
07/29/2025
পতিত সমাজ
ত্রিপিটক বিশোধক কমিটির আহ্বায়ক
অগ্রমহাপণ্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির
-----------------------------------------------------
বাংলাভাষী বৌদ্ধ সমাজের পতনের আশঙ্কা অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন মহামনীষীরা । আর তাই তাঁরা তাদের লেখায় এই পতন রোধে আশু করণীয় অনেক বিষয় তুলে ধরেছিলেন ভিক্ষু, সুশিক্ষিত যুবসঙ্ঘ এবং সমাজ নায়কদের প্রতি। কিন্তু না আমরা সেই বিষয়ে নজর দেই নাই কিংবা তাদের কথাকে খুব বেশী গুরুত্ব দেই নাই। তাই আমাদের সমাজও পতনের দিকে। যেখানে ধর্মান্তরকে একটা সংকেত বলা যেতে পারে। আজ হতে সত্তর বছরেরও অধিক আগে বৌদ্ধ মিশন প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা অগ্রমহাপন্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির তার পতিত সমাজ লেখায় যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা সংগ্রহ করে তুলে ধরা হলো।
যেই সমাজ পতিত, সেই সমাজ নিশ্চয় অন্তঃসার শূন্য। এই অবনতির মূলকারণ একমাত্র সমাজ সংস্কারক দূরদর্শী, সুক্ষদর্শী লোকেরাই দেখিতে পায়। কিন্তু যাহারা আত্ম প্রসাদ লাভে সন্তুষ্ট, স্বার্থপর, তাহারা ইহার মূলকারণ নির্ণয়ে সম্পূর্ণ অসমর্থ। একটি সমাজ নিয়ন্ত্রিত ও উন্নত করিতে হইলে অভাব অভিযোগ বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখিতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ লোকেই নীরব, নিশ্চেষ্ট, চেতনাহীন ও রুচী বিকার অন্যরুপ। তাই আজ কতেক অপ্রিয় সত্য বলিতে বাধ্য হইতেছি। ভগবান বুদ্ধও বলিয়াছেন- যাহারা উপদেশ দেয়, অনুশাসন করে ও বর্বরতা নিবারণে যত্নপর, তাহারা সজ্জনের প্রিয় হয় বটে, কিন্তু অসাধুর প্রিয় হইতে পারে না।
সাধারণত দেখা যায় যাহারা খাঁটি কথা বলে, লোকের দোষ কথা খোলাসা করিয়া বলে, তোষামোদকে অন্তরের সহিত ঘৃণা করে, তাহারা প্রথমে জন সমাজে স্থান পায় না। যদি কেহ ধীরব্যক্তি সত্যের অপলাপ না করিয়া আপন কর্তব্য সাধনে অচল অটল থাকে, তাহা হইলে অবিশ্বাসবাদীরা নিশ্চয়ই পরাজিত হইয়া থাকে।
বর্তমান যুগে ভারতময় তথা পৃথিবীময় যে আন্দোলন চলিতেছে ইহাতে প্রত্যেক জাতির মধ্যে একটা সংঘাত পৌছিয়াছে। এই সংঘাতের ফলে প্রত্যেকের মধ্যে এমন একটি কর্মশক্তি জাগ্রত হইয়াছে যাহার প্রভাবে মৃত্যুবরণ একটি সামান্য ব্যাপারে পরিগণিত হইয়াছে। ইহা অপেক্ষা উন্নত চিন্তা আর কি হইতে পারে। কর্ম্মময় জীবনের যে সুলক্ষণ আজ ভারতময় ব্যাপ্ত হইয়াছে, তাহা একমাত্র প্রচারকের কৃতিত্ববলেই বলিতে হইবে।
বাস্তবিক পক্ষে চিন্তা করিলে গেলে- যাহারা হাসি মুখে দুঃখকে বরণ করিয়া লইতে সমর্থ, তাহারাই পরার্থ সাধন করিয়া মানব জীবন সার্থক করিতে পারে। যাহারা আনন্দে উৎফুল্ল, দুঃখে কাতর, তাহারা ধর্মের সমাজের উপকার করিয়া কৃতার্থ হইতে পারে না।
এই পৃথিবীর সমস্যার দিনে চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজের দিকে দৃকপাত করিলে দেখা যায়, এখনও যেন মোহঘুমের ঘোর কেহই কা্টাইতে পারে নাই। ভারতময় উপকারের কথা দূরে থাকুক, একটা বৌদ্ধ জাতির উপকার করিতে সমর্থ তেমন কর্মীর বিশেষ অভাব পরিলক্ষিত হইতেছে। এখন কথা হইল জাগাইবে কে? জাগাইবে প্রথমতঃ ভিক্ষু, তারপর সমাজ নায়ক ও সুশিক্ষিত যুবসঙ্ঘ।
বিহারে বিহারে প্রাথমিক শিক্ষাঃ
শিশুগণ সর্বদাই জাগ্রত। বিশেষত যত প্রকারের সুযোগ সুবিধা অন্যান্য সমাজের ধর্মগুরু অপেক্ষা ভিক্ষুদের যথেষ্ট আছে। তবে ভিক্ষুদিগকে কতকগুলি বিষয়ের প্রতি নজর রাখিতে হইবে।
১) বিহার স্কুল প্রতিষ্ঠা করিয়া গ্রামবাসী ছেলেদিগকে শিক্ষা দিতে হইবে। ছেলেদের শিক্ষার পরিহানি হয় মত এমন দূর দেশের নিমন্ত্রণে তিনি যাইবেন না। যদি তাহার পরিবর্তে অন্য কেহ শিক্ষা দিতে পারেন, তাহা হইলে যাইতে বাধা নাই।
২) ভিক্ষু অ্ধ্যাপক ধার্মিক হইবেন, উদারতায় তাহার হৃদয় পূর্ণ থাকিবে। যাহা দান দক্ষিণা পাইবেন, সমস্তবিহার স্কুলের উন্নতি কল্পে তিনি ব্যয় করিবেন।
৩) শিক্ষার্থীদিগকে পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে ধর্ম শিক্ষা দিবেন, আহারে, ব্যবহারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায়, কায়িক শ্রমে ছাত্রদিগকে গঠন করিবেন।
৪) প্রত্যেক বিহার স্কুলে একটি করিয়া পুস্তকালয় থাকিবে, এই পুস্তকালয়ে ছেলেদের উপযোগী মাসিক সাপ্তাহিক পত্রিকা, ধর্মগ্রন্থ ও বিবিধ সুপাঠ্য পুস্তক থাকিবে। কোন অশ্লীল উপন্যাস থাকিবেনা।
৫) স্কুল খানি খুব পরিষ্কার রাখিতে হইবে, ধর্ম সম্বন্ধীয় ছবি, ভিক্ষুদের ছবি, মহাপুরুষের ও কবিগণের ছবি স্কুলে টাঙ্গাইয়া রাখিতে হইবে। এই আদর্শে ছাত্রদের নৈতিক চরিত্র গঠিত হিইবে। দেশে যত যুবক আছে, প্রত্যেক রবিবারে বিহার পুস্তকালয়ে আসিয়া গ্রন্থ ও পত্রিকাদি পাঠ করিবে।
৬) প্রত্যেক অমাবস্যা পূর্ণিমায় গ্রামবাসী দায়ক-দায়িকাদিগকে ডাকাইয়া, ধর্মনীতি, অর্থ-নীতি, কৃষি নীতি, স্বাস্থ্য নীতি, শিশু পোষন নীতি ও গ্রামের অভাব অভিযোগ পরিপূর্ণ মানসে বিবিধ শিক্ষা এবং উপদেশ দিতে হইবে।
৭) বাড়িতে হউক বিহারে হউক প্রত্যেকে যাহাতে দুই বেলা উপাসনা করে, তৎপ্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে।
এই সাতটি বিষয়ের প্রতি ভিক্ষুর এবং সুশিক্ষিত যুবসঙ্ঘের ও সমাজ নায়কের বিশেষ দৃষ্টি থাকিবে।
(সংগৃহীত)