
18/03/2025
সৌন্দর্যের দাসত্ব: লোটাস পায়ের অভিশপ্ত ইতিহাস!
সৌন্দর্যের কত রূপ, কত ব্যাখ্যা! কখনো তা শিল্পের গভীর মুগ্ধতা, কখনো বা নির্দয় শৃঙ্খলের বন্ধন। চীনের ইতিহাসে সৌন্দর্যের এক ভয়ংকর রূপ হয়ে উঠেছিল 'ফুট বাইন্ডিং' নামে একটি প্রথা, যা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য অর্জনের জন্য নয়, বরং সামাজিক অবস্থান, ক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
এই প্রথার সূচনা হয় ১০শ শতকে সং রাজবংশের সময়, যখন সম্রাটের এক প্রিয় নর্তকী তার পায়ের আঙ্গুলগুলো বাঁধিয়ে পদ্ম ফুলের মতো আকৃতির ছোট পা তৈরি করেন এবং তার নাচ সম্রাটের মন জয় করে। এই ঘটনা দেখে রাজপরিবারের নারীরা ফুট বাইন্ডিং শুরু করেন, এবং ধীরে ধীরে প্রত্যেক উচ্চবর্ণের নারীর জন্য বাধ্যতামূলক নিয়মে পরিণত হয়।
ফুট বাইন্ডিংয়ের প্রক্রিয়া অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এবং ধাপে ধাপে পায়ের আকার বিকৃত করা হতো। মেয়েরা যখন ছোট থাকত, তখনই পায়ের আঙুলগুলো পেছনের দিকে মোচড়ানো হতো এবং পায়ের পাতার নিচে চেপে ধরা হতো। এরপর সেগুলো শক্ত করে কাপড়ে বাঁধা হতো, যাতে তারা কখনোই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে না পারে। পায়ের হাড় ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে ফেলা হতো, যাতে তা ছোট ও সরু হয়ে যায়। এটি বারবার করা হতো যতক্ষণ না পায়ের দৈর্ঘ্য মাত্র ৩-৪ ইঞ্চি হয়ে আসত। কয়েক বছর পর পায়ের আকৃতি একটি "লোটাস ফুলের" মতো হয়ে যেত, যা সমাজে কাঙ্ক্ষিত বলে মনে করা হতো।
যদি অভিজাত পরিবারে কোনো মেয়ের ফুট বাইন্ডিং করা না হতো, তবে তার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা কমে যেত। এই নারীরা হাঁটতে গিয়ে শরীর দুলিয়ে রাখতেন, যা নাকি পুরুষদের আকৃষ্ট করত!
ফুট বাইন্ডিং নারীদের জন্য ছিল অসহনীয় কষ্টের প্রতীক। আজীবন ব্যথা ও পঙ্গুত্ব ছিল সাধারণ ব্যাপার। বেশিরভাগ নারী ছোট বয়সেই লাঠির সাহায্যে চলাফেরা করতেন। সংক্রমণের কারণে অনেক নারী পায়ের আঙুল হারাতেন বা পচে যেত।
১৮শ ও ১৯শ শতকে ইউরোপীয়রা যখন চীনে আসতে শুরু করল, তখন তারা এই প্রথার নিষ্ঠুরতা প্রকাশ্যে আনে। চীনের নতুন প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুট বাইন্ডিং নিষিদ্ধ করা হয়। অনেক অভিজাত পরিবার গোপনে এই রীতি চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৪৯ সালে, মাও সেতুং ক্ষমতায় এসে এটিকে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করেন।
আজও চীনে কিছু বৃদ্ধ নারী আছেন, যাদের লোটাস পা রয়েছে। লোটাস পায়ের এই শেষ প্রজন্মের নারীরা এক নিষ্ঠুর অতীতের জীবন্ত স্মারক।
-ইতিহাস ফিসফিস কথা কয়।