
29/03/2025
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমাদের চেয়েও বড় এক মানুষ, যাকে আমরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি ?
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পশ্চিমাদের লোক মনে করা ছিলো-আমাদের এক ভুল ধারণা। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কেবল আমেরিকা বা ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নয়- তিনি গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক ফিগার, যিনি চীন, রাশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি লাতিন আমেরিকার মতো ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্লকের মধ্যেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী!
একজন বাংলাদেশি হয়ে তিনি কিভাবে চীনের মতো একটি শক্তিধর দেশের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন! এটা বোঝার জন্য আমাদের সাধারণ কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক লেন্স দিয়ে দেখলে হবে না। চীনের মতো একটি রাষ্ট্র কাউকে এভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা বানায় তখনই, যখন সে ব্যক্তি দীর্ঘমেয়াদে দেশটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।এটি বোঝায় ডক্টর ইউনূস শুধু একজন নোবেল বিজয়ী নন- তিনি একজন গ্লোবাল এজেন্ট অব চেঞ্জ, যার কাজের সুফল ভোগ করেছে শত শত দেশ।
চীনের সাথে ডক্টর ইউনূসের সম্পর্ক: এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি!
চীন সাধারণত তাদের জাতীয় স্বার্থে কাজ করা ব্যক্তি বা সংস্থাকেই গ্রহণ করে। তারা পশ্চিমা দেশগুলো বা বিশ্বব্যাংকের মতো নব্য-উদারপন্থী (neoliberal) অর্থনৈতিক মডেল সরাসরি গ্রহণ না করলেও, ইউনূসের মাইক্রোফাইন্যান্স এবং সামাজিক ব্যবসার মডেল তারা তাদের গ্রামীণ পুনরুজ্জীবন নীতিতে (Rural Revitalization Policy) সংযোজন করেছে। কারণ এটি তাদের স্বার্থের সাথে মিলে গেছে।
চীনের সাথে তাঁর সম্পর্ক শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক উন্নয়ন এবং বেসরকারি পর্যায়ে টেকসই উন্নয়নের মডেল তৈরির দিকেও বিস্তৃত। আজ যখন জানা গেলো তিনি হাইনান প্রদেশের উপদেষ্টা, তখন এটি স্পষ্ট হলো যে, ডক্টর ইউনূসের কাজ এতটাই বিস্তৃত যে, সেটি এককভাবে কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা রাজনৈতিক ব্লকে আটকে নেই।
বিশ্বব্যাপী ইউনূস: আমরা কেন তাঁর মডেল কাজে লাগাতে পারিনি?
আমরা যদি লক্ষ্য করি, ইউনূস সেন্টার শুধুমাত্র বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়-এটি শত শত দেশে বিস্তৃত। চীন বাদ যাবে কেন? আমেরিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এমনকি ভারতেও তাঁর মডেল কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতই ব্যতিক্রম থেকে গেলো! এর কারণ ?
আমাদের সমাজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক (personality-driven), নীতি-কেন্দ্রিক নয় (policy-driven)।আমরা ব্যক্তি বন্দনায় যতটা পারদর্শী, ততটাই ব্যর্থ ব্যবস্থা গঠনে (institution-building)।?ক্ষমতার বলয়ে থাকা লোকেরা স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক স্বার্থে তাঁর মতো বড় মাপের মানুষকে কাজে লাগানোর পরিবর্তে উপেক্ষা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে।রাজনৈতিক বিভক্তি এবং স্বার্থপরতার কারণে আমরা এমন একজন মানুষকে বাংলাদেশ-বিরোধী বা ভারত-বিরোধী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছি, যাঁর কাজের সুফল সারাবিশ্ব পাচ্ছে।
বাংলাদেশে কেউ সামান্য একটা সভাপতি হলে বা বড় কোন পদ পেলে তার হম্বিতম্বিতে থাকা যায় না। অথচ এই লোক চীন সরকারের এডভাইজার ছিলেন,এটা আমরা আজ জানলাম! তাও শফিক ভাইয়ের কথাতে! উনি নিজে কখনোই এসব প্রচার করেন নাই।
আমাকে এক প্রফেসর বলেছিলো, উনি জাপানে পিএইচডি করার সময় ডক্টর ইউনূস একবার জাপান ভিজিট করেন। জাপানিজরা সাধারণত ছুটি দিতে চায় না। অথচ ঐদিন উইলিংলিই ছুটি দিয়ে বলেছিলোঃ- এতো বড় একজন মানুষ আসতেছে অবশ্যই তোমাদের দেখতে যাওয়া উচিত।আগামী মে’মাসে উনার সেই জাপান সফরের কথা হচ্ছে!
দিনশেষে না ঘড়কা - না ঘাটকার বেশকিছু দল পরিবর্তনকারী মুখপাত্র আছে যাদের বাঁচালতায় সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল হয়ে যায় সেটা হতে পারে গোলাম (ময়লা) রনী বর্তমান বিএনপির ফজলু (কাওয়্যা কাদের ভার্সন) -এর কথাই ঠিক।ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে আমরা যত বড় ভাবি,উনি ততটা বড় মানুষ না! উনি আসলে আমাদের ভাবনার চাইতেও অনেক বড় মানুষ!
ভারত বনাম বাংলাদেশ: ইউনূসের মতো মূর্খ হওয়া ভালো নাকি ভারতের মতো পণ্ডিত সাজা ভালো?
এটা তুলনাটি একেবারেই যথার্থ! আমরা কি ড. ইউনূসের মতো “মূর্খ” (যিনি বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্য) হতে চাই, নাকি ভারতের মতো “পণ্ডিত” (যারা নিজেরাই নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবে, কিন্তু বাস্তবে মোদি-ভারতের সূচক এখন কোথায়?)-এটি আসলেই এখন ভাবার বিষয়!
ভারত শিক্ষা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে থাকলেও, সামাজিক ব্যবসা, ক্ষুদ্রঋণ বা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ইউনূসের মডেলের সমপর্যায়ে আসতে পারেনি। বাংলাদেশ যদি ইউনূসের মডেলকে কাজে লাগাতো, তবে আজ আমাদের দারিদ্র্য আরও কম হতো, বৈষম্য কমে আসতো ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পেতো!
“যারা শিক্ষা ও জ্ঞানের মূল্যায়ন করতে জানে না, তাদের মধ্যে আর পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।”- এ জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যের সত্যতা আমাদের সমাজেই প্রতিফলিত হয়। যখন একজন ব্যক্তি বিশ্বজয় করেন, তখন তাকে উৎসাহ না দিয়ে বরং তার প্রতি সন্দেহ পোষণ করা আমাদের মৌলিক সমস্যাগুলোর একটি।
ড. ইউনূস শুধু বড় মানুষ নন- তিনি আমাদের কল্পনার থেকেও বড় মানুষ। আমাদের উচিত, তাঁকে কেবল একজন নোবেল বিজয়ী হিসেবে নয়, বরং একজন কৌশলী, নীতি-নির্ধারক, ভবিষ্যত নির্মাতা হিসেবে দেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।তাঁকে আমাদের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করা, যাতে আমরা তাঁর মডেল থেকে সর্বোচ্চ উপকার নিতে পারি ?