
09/08/2025
শিলপাটার ওজন।
১৯৯৬ সাল।
বিয়ের মাত্র দু’বছর পেরিয়েছে।
একদিন আমার আর আমার স্ত্রী লিজার মধ্যে লেগে গেলো তুমুল ঝগড়া। ঝগড়া শেষে সে ব্যাগ ঘুচিয়ে বিদায় নিলো। শহরেই তাঁদের বাড়ি।বলে গেল জীবনেও ফিরবে না।আমিও বললাম। সমস্যা নাই, নো প্রবলেম।
সমস্যা হলো, বাবা বাড়ি ফেরার পর। তিনি বাড়ি ফিরলে দরজা খুলে লিজা। তিনি পুত্রবধূ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেলে অতি আনন্দিত হয়ে তার হাতে চকলেট, পেয়ারা, আমড়া এসব হাবিজাবি গুঁজে দেন। পুত্রবধূ আরেক কাঠি বাড়া, তিনি আগে থেকেই বেলের শরবত, লেবুর শরবত সব অখাদ্য বানিয়ে রাখেন। মাঝে মাঝে দেখি পুত্রবধূর পার্স বেশ ভারি। বাবা পেনশনের টাকা পেয়েছেন, আর তা কাউকে না বলে গুঁজে দিয়েছেন তার হাতে।
তো, সেদিন লিজা না, দরজা খুললেন মা।
বাবা অবাক! তাঁর নুপুর পায়ে ঝমঝম করা কন্যা গেলো কই?
মা-ই দরোজায় দাঁড়িয়ে সব বললেন। তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছে বাংলা সিনেমার কুখ্যাত এক ভিলেনের জন্ম দিয়ে তিনি অতি দুঃখিত। এ কুপুত্রের মুখ তিনি আর দেখতে চান না।
বাবা একটি কথাও বললেন না, বাড়িতেও ঢুকলেন না। সারা শরীরে ঘাম নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।
ঘন্টা দুয়েক পর দেখি পিতা-কন্যা অতি আনন্দে গলাগলি করে ফিরে এসেছে।
তাঁদের পৌষ মাস, আমার সর্বনাশ! কারণ জানি আজ বাবা ছাড়বেন না। অতি কোমল এ মানুষটির মত ‘কঠিন’ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।
তিনি আমাকে ডাকলেন, কিন্তু একটুও রাগারাগি করলেন না। ঠান্ডা গলায় যা বললেন তা হচ্ছে,
১। তোমার স্ত্রী তোমার সন্তান গর্ভে ধারণ করবেন। একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে তার ওজন হয় প্রায় একটি পাটার ওজনের সমান, যাতে মরিচ বাটা হয়। এখন তোমাকে যদি একটি পাটা পেটে বেঁধে দেয়া হয়, তুমি কতক্ষণ তা বহন করতে পারবে? পনের মিনিটও না। আর তোমার স্ত্রী তা বইবেন দশ মাস দশ দিন। কেবল মেয়েরাই এই কষ্ট সহ্য করেন, পুরুষরা নন। এ ব্যাপারটা মাথায় রাখলে কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে ইচ্ছে হবে না।
২। তুমি তোমার স্ত্রীকে সম্মান না করলে তোমার সন্তানও কোনদিন কোনো মহিলাকে সম্মান করবে না। তোমার ব্যবহারের কারণেই সে বুঝতে পারবে না, মাতৃজাতির সম্মান কত উচ্চ।
৩। মনে রাখবে, মেয়েরা যত ক্ষমতাবানই হন না কেন, বাবার কাছে, স্বামীর কাছে তাঁরা ‘পক্ষীশাবকের’ আদর চান, মায়া চান। এমনকি রানি এলিজাবেথও এর ব্যতিক্রম নন। এ পক্ষীশাবকের সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্য তোমাকেই নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো কপালে যতই ইবাদতের কালো দাগ পড়ুক, মহান আল্লাহতালা তোমাকে রহম করবেন না।
৪। আজ আমি তোমার হয়ে তোমার স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়েছি। কারণ আসলেই তুমি অন্যায় করেছ। তবে এ ক্ষমা চাওয়ায় আমি লজ্জিত নই। পিতা কন্যার কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন। এটা হচ্ছে মমতা থেকে চাওয়া ক্ষমা, কিন্তু ব্যাপারটা তোমার জন্য খুবই লজ্জার বিষয়, কারণ তোমার জন্য তোমার বাবাকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে।পুত্রের আচরণের জন্য পিতার ক্ষমা চাওয়ার চাইতে বড়ো লজ্জা আর কিছু হতে পারেনা।
তারপর বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, শুধু নিজের স্ত্রী নয়, দুনিয়ার সব মেয়ের ক্ষেত্রে যা বললাম সে ব্যাপারগুলো খেয়াল রাখবে, দেখবে পরমকরুণাময় তোমার জীবন ফুলে ফুলে ভরে দেবেন।
আমার মনে হচ্ছে, আমরা সব বাবারা যদি আমাদের সবার পুত্রদের এভাবে বুঝাতাম তাহলে কত মেয়ে বেঁচে যেতো!
(আমার লেখা 'স্বপ্নডানা' বই থেকে নেওয়া। লেখাটি শেয়ার করা যাবে।)
#আসুনমায়াছড়াই