06/11/2025
-" তোর সাথে বিয়ে দিয়েছি বলে তুই এভাবে মেয়েটাকে মারবি রুদ্র?
আয়শা বেগমের কথায় রাগ ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে। নেহাতই ছেলে বড় হয়েছে নাহলে এমন অমানুষের মতো অত্যাচার করার জন্য আয়শা অবশ্যই ছোলের গায়ে হাত তুলতেন। কালকোই রুদ্র দেশে ফিরেছে দীর্ঘ ৯ বছর পর। আর এসেই নিজের বিবাহিত বউয়ের গায়ে হাত তুলেছে।
কারণটা কেউই জানে নাহ। সকাল বেলা আয়শা রুদ্রর ঘরে গিয়ে দেখে মেঝেতে নাতাশা পড়ে আছে অচেতন অবস্থায়। কপাল কেটে রক্ত বেড়িয়ে তা আমার শুকিয়েও গেছে। আয়শা বেগম ততক্ষণাৎ ডক্টর ডেকে নাতাশার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।
জ্ঞান ফিরলেও কিছু বলার অবস্থায় নেই নাতাশা। পুরো শরীল ব্যথায় জর্জরিত। ঠোঁট নাড়াতেও কষ্ট খুব। নাতাশার পাশেই ওর মাথায় হাত রেখে ছেলের উপর রাগ ঝাড়ছেন আয়শা বেগম। তবে রুদ্রর কোনো হেলদোল নেই। ঘরে পাতানো দুই সিটের সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে রুদ্র।
রুদ্রর বাবা মানিক আহমেদ ছেলের এমন বেপরোয়া স্বভাব দেখে নিজেও প্রচন্ড রেগে যান। রুদ্রর সামনে এসে দাড়িয়ে বলে,
-" সমস্যা কি তোমার? বিদেশে গিয়ে কি ভদ্রতা সভয়তা সব ভুলে গেছো নাকি?
-" একটুও না।
-" তাহলে তুমি নাতাশার গায়ে হাত তুলেছো কোন সাহসে?
-" প্রশ্নটা ঘুরিয়ে আমিও করতে পারি বাবা। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তোমরা ওকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলে কোন সাহসে? জবাব আছে তোমাদের কাছে?
-" নাতাশা তোমাকে ভালোবাসে। ছোট থেকে একসঙ্গেই বড় হয়েছো তোমরা। তুমি নিজেও নাতাশে অনেক পছন্দ করতে তাহলে বিয়ে দেওয়ায় এতো আহামরি কিছু হয়ে যাইনি রুদ্র। এছাড়াও তোমার খালা- খালুর মৃত্যুর আগে তাদের শেষ ইচ্ছে ছিলো তোমার সঙ্গে নাতাশার বিয়ে দেওয়া।
-" পছন্দ করতাম বোন হিসেবে, আমার খালার মেয়ে হিসেবে। বউ হিসেবে না বাবা। তুমি বউ আর বোনের মধ্যে তো গুলিয়ে ফেললে হবে নাহ। আর খালা খালুর শেষ ইচ্ছে পুরন করার চক্করে আমি তো আমার জীবন, কেরিয়ার ধ্বংস করতে পারি না তাই না।
আয়শা বেগম এবার প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললেন, " রুদ্র মুখ সামলে কথা বলো। নাতাশার জন্য তোমার কি কেরিয়ার শেষ হয়েছে? ও তোমাকে কবে কোনোকিছুর জন্য চাপ দিয়েছে বলতে পারবে? তুমি কারো কোনো কথা না শুনে ওকে রেখেই চলে গিয়েছিলে। আর আজ আসলে ৯ বছর পর। নাতাশার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এসব মেনে নিতো? আবার বলছো ও তোমার জীবন শেষ করেছে।
রদ্র বিরক্তিকর ভাব নিয়ে বললো, " ওই মেয়ে নিজেই তো এক আস্ত বড় চাপ। আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছো এর থেকে বড় চাপ আর কি আছে?
আয়শা পেরে উঠছেন না ছেলের সঙ্গে। নাতাশা কিছু বলতে না পারলেও শুনেছে সবকিছুই। বন্ধ চোখের কণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আয়শা একনজর করুন দৃষ্টিতে তাকায় নাতাশার দিকে। মেয়েটা বড্ড ভালোবাসে রুদ্রকে৷ কিন্তু রুদ্র বোঝারই চেষ্টা করে নাহ।
মানিক আহমেদ রাগ করেই বের হয়ে যান রুম থেকে। রুদ্র সোফা থেকে উঠে দাড়ায়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-" ওকে নিয়ে যাও আমার রুম থেকে। এখানে থাকলে রাগের মাথায় ওকে না মেরেই ফেলি আমি।
আয়শা বেগম একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের দিকে তাকিয়ে। নাতাশা এবার নিজ থেকেই উঠে বসলো, বিদ্ধস্ত চেহারায় অস্ফুট কন্ঠে আয়শাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-" মামনি একটু ধরবে আমাকে? "
আয়শা ধরলো নাতাশার দুবাহু। ব্যথায় কুঁকড়ে গেলো নাতাশা। আয়শা বেগম বুঝতে পেরে আরো আলতো করে ধরলো। নাতাশাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই রদ্র দরজা লাগিয়ে দিলো।
__
আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা আজ। নাতাশার মনের অবস্থার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ হলো বোধহয়। নাতাশা দাঁড়িয়ে আছে ছাঁদের রেলিং ঘেষে। নিস্তব্ধ পরিবেশে থেকে থেকেই বৃহৎ গর্জনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হয়তো আজ বৃষ্টি নামবে..
এমন সময় রুদ্রও ফোনের কারো সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসলো ছাঁদে। নাতাশা আনমনে হয়ে থাকায় খেয়াল করলো না রুদ্রকে। তবে রুদ্র দেখেছে, নাতাশার উপস্থিতিতে মনের ক্ষোভটা আবারো মাথা চারা দিয়ে উঠলো। কল কেটে দিয়ে নাতাশার পাশে এসে দাঁড়ালো।
-" মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। ঝাপ দে তো নাতাশা, বৃষ্টির পানির সঙ্গে সঙ্গে আজ তুইও ধুয়েমুছে চলে যাক আমার জীবন থেকে।
নাতাশা মলিন হাসলো " রুদ্র আমার উপর এতো ক্ষোভ কেনো তোমার?
-" ক্ষোভ তে নয়।
-" তাহলে কি? একেবারেই মেরে ফেলতে চাও কেনো আমাকে?
-" তু্ই তো আমার জীবনের একটা সমস্যা নাতাশা। মানুষ তার সমস্যা যেকোনো উপায়ে যে কোনো পদ্ধতিতে সমাধান করতে চায়, আমিও চাই। তোর জন্য আমার পুরো জীবনটাই নষ্ট। হয় মরে যা নাহলে আমাকে ছেড়ে দে।
নাতাশা শীতল দৃষ্টিতে তাকালো রুদ্রর দিকে। ছেলেটার চোখে মুখে তার জন্য প্রচন্ড ঘিন্না, রাগ। কিন্তু কেনো?.. নাতাশা স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-" আমি তো ভালোবাসি তোমাকে, কিভাবে ছেড়ে দিবো?
-" তাহলে মরে যা। তোরও মুক্তি আমারো মুক্তি!
-" একদিন থাকবো না সত্যি সত্যিই, সেদিন বড় আফসোস করবা তুমি আমার জন্য।
বলেই নাতাশা ধীর পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে আসে। কষ্ট হচ্ছে খুব, রুদ্র তাকে কোনোদিন বুঝলো না। সেই ছোট কালেও বোঝেনি আর এখন বুঝেও বুঝতে চাচ্ছে না।
__
রুদ্র সারারাত বাইরে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পার্টি করে বাড়ি ফিরলো সকাল বেলা। রুদ্রকে দেখেই তন্নি এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে। রুদ্রর ছোট বোন তন্নি, কলেজের পিকনিকে যাওয়ায় আসার পর দেখা হয়নি রুদ্রর সঙ্গে । রুদ্র একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলো..
-" কেমন আছিস তুই?
-" আমি ভালো আছি ভাইয়া তুমি কেমন আছো? কতো বছর পর দেখা হলো।
-" হুম,, ভালোই বড় হয়ে গেছিস দেখি।
-" হু তা তো হবোই, ভাইয়া নাতাশা আপুর সাথে দেখা করেছো?
রুদ্রর মুখ থেকে হাসি নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। থমথমে কণ্ঠে বললো,
-" ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য অবশ্যই দেশে আসিনি আমি। আমার সামনে আর ওর নাম নিবি না..
তন্নির মুখ চুপসে গেলো। রান্নাঘর থেকে সব কথাই শুনতে পেলো আয়শা আর নাতাশা। মেয়েটার মন এমনিতেই খাটাপ তারউপর এসব শুনে মুখটা আরো কালো হয়ে যায় নাতাশার।
রুদ্র আদুরেভাবে তন্নির দুগাল চেপে বললো,
-" তোর জন্য অনেক কিছু আছে চল সেগুলো দেখবি চল।
তন্নি রান্নাঘরের দিকে তাকাতেই নাতাশার কালো মুখ খানা দেখতে পেলো। খারাপ লাগলো ওর,, এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ জানে নাতাশা কতোটা ভালোবাসে রুদ্রকে, একমাত্র রুদ্রই সেই ভালোবাসার কদর করে নাহ।
____
মানিক আহমেদের কনট্রাকশন সাইডের বিজনেস আছে। সুবিশাল কোম্পানির মালিক সে, যার একটি প্রধান শাখা ঢাকায় আরেকটি চট্টগ্রামে। রুদ্র কোম্পানির বিষয়ে কোনোকিছুই জানে না তেমন,। মানিক আহমেদ যেহপতু নাতাশাকে খুব ভালোবাসেন তাই প্রধান শাখার সমস্ত দায়িত্ব তিনি নাতাশাকে দিয়েছেন,
রুদ্র যেমন ছেলে আর ওর যে রগচটা ব্যবহার তাতে ওর হাতে কোম্পানির দায়িত্ব তুলে দিলে বেশিদিন লাগবে না মানিক আহমেদের অধপতন হতে।
নাতাশার শরীল খারাপ থাকায় ক'দিন অফিসে যাওয়া হচ্ছে না তার। রুদ্রও এখনো এ বিষয়ে কিছুই জানে না। মানিক আহমেদ তাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেন নি।
সন্ধ্যা নাগাদ নাতাশার পি.এ মারুফ আসে বাড়িতে।
হলরুমের সোফায় বসেই তার সঙ্গে কথা বলছিলো নাতাশা৷ পাশে মানিক আহমেদও বসে আছেন, সামনের সেন্টার টেবিলের উপর কিছু ফাইলপত্র রেখে সেসব উল্টে পাল্টে দেখছিলো।
মারুফ কথা বলার এক পর্যায়ে জানায়, " ম্যাম আপনাকে দুদিনের জন্য দিনাজপুর যেতে হবে।
-" কেনো? কেনো সমস্যা হয়েছে? "
-" তেমন কিছু না ম্যাম, তবে কনস্ট্রাকশন সাইডে কিছু ত্রুটি দেখা গিয়েছে সেই বিষয়ে হামজা সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা একটু কথা বলতে চান। "
নাতাশার উত্তর দেওয়ার আগেই মানিক আহমেদ বললেন, " ওকে ছেড়ে দাও ওর শরীল ভালো না। এখন জার্নি করতে পারবে না, তুমি হামজাকে বলে দিও নাতাশার বদলে আমি যাবো কথা বলতে। "
মানিক আহমেদের কথা নাতাশা মানা করলো, -" সমস্যা হবে না ছোট আব্বু আমি যেতে পারবো। আর ওই সাইড যেহেতু আমি-ই হ্যান্ডেল করছি তাই আমারই যাওয়া উচিত । মারুফ কবে যেতে হবে?
-" ম্যাম আপনি তাহলে পরশুদিনই রওনা দিন। বিষয়টা দ্রুত সমাধান করা দরকার নাহলে কাজ এগোচ্ছে না।
-" আচ্ছা সবকিছু ঠিক ঠাক রেখো আমরা পরশু সকালেই রওনা হবো।
মারুফ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো। কিছুক্ষণ বসে নাস্তা করলো অতঃপর মারুফ চলে যায়। সিঁড়ির উপর দাড়িয়ে এতোক্ষণ সব কথাই শুনছিলো রুদ্র। প্রধান শাখার CEO কিনা নাতাশা? বিষয়টা মেনেই নিতে পারছে না রুদ্র।
নাতাশা ফাইলগুলো নিয়ে উঠে দাড়িয়ে পেছনে ফিরতেই রুদ্রকে দেখলো।
-" তুমি এখানে?
রুদ্র নেমে এসে দাড়ালো নাতাশার সামনে। চোয়াল শক্ত করে বললো, " ভালোই হাত করেছিস বাবাকে। একদম কোম্পানির CEO হয়ে গেলি বাহহ ; বাহহহ। তোকে কি বলে বাহবা দেওয়া যায় বল তো। "
মানিক আহমেদ তেতে উঠলেন সোফায় বসা অবস্থাতেই,
-" মুখ সামলে কথা বলো রুদ্র। এবার কিন্তু আমি ভুলে যাবো তুমি আমার ছেলে।
রুদ্র সহসা উত্তর দিলো, " আপনি আদেও মনে রেখেছেন যে আমি আপনার ছেলে?
চলবে কি..?
#অবেলায়_তোমার_দেখা
#লেখায়_তাসফিয়া_তাসনিম
#সূচনা_পর্ব