12/11/2025
১৯৭২ সালের ভারত-বাংলাদেশ গোপন চুক্তির অভিযোগ: বিস্তারিত তথ্য ও প্রমাণের অনুসন্ধান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিকে কেন্দ্র করে ‘গোপন চুক্তি’ বা ‘গোপন প্রতিরক্ষা চুক্তি’র অভিযোগ একটি দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের বিষয়। এই অভিযোগ অনুসারে, শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে একটি ২৫ বছরের গোপন চুক্তি হয়েছিল যাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সামরিক ঘাঁটি এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। নীচে এই অভিযোগের ভিত্তি, দাবিকারীদের যুক্তি, প্রকাশ্য চুক্তির বিবরণ এবং প্রমাণের অভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। তথ্যসূত্রগুলো ঐতিহাসিক দলিল, বই এবং সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে সংগৃহীত।
১. অভিযোগের মূল ভিত্তি: কী বলা হয় গোপন চুক্তির বিষয়ে?
- **সময়কাল ও স্থান**: ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে, ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধীর সফরের সময় (১৭-১৯ মার্চ) এই গোপন চুক্তি সই হয় বলে দাবি করা হয়। এটি প্রকাশ্য ১৯ মার্চের ‘মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি’র (Indira-Mujib Treaty) সাথে যুক্ত।
- **প্রধান শর্তসমূহ (দাবি অনুসারে)**:
- বাংলাদেশ ভারতের প্রতিরক্ষা ছত্রের অধীনে চলে যাবে; যেকোনো আক্রমণে ভারতের সাথে যৌথ প্রতিরক্ষা।
- চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতের সামরিক ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত।
- বাংলাদেশে ৭টি ভারতীয় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন।
- অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: ভারতের অর্থনৈতিক সাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের সম্পদের উপর ভারতীয় প্রভাব।
- মেয়াদ: ২৫ বছর, যা ১৯৯৭ সালে শেষ হয়।
- **দাবিকারী**: প্রধানত প্রাক্তন ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) বি.কে. ওবরয় (B.K. Oberoi) তাঁর সাক্ষাৎকার ও লেখায় এই দাবি করেন। তিনি বলেন, এটি একটি ‘গোপন প্রতিরক্ষা চুক্তি’ যা প্রকাশ্য চুক্তির চেয়ে কঠোর। অন্যান্য উৎস: সুব্রত রায় চৌধুরী (প্রাক্তন RAW এজেন্ট) এবং কিছু বাংলাদেশী রাজনৈতিক গোষ্ঠী (যেমন: জিয়া-এরশাদ আমলের প্রোপাগান্ডা)।
২. প্রকাশ্য চুক্তির বিবরণ: গোপন চুক্তির ‘প্রকাশ্য সংস্করণ’?
১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ সই হওয়া ‘India–Bangladesh Treaty of Friendship, Cooperation and Peace’ একটি ২৫ বছরের চুক্তি। এটি ১২টি অনুচ্ছেদ নিয়ে গঠিত এবং প্রকাশ্যভাবে উপলব্ধ।
প্রধান ধারাগুলো:
- **অনুচ্ছেদ ১**: পারস্পরিক শান্তি, সার্বভৌমত্ব ও অ-হস্তক্ষেপের প্রতিশ্রুতি।
- **অনুচ্ছেদ ৮**: যদি কোনো পক্ষ আক্রান্ত হয়, তাহলে পরামর্শের মাধ্যমে সহযোগিতা (সরাসরি সামরিক সহায়তা নয়)।
- **অনুচ্ছেদ ৯**: কোনো পক্ষ অন্যের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক জোটে যোগ দেবে না বা তার ভূমি ব্যবহার করতে দেবে না।
- **অনুচ্ছেদ ১০**: ২৫ বছরের মেয়াদ, পরে পুনর্নবীকরণ সম্ভব।
- **অন্যান্য**: অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা।
এই চুক্তি ভারত-সোভিয়েত চুক্তির (১৯৭১) মতো, কিন্তু সামরিকভাবে কম কঠোর। এটি ১৯৯৭ সালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেষ হয় এবং কোনো পক্ষই পুনর্নবীকরণ চায়নি।
৩. প্রমাণের অনুসন্ধান: কী আছে, কী নেই?
- **দলিলগত প্রমাণের অভাব**: কোনো লিখিত কপি বা অফিসিয়াল দলিল এখনও প্রকাশিত হয়নি। বি.কে. ওবরয়ের দাবি মূলত মৌখিক বা স্মৃতিকথা-ভিত্তিক, কোনো নথি সংযুক্ত নয়। গবেষণায় দেখা যায়, এটি ‘প্রোপাগান্ডা’ হিসেবে শুরু হয়েছে ১৯৭৫-এর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়।
উদাহরণ: ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর অভ্যুত্থানের পর কূটনীতিবিদরা ‘গোপন চুক্তি’ খুঁজতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সার্চ করে, কিন্তু কিছু পায়নি।
- **প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা**: কোনো ভারতীয় বা বাংলাদেশী কর্মকর্তা (যেমন: কামাল হোসেন, তাজউদ্দীন আহমদের সচিব) এই গোপন চুক্তির উল্লেখ করেননি। বরং, চুক্তিটি ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষার’ জন্য বলা হয়।
- **ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট**: ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার (মার্চ ১৯৭২) এবং শরণার্থী ফেরতের জন্য এই চুক্তি হয়। নিউইয়র্ক টাইমস (১৯৭২) রিপোর্ট করে, এটি ‘পারস্পরিক প্রতিরক্ষা পরামর্শ’-ভিত্তিক।
কোনো গোপনতার ইঙ্গিত নেই।
- **সাম্প্রতিক গবেষণা**: ORF (Observer Research Foundation) এবং Dhaka Tribune-এর লেখায় বলা হয়, গোপন চুক্তির অভিযোগ ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বা ‘রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা’।
X (টুইটার) সার্চেও কোনো নতুন প্রমাণ পাওয়া যায়নি; শুধু বিতর্কিত পোস্ট।
৪. বিতর্কের দুই পক্ষ: যুক্তি ও প্রতিযুক্তি
| **পক্ষ** | **যুক্তি** | **প্রমাণ/উদাহরণ** |
| **গোপন চুক্তি আছে (অভিযোগকারী)** | প্রকাশ্য চুক্তি গোপনটির ‘কভার’। ফারাক্কা বাঁধ, তিন বিঘা করিডোরের মতো ঘটনা এর ফল। মুজিবের ‘ভারতপন্থী’ নীতি দেশবিক্রির প্রমাণ। | বি.কে. ওবরয়ের সাক্ষাৎকার; ১৯৭৫-এর পরবর্তী রাজনৈতিক অভিযান।
| **গোপন চুক্তি নেই (প্রতিযুক্তি)** | চুক্তি সম্পূর্ণ প্রকাশ্য; কোনো গোপন ধারা নেই। অভিযোগ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা (জিয়া-এরশাদ আমল)। মুজিব পরে চীন-আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়িয়েছিলেন। | কামাল হোসেনের বই; চুক্তির অ-পুনর্নবীকরণ (১৯৯৭)।
৫. পরিণতি ও বর্তমান প্রভাব
- **পরবর্তী ঘটনা**: চুক্তির কারণে ভারতীয় সেনা দ্রুত প্রত্যাহার হয় (মার্চ ১৯৭২), কিন্তু ফারাক্কা (১৯৭৫) ও সীমান্ত বিতর্ক চুক্তির ‘অসমতা’র অভিযোগ বাড়ায়। ১৯৭৫-এর অভ্যুত্থানের পর এটি ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ প্রতীক হয়।
- **আজকের প্রেক্ষাপট**: ২০২৫ সালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এই অভিযোগ এখনও ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক বিতর্কে। কিন্তু কোনো নতুন প্রমাণ উঠেনি। গবেষকরা বলেন, এটি ‘ঐতিহাসিক মিথ’ যা সত্যতা যাচাইয়ের অভাবে টিকে আছে।
🇧🇩
Mortuza Hasan