অন্যতম ছিলেন। আকীদার দিক থেকে তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইমাম ছিলেন আর মাযহাবের দিক থেকে হানাফী মাযহাবের ফকীহ ছিলেন। তাঁর জন্ম ২৩৯ হিজরীতে আর ওফাত ৩২১ হিজরীতে।
হাদীস শাস্ত্রে তাঁর রচিত ‘শরহু মাআনিল আসার’ ও ‘শরহু মুশকিলিল আসার’ হল তাজদীদী কিতাব। ইলমে ফিকহ ও ইলমে তাফসীরেও তাঁর লিখিত কিতাবগুলো সর্বজন সমাদৃত। তিনি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকাইদ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত কিতাব রচনা করেন, যা ‘আলআকীদাতুত তহাবিয়্যা’ নামে পরিচিত। সমগ্র পৃথিবীতে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি ও আদর্শের মুখপত্র হিসেবে এই কিতাবটি গ্রহণ করা হয়েছে।
এই পুস্তিকার শুরুতে ইমাম তহাবী রাহ. লিখেছেন-
هذا ذكر بيان عقيدة أهل السنة والجماعة على مذهب فقهاء الملة، أبي حنيفة النعمان بن ثابت الكوفي، وأبي يوسف يعقوب بن إبراهيم الأنصاري، وأبي عبد الله محمد بن الحسن الشيباني، رضوان الله عليهم أجمعين، وما يعتقدون من أصول الدين.
ইমাম তহাবী রাহ. এখানে বলেন, তিনি এই পুস্তিকায় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা বর্ণনা করবেন। আর এসব আকীদা তিনি হানাফী মাযহাবের প্রথম সারির তিন ইমাম (ইমাম আবু হানীফা রাহ. ৮০ হি.-১৫০হি., ইমাম আবু ইউসুফ রাহ. ১১৩ হি.- ১৮২ হি. ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ১৩২ হি.-১৮৯ হি.)-এর রেওয়ায়েত ও আকীদা মোতাবেক বর্ণনা করবেন।
যদ্দুর জানি, ইতিহাসে এমন কোনো বর্ণনা সংরক্ষিত নেই, যার দ্বারা বোঝা যায়, এই ইমামত্রয়ের অর্থাৎ ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী, ইমাম আবুল হাসান আশআরী ও ইমাম আবু জাফর তহাবী পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছে। তবে যেহেতু এই তিনজনই ইলমে ওহী ও উলূমে শরীয়তে পারদর্শী ছিলেন এবং দ্বীন ও ইলমে দ্বীন নিয়মমাফিক সালাফে সালেহীনের স্থলবর্তী ইমামগণ থেকে হাসিল করেছেন সেজন্য তাঁরা সকলে একই গন্তব্যে পৌঁছেছেন এবং ইসলামী আকীদার প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে তাঁরা যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন তার ফলাফল একই হয়েছে। তিনজন একই সময়ে ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মাসলাক ও নীতি-আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পার্থক্য এটুকু যে, ইমাম তহাবী সংক্ষেপে শুধু মৌলিক আকীদাগুলো উপস্থাপন করেছেন। আর ইমাম মাতুরীদী ও ইমাম আশআরী সেই আকীদাগুলো ব্যাখ্যা ও দলীলসহ সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি সেসব আকীদার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভ্রান্ত ফেরকা বিকৃতির যে অপচেষ্টা চালিয়েছে তার খ-নও করেছেন। নতুবা মূল আকীদার বিষয়ে এই তিন ইমামের আলোচনায় মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।
এজন্যই আমরা দেখি, মাতুরীদী মাসলাকের অনুসারী অনেক আলেম ‘আলআকীদাতুত তহাবিয়্যা’-এর ব্যাখ্যা লিখেছেন। তবে তাদের কেউই ইমাম তহাবীর সঙ্গে মতবিরোধ করেননি। এমনিভাবে আশআরী আলেমগণও ‘আলআকীদাতুত তহাবিয়্যা’-এর সঙ্গে একমত। এই পুস্তিকা তাদের নিকটও গ্রহণযোগ্য।
আহলুস সুন্নাহ আশআরী বা মাতুরীদী কেন?
এখানে এই কথা স্পষ্ট করে দেয়া জরুরি যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা ما أنا عليه وأصحابي (যে পথে আমি ও আমার সাহাবীরা আছি।)-এর বাস্তবরূপ। চতুর্থ শতাব্দী থেকে এই আকীদার অনুসারী অধিকাংশ মানুষকে আশআরী বা মাতুরীদী বলা হয়। এর কারণ হল, আকীদায়ে আহলে সুন্নতের সংরক্ষণ ও এ বিষয়ে উদ্ভূত বিভিন্ন বাতিল ফেরকার খ-নে এই দুই ইমাম অধিক পরিচিতি লাভ করেন। মুসলিম উম্মাহ তাঁদের এই খেদমত গ্রহণ করে। সেজন্য তাঁদের মাসলাকের অনুসারীগণ ‘মাতুরীদী’ বা ‘আশআরী’ নিসবতে পরিচিতি লাভ করেন।
এই বাস্তবতাটি একাধিক আলেম স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। আমরা এখানে কয়েকজন মনীষীর বক্তব্য উদ্ধৃত করব।
আল্লামা মুরতাযা যাবীদী (১২০৫ হি.) রাহ. লেখেন-
"وليعلم أن كلا من الإمامين أبي الحسن وأبي منصور رضي الله عنهما وجزاهما عن الإسلام خيرا، لم يُبْدِعا من عندهما رأيا، ولم يَشْتَقّا مَذْهَبا، إنما هما مُقَرِّران لمذاهب السلف، مُناضلان عما كانت عليه أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم، فأحدهما قام بنصرة نصوص مذهب الشافعي وما دلت عليه، والثاني قام بنصرة نصوص مذهب أبي حنيفة وما دلت عليه، وناظر كل منهما ذوي البدع والضلالات، حتى انقطعوا ووَلّوا مُنهزمين.
وهذا في الحقيقة هو أصل الجهاد الحقيقي (من أنواع الجهاد باللسان والقلم)، الذي تقدمت الإشارة إليه، فالانتساب إليهما إنما هو باعتبار أن كلا منهما عقد على طريق السلف نطاقا، وتمسك وأقام الحجج والبراهين عليه، فصار المقتدي به في تلك المسائل والدلائل يسمى أشعريا وماتريديا.
وذكر العز بن عبد السلام أن عقيدة الأشعري أجمع عليها الشافعية والمالكية والحنفية وفضلاء الحنابلة، ووافقه على ذلك من أهل عصره شيخُ المالكية في زمانه أبو عمرو ابن الحاجب، وشيخُ الحنفية جمال الدين الحصيري، وأقره على ذلك التقي السبكي فيما نقله عنه ولده التاج "২
মুরতাযা যাবীদী রাহ.-এর এই বক্তব্য তাঁর কিতাব ‘ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন’-এর দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতে (২ : ৬-৭) রয়েছে। ইতহাফ হল ইমাম গাযালী রাহ.-এর কিতাব ‘ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন’-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ। ‘ইহইয়া’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় হল قواعد العقائد অর্থাৎ আকীদা সংক্রান্ত নীতিমালা। এর ব্যাখ্যায় শুরুতে আল্লামা যাবীদী রাহ. ভূমিকা হিসেবে যা লিখেছেন তাতে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআ’ বলতে কাদের বুঝায় সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। উচ্চতর স্তরে অধ্যয়নরত তালিবে ইলমগণ এটি মুতালাআ করতে পারেন। সেখানে আল্লামা যাবীদী রাহ. বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে এ বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন যে, ইমাম মাতুরীদী রাহ. ও ইমাম আশআরী রাহ. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা সংক্রান্ত ইলম কোন্ মাধ্যমে হাসিল করেছেন?
সেখানে যাবীদী রাহ. সংক্ষেপে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে, ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী রাহ. এবং ইমাম আবুল হাসান আশআরী রাহ. -আল্লাহর পানাহ- কোনো নতুন আকীদা বা নতুন ফেরকা আবিষ্কার করেননি। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা তো সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের যুগ থেকে চলে আসছে। ইমাম মাতুরীদী ও ইমাম আশআরী সেসব আকীদারই সংকলন ও বিশ্লেষণ করেছেন এবং সেগুলোর প্রতি বাতিলপন্থীদের উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব দিয়েছেন। সেজন্য তাঁদের পরবর্তীদেরকে তাঁদের দিকে সম্বন্ধ করা হয়।
আবু হাসান আশআরী রাহ. ছিলেন ইরাকের বাসিন্দা। তাই চতুর্থ শতাব্দী থেকে ইরাক, শাম ও খোরাসানে আহলুস সুন্নাহ বলতে আশাইরা তথা আশআরী রাহ.-এর অনুসারীদের বোঝানো হয়।
আর আবু মানসুর মাতুরীদী রাহ. ছিলেন হানাফী এবং সমরকন্দের অধিবাসী। সেজন্য ‘মা ওরাআন নাহর’-এ আহলুস সুন্নাহ বলতে মাতুরীদীয়া তথা মাতুরীদী রাহ.-এর অনুসারীদের বোঝানো হয়। (দেখুন, শরহুল আকায়েদের উপর মুস্তফা ইবনে মুহাম্মাদ কাসতালী (৯০১ হি.)-এর হাশিয়া এবং শামসুদ্দীন আহমাদ ইবনে মূসা খয়ালী (৮৭০ হি.)-এর হাশিয়া। আরো দেখুন, ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন, খ. ২ পৃ. ৬)৩
স্মর্তব্য, ইরাক, শাম ও খোরাসানের হানাফী আলেমগণের অধিকাংশ মাতুরীদীই ছিলেন। তবে যেহেতু আশআরী ও মাতুরীদী মাসলাকের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই সেহেতু হানাফীদেরকেও সাধারণত আশআরী বলা হয়; বিশেষত যেসব অঞ্চলে আবুল হাসান আশআরী রাহ.-এর ইলম ও খেদমত অধিক প্রচারিত হয়েছে। কারণ সেখানে তিনিই ছিলেন ‘সুন্নাহ’-এর নিদর্শন। তাই পুরো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতকে তাঁর দিকেই নিসবত করা হত। যেমন হিন্দুস্তানে বেরেলবীদের মোকাবেলায় সকল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারীকে দেওবন্দী বলা হয়, অথচ তাদের অনেকেই দেওবন্দের সাথে যুক্ত নয়।
যাইহোক, ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী রাহ. ও ইমাম আবুল হাসান আশআরী রাহ. এবং তাঁদের অনুসারীগণ যে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত- এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। তা অস্বীকার করেন একমাত্র মু‘তাযিলীগণ এবং ওই সালাফীগণ, যারা মুশাব্বিহার মাসলাক গ্রহণ করেছেন কিংবা তার দিকে ঝুঁকে গেছেন।
উল্লিখিত বাস্তবতাটি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক মুহাক্কিক আলেম স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। এখানে আমরা ইমাম বায়হাকী (৪৫৮ হি.) রাহ.-এর বক্তব্য থেকে সংশ্লিষ্ট অংশটুকু উদ্ধৃত করছি। ইমাম বায়হাকী রাহ.-এর বক্তব্যটি মুহাদ্দিস ইবনে আসাকির দিমাশকী (৪৯৯ হি.-৫৭১ হি.)-এর কিতাব
"تبيين كذب المفتري، فيما نسب إلى الإمام أبي الحسن الأشعري"
(পৃ. ৮৬-৯১, প্রকাশনা : আলমাকতাবাতুল আযহারিয়্যা লিত তুরাস, কায়রো, মিশর)-এ সনদসহ বর্ণিত আছে। সেখান থেকে তাজুদ্দীন সুবকী রাহ. তাঁর কিতাব ‘তবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা’ (খ. ৩, পৃ. ৩৯৫-৩৯৯)-এ ইমাম আশআরী রাহ.-এর জীবনীতে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন।
ইমাম বায়হাকী রাহ. তাঁর এক পত্রে লেখেন-
إِلَى أَن بلغت النّوبَةُ إِلَى شيخنَا (أي إمام جماعتنا) أَبِي الْحسن الْأَشْعَرِيّ رَحمَه الله تعالى، فَلم يُحدِث فِي دين الله حَدَثا، وَلم يَأْتِ فِيهِ ببدعة، بل أَخذ أقاويل الصّحَابَة وَالتّابِعِينَ وَمن بعدهمْ من الْأَئِمّة فِي أصُول الدّين، فنَصَرها بِزِيَادَة شرح وتبيين، وَأَن مَا قَالُوا فِي الْأُصُول وَجَاء بِهِ الشّرْع صَحِيح فِي الْعُقُول، خلاف مَا زعم أهل الْأَهْوَاء من أَن بعضَه لَا يَسْتَقِيم فِي الآراء. فَكَانَ فِي بَيَانه تَقْوِيَة (لدلائل) أهل السنة والجماعة، وَنصرة لأقاويل من مضى من الْأَئِمّة، كَأبي حنيفَة وسُفْيَان الثّوْريّ من أهل الْكُوفَة، وَالْأَوْزَاعِيّ وَغَيره من أهل الشّام، وَمَالك وَالشّافِعِيّ من أهل الْحَرَمَيْنِ، وَمن نحا نَحْوهمَا من الْحجاز، وَغَيرِهَا من سَائِر الْبِلَاد، وكأحمد بْن حَنْبَل وَغَيره من أهل الحَدِيث، وَاللّيْث بن سعد وَغَيره، وَأبي عبد الله مُحَمّد بن إسماعيل البُخَارِيّ، وَأبي الْحسين مُسلم بن الْحجّاج النّيْسَابُورِي، إمامَي أهل الْآثَار وحفاظ السّنَن، الّتِي عَلَيْهَا مدَار الشّرْع رَضِيَ اللهُ عَنْهُم أَجْمَعِينَ.
وَذَلِكَ دأب مَنْ تَصَدّى من الْأَئِمّة فِي هَذِهِ الْأمة، وَصَارَ رَأْسا فِي الْعلم من أهل السّنة فِي قديم الدّهْر وَحَدِيثه...
উচ্চতর স্তরে অধ্যয়নরত তালিবে ইলমগণ ইমাম বায়হাকী রাহ.-এর বক্তব্যের বাকি অংশ ‘তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী’ বা ‘তবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা’ থেকে দেখে নিতে পারেন।
যদি এই বাস্তবতাটি উপলদ্ধি করা যায় তাহলে ওইসকল সালাফী ভাইয়ের বাড়াবাড়ি ও প্রান্তিকতার ব্যাপারে আফসোস না করে উপায় থাকবে না, যারা ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী ও ইমাম আবুল হাসান আশআরীকে -আল্লাহর পানাহ- আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত থেকে খারিজ বলতে কোনো দ্বিধা বোধ করে না!!
সালাফের আকীদা ও সালাফী আকীদা উভয়টা কি এক?
মনে রাখবেন, ‘সালাফের আকীদা’ আর ‘সালাফী আকীদা’ দুটি এক কথা নয়। সালাফের আকীদা তো হুবহু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা। সালাফে সালিহীন (সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন)-এর আকীদারই বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন ইমাম আবু জাফর তহাবী, ইমাম আবু মানসুর মাতুরীদী ও ইমাম আবুল হাসান আশআরীসহ আরো অনেক ইমাম।
আর ‘সালাফী আকীদা’ বলতে যা বোঝানো হয় তাতে সালাফের নামে এমন অনেক কিছু আকায়েদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে, যেগুলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মুতাওয়ারাস আকীদা তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন থেকে যুগ পরম্পরায় চলে আসা আকীদার অন্তর্ভুক্ত নয়। এরপর যে সালাফী ব্যক্তি যত বাড়াবাড়ি করে, আকীদার ক্ষেত্রে তার সংযোজন ও প্রান্তিকতা তত মারাত্মক হয়।
আমাদের যুগে যেসব বন্ধু সালাফী আকীদার প্রবক্তা, তারা যদিও আলআকীদাতুত তহাবিয়্যা-এর কথা খুব বলেন, তবে তারা এই কিতাবের ওইসকল আলোচনা একদমই গ্রহণ করেন না, যেগুলো ইবনুল কায়্যিমের ‘আলকাসীদাতুন নূনিয়্যা’ القصيدة النونية -এর খেলাফ। সেজন্য ‘আলআকীদাতুত তহাবিয়্যা’-এর চাইতে ইবনু আবিল ইয ( ابن أبي العز) -এর ‘শরহুল আকীদাতিত তহাবিয়্যা’ই তাদের কাছে অধিক পছন্দনীয়। কারণ তাতে সালাফের আকীদার সঙ্গে ‘সালাফী আকীদা’রও অনেক কথা যুক্ত করা হয়েছে। ইবনু আবিল ইযের শরাহটি সহজবোধ্য। তাতে অনেক ক্ষেত্রে সালাফের আকীদা বর্ণনার পাশাপাশি হাদীস ও আসার থেকে সেগুলোর দলীলও উল্লেখ করা হয়েছে। মাযার-কবর সংশ্লিষ্ট শিরক ও বিদআত খ-নে তাতে ভালো আলোচনা রয়েছে।
তবে কিছু আকীদার ক্ষেত্রে ইবনু আবিল ইযের ব্যাখ্যায় সালাফের আকীদার চাইতে সালাফী চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্বই হয়েছে বেশি।৪
এখন মাশাআল্লাহ আলআকীদাতুত তহাবিয়্যা-এর বিস্তারিত শরাহ ড. সাঈদ আবদুল লতীফের কলমে প্রকাশিত হয়েছে। এটি-
الشرح الكبير على العقيدة الطحاوية.
-নামে দারুয যাখায়ের বৈরুত থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।