11/27/2025
“কোচিং ব্যবসা, রাজনৈতিক দূষণ ও প্রশ্নফাঁস: বাংলাদেশের শিক্ষা সংকট”
বাংলাদেশ উন্নতি চাইলে শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধকরণ, রাজনৈতিক দূষণ রোধ, এবং প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্যের নির্মূল—এই সমস্ত বিষয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। একটি দেশের উন্নতি নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থার মানের ওপর। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য মূল দায়িত্ব শিক্ষকদের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে শিক্ষক সমাজের অনেক অংশ আজ দায়িত্বহীন, রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, প্রাইভেট ব্যবসা এবং কোচিংয়ের প্রতি আসক্ত। শিক্ষা এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে শিক্ষকরা জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু যখন শিক্ষকরা দায়িত্বহীন হন, তখন তারা জাতির প্রতি এককালে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।
শিক্ষক সমাজের দায়িত্বহীনতার কারণে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মৌলিক শিক্ষাগত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। তারা শুধু পরীক্ষার জন্য পড়ছে, শেখার জন্য নয়। পাঠ্যবই, নোট, তথ্যপ্রযুক্তি—সবকিছু আছে, কিন্তু শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য হারিয়েছে তার মানে। শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি, বিশ্লেষণধারা, সৃজনশীলতা—এসব ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে। কারণ শিক্ষকরা ক্লাসে মনোযোগী নয়, তারা ব্যস্ত প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং ব্যবসা, রাজনৈতিক পদপ্রাপ্তি, এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে। এই দায়িত্বহীনতা শিক্ষার্থীর ক্ষতি করছে, সমাজের নৈতিক মান হ্রাস করছে, এবং পুরো জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধ হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস। এটি শুধু একটি শিক্ষা সমস্যা নয়; এটি সামাজিক ও নৈতিক বিপর্যয়। শিক্ষার্থীরা যখন পরীক্ষার আগের রাতে মোবাইল স্ক্রিনে লিক হওয়া প্রশ্নপত্রের উপর নির্ভর করে, তখন সেখানে শিক্ষা থাকে না, থাকে শুধুই প্রতারণা। যারা এই অপরাধে জড়িত—শিক্ষক, প্রশাসক, প্রভাবশালী ব্যক্তি—তারা জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। প্রশ্নফাঁস শুধু শিক্ষার্থীর নয়, রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও ধ্বংস করে।
দূরদর্শী রাষ্ট্রগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাংলাদেশে এখনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। সাময়িক বরখাস্ত, সামান্য জরিমানা—এসব কিছুই যথেষ্ট নয়। এর ফলে শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রতারণা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। এই সংস্কৃতি একদিন সমাজের সব স্তরেই প্রবেশ করবে। তাই জবাবদিহিতা ছাড়া শিক্ষার উন্নতি অসম্ভব।
শিক্ষকদের রাজনীতি ও দলাদলি থেকে মুক্ত রাখা অপরিহার্য। শিক্ষক যদি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন, তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে না। শিক্ষার্থীর নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ শেখানো অপ্রতিষ্ঠিত হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দলীয় ভাগাভাগার কেন্দ্র হয়ে ওঠে, শিক্ষকরা বিরোধের বলি হয়, শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়, শিক্ষার পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়। শিক্ষকরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের খেলোয়াড় হয়ে গেলে শিক্ষার চেতনা হারিয়ে যায়। তাই রাষ্ট্রের উচিত কঠোরভাবে ঘোষণা করা—অবসরের আগে কোনো শিক্ষক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারবেন না। শিক্ষকতা হবে দায়িত্ব, দলীয় প্ল্যাটফর্ম নয়।
প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং ব্যবসা শিক্ষক সমাজের আরেকটি গভীর সমস্যা। শিক্ষকরা যদি প্রাইভেট পড়ান, তারা আর শিক্ষক থাকে না; তারা ব্যবসায়ী হয়ে যায়। ক্লাসরুমের শিক্ষা তাদের কাছে দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয় প্রাইভেট বা কোচিংয়ে অংশ নিতে। এতে শিক্ষার মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়। যে ছাত্র প্রাইভেট পড়তে সক্ষম, সে এগিয়ে যায়; আর যে পারে না, সে পিছিয়ে পড়ে। এটি শিক্ষার নৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে।
কোচিং বাণিজ্য শিক্ষার জন্য ক্ষতিকর এবং শিক্ষকের নৈতিকতা নষ্ট করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার বাইরে চলে যায় এবং শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ বাড়ে। তাই প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং ব্যবসা নিষিদ্ধ করা অপরিহার্য। রাষ্ট্র যদি শিক্ষার মান উন্নয়ন চায়, তবে বিকল্প আয় ব্যবস্থা রাখতে হবে—গবেষণা, পাঠ্যপুস্তক লেখা, প্রশিক্ষণ সেশন।
শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে একটি স্বচ্ছ ও কার্যকর মূল্যায়ন ব্যবস্থা। শিক্ষকের ক্লাসের মান, উপস্থিতি, শিক্ষার্থীর ফলাফল, নৈতিক আচরণ, পেশাগত উন্নয়ন—সবকিছু নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। শিক্ষকতা একটি সৎ, দায়বদ্ধ এবং নিয়মিত মূল্যায়নযোগ্য পেশা হওয়া উচিত। যারা দায়িত্বহীন বা অনৈতিক, তাদের শিক্ষকের পেশা থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থার বড় সমস্যা হলো অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ। বহু শিক্ষক দলীয় প্রভাব, ঘুষ বা সুপারিশের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। তারা শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিক্ষক হতে হলে শুধু ডিগ্রি যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন নিষ্ঠা, দায়বদ্ধতা, মানবিকতা এবং চিন্তার গভীরতা। শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে Teacher Recruitment Commission গঠন করা উচিত।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে, যখন শিক্ষকরা স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল, অরাজনৈতিক এবং শিক্ষার্থীর মেধা ও নৈতিকতার দিকে মনোযোগী হবেন। শিক্ষক সমাজকে পুনর্গঠন, দায়িত্ববোধ পুনঃস্থাপন, এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত ছাড়া শিক্ষার মান বৃদ্ধি অসম্ভব।
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ, রাজনীতি থেকে মুক্তি, প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ, জবাবদিহিতা নিশ্চিত—এসব পদক্ষেপ শিক্ষার মান উন্নয়নের মূল ভিত্তি। প্রযুক্তি, ডিজিটাল শিক্ষা, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা—সব সাহায্য করবে; কিন্তু প্রকৃত পরিবর্তন হবে, যখন শিক্ষক সমাজ স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ এবং সত্ হবে।
যেদিন শিক্ষকরা সত্, দায়িত্বশীল, অরাজনৈতিক, শিক্ষার্থীর মেধা ও নৈতিকতার দিকে মনোযোগী—সেদিন বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে উন্নতির পথে হাঁটবে। শিক্ষার্থীর মনোবিকাশ হবে, মানবিক মূল্যবোধ গড়ে উঠবে, সামাজিক নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে, আর সেই দিনই একটি নতুন, শিক্ষিত, শক্তিশালী এবং মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশের সূচনা ঘটবে।