03/01/2024
বাংলা লোক সাহিত্যে 'বারোমাসি' ও তার বিকাশ।
(পলাশ দত্ত
হংকং, ২১ জুন ২০২১)
মানব মনের সহজ ও সম্পূর্ণ প্রকাশ গানে। কথার মানুষ খণ্ডিত ও সীমিত। গানের মানুষ অখণ্ড ও সমগ্র। সৃষ্টির আদি কাল থেকেই পৃথিবীতে বিদ্যমান সুর, তাল ও ছন্দে সব দেশের মানুষই তাদের সুখ-দুঃখের সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশ ঘটিয়েছে গানে। সেই কৃষি সভ্যতার, নিসর্গলালনার যুগে প্রকৃতি রাজ্যের নিত্য নতুন বৈচিত্র্য ও ঐশ্বর্য, মনে-প্রাণে যোগাতো নব নব ভাব, সুর ও ছন্দ। প্রকৃতিঘেঁষা মানুষের জীবনে নিত্য উৎসব, বারো মাসে তেরো পার্বণের রটা-ঘটা ছিল বিপুল। আর নৃত্য ও গানই ছিল তার প্রকাশের অব্যর্থ মাধ্যম। প্রাণের মূর্তি ও ফুর্তি যেখানে যত অকপট ও অপর্যাপ্ত, সেখানে তার প্রকাশও তত গীতিময়। তাই লোকায়ত জীবনে কথার চেয়ে গানই মুখ্য। লোক-সাহিত্যে সর্বত্রই গীতি – গম্ভীরা, গাজন, ভাসান গান, ভাদুর গান, জারি, কবিগান, বাউল গান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ঘাটু গান, প্রভৃতি। এসকল লোক-সাহিত্যের প্রবাহমান ধারাকে আকর্ষণীয় করেছে ; ভাবে, ভাষায়, ছন্দে ও সুরের পরম সত্য ও সার্থক, প্রকৃতি ও মানুষে মেশামিশি হয়ে মানবমনের সঙ্গীত "বারোমাসি"।
বারোমাসি বলতে বোঝায় ছয় ঋতু বা বার মাসের পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে মানব-মানবীর বিচিত্র ও বিশিষ্ট মানস স্ফুতি; বিরহাতুর নারীর মানসিক অবস্থা, কখনও প্রাকৃতিক, কখনও সাংসারিক পটভূমিতেে করুণ মধুররূপে বর্ণিত গান বারোমাসী। এ গানগুলো মনসা মঙ্গল, চৈতন্য ভগবৎ, চণ্ডীমঙ্গল, ময়মনসিংহ গীতিকা ইত্যাদি বাংলা লোক সাহিত্য ছাড়াও গুজরাটি, রাজস্থানি, ভোজপুরি, পাঞ্জাবি, হিন্দী সাহিত্যেও উজ্জ্বল হয়ে আছে [South Asian Folklore] ।
বারোমাসি গীতি বলতে সবসময়ই বারো মাস বা ছয়টি ঋতুর পরিচয়ই যে থাকে, তা নয়। নায়ক-নায়িকার বিরহ-মিলনজনিত চিন্তানুভুতিই এর মর্মকথা। এর বিরহ বা মিলন কোথাও বারো মাস কোথাও আট মাস, কখনো বা ছয় মাস বা চার মাস কালব্যাপী হয়। যেমন, ষষ্ঠীবর দত্তের মনসা মঙ্গল কাব্যে নায়িকা বেহুলার অষ্টমাসিঃ
'বৈশাখ মাসেত মাগো, লখাইয়ে বিয়া করে।
কাল রাত্রি খাইল নাগে লোহার বাসরে।।'
[বেহুলার বারোমাসি, মনসামঙ্গল কাব্য]
বৈশাখ মাসের বিবাহের রাত্রি থেকে অগ্রহায়ণ মাস - এই আটমাসব্যাপী বেহুলার জীবনের একটানা অসহ্য দুঃখ-যন্ত্রণা ও অশ্রুপাতের চিত্রই তার অষ্টমাসি বলে পরিচিত। বর্ণনা এখানে আট মাসের হলেও বারোমাসি গীতি বলেই পরিচিত। ঠিক একইভাবে, ময়মনসিংহ গীতিকায় মালুয়ার অষ্টমাসি, বড়ুচণ্ডীদাসের "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন" কাব্যে রাধিকার বিরহ চতুর্মাসি, ময়মনসিংহ গীতিকায় লীলাবতীর ষান্মাষিকী গীতি সবই বারোমাসি গীতিরই সগোত্র, এই নামেই এদের সাধারণ পরিচয়। সহজ কথায়, বার মাস বা ছয় ঋতুর কয়েকটি মাস বা ঋতুর চিত্র চরিত্র অবলম্বনে মানব-মানবীয় আনন্দ-অশ্রু, আবেগ-উচ্ছ্বাসময় গীতিই বারোমাসি।
বারোমাসি সম্ভবত লোক ঐতিহ্য থেকেই লোক সাহিত্যে স্থান পায়। এসব গান গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের বৎসরব্যাপী জীবনালেখ্য যা মানুষের মুখে মুখে প্রবাহমান ছিল এবং এগুলো বেশ দীর্ঘ হওয়ায় তা মনে রাখার জন্য তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির প্রয়োজন ছিল। সুতরাং, তা সংগ্রহে না রাখলে কালের গভীরে হারিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। সংগ্রহের অভাবে বারোমাসি ভান্ডারের এক বিশাল অংশ অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Dusan Zbavitel বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যের বারোমাসি সংগ্রহ করেন। বাংলা, গুজরাটি ও রাজস্থানি সাহিত্যে বারোমাসির ২টি প্রাচীন রূপ পাওয়া যায়। প্রাচীন বারোমাসির নমুনার একটি বাংলা সাহিত্যের ১৪/১৫ শতকে প্রাপ্ত বড়ুচণ্ডীদাস রচিত "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন" এর রাধার চৌমাসি, অপরটি রাজস্থানি ভাষায় জৈন লেখন জিনাপদ্মভা সুরি (১৪ শতক) এর রচিত চৌমাসি (Charlotte Vaudeville, Delhi, 1986)। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের শূন্যপুরাণে (রামাই পন্ডিত, খৃঃ ১০-১১শ শতাব্দী) রচিত শিবের গানে পঞ্চমাসি কৃষিভিত্তিক বর্ণনা পাওয়া যায় (ভারতীয় সাহিত্যে বারমাসী/বারমাস্যা - শিব প্রসাদ ভাট্টচার্য, পৃঃ ১১৪)।
এ বারোমাসি গীতিগুলো এদেশের নিজস্ব সম্পদ বলে মনে হয়। ইউরোপীয় তথা অন্য পাশ্চাত্য সঙ্গীতে মাস হিসেবে নারীর এইরূপ বিরহ-বর্ণনা পাওয়া যায় না। অনেক স্থানেই দেখা যায় বারোমাসি গীতিকার “terminus antequem’ বা আগে আসে। কাজেই বারোমাসিগুলো গীতিকার চেয়ে প্রচীন [ড. আশরাফ সিদ্দিকী, লোক-সাহিত্য, (২য় খণ্ড) ১৯৯৫]। বারোমাসিগুলো যে অত্যন্ত প্রাচীন সে সম্বন্ধে মতভেদ নেই। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেনঃ “The earliest poetic tradition of the country was that a Bengali poem not be complete without a baromasi an account of twelve months… We have found baromasis even from the days of aphorisms of dak and khana, composed probably in the ninth century.” [Sen. Eastern Bengal Ballads: Mymensingh (Calcutta, 1923), ii-iii]।
এই বারোমাসিগুলো আমাদের গীতিকাকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। গানগুলো অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ বলে সাধারণত লোকগীতির মতো এর ব্যবহার হয় না। বারোমাসির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে অধ্যাপক Dusan Zbavitel লিখেছেনঃ "the baomasi originated in folk-poetry, that owing to its intrinsic attractiveness and its great popularity in Bengal, it found a place again and again in the classical literature, being, of course, always reshaped and remoulded by various poets according to their poetic aims, imagination and creative ability; at the same time, however, it followed its own course of development in folk-poetry itself, being influenced in its turn those forms and types creative in the sphere of art literature especially in Vaishnava poetry. [Dr. Dusan Zbavitel, Calcutta, 1962]
লোকগীতির অন্যতম মুখ্য বৈশিষ্ট্য এর রুপক বা সঙ্কেতের ব্যবহার। বিষয় ভেদে বারোমাসিগুলোকে কৃষি সম্প্রদায়ের ব্যবহারিক বা ritual, আখ্যানের কোনো অংশে বিরহিনী নায়িকার উক্তি নিতান্তই বিরহিনীর উক্তি বা প্রেমমূলক ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা যায়। গীতিকার নারীরাও প্রকৃতি প্রেমিক-প্রকৃতিরই যেন অংশ। কৃষিনির্ভর আর্যেতর সমাজ বলতে যেহেতু প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বা 'বঙ্গ' জাতি বোঝাতো সে কারণে বারোমাসির আধিক্য এখানে স্বাভাবিক ছিল বলেই মনে করা হয়। ধারাবাহিক প্রবন্ধ The Development of the baromasi in the Bengali Literature Folklore, III Calcutta, 1962, pp-61-175, 201-216, 254 268]-তে Dr. Dusan Zbavitel স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছেন বারোমাসিগুলো ভারতের পূর্বাঞ্চলে (বঙ্গ) বেশি পাওয়া যায় । বিচিত্র এ বারোমাসিকে বৃহৎ অর্থে মৌখিক ও লিখিত (সাহিত্যে ব্যবহৃত) - দুই শ্রেনীতে ভাগ করা যায়। Dr. Dusan Zbavitel লিখিত বা সাহিত্যে প্রাপ্ত বারোমাসিগুলোকে সর্বপ্রথম নিম্মোক্ত পাঁচভাগে ভাগ করেছেনঃ ১. ধর্মীয়ভিত্তিক বারোমাসি, ২. কৃষিভিত্তিক বারোমাসি, ৩. বর্ণনামুলক বারোমাসি, ৪. বিরহ বারোমাসি, ৫. সতিত্ব পরীক্ষার আখ্যানমূলক বারোমাসি। পরবর্তীতে ভাব বা প্রকৃতি অনুসারে বিচিত্র বারোমাসিকে ডক্টর শিব প্রসাদ ভট্টাচার্য তাঁর "ভারতীয় সাহিত্যে বারমাস্যা" নামকগ্রন্থে নিম্মোক্ত শ্রেণীসমূহে অন্তর্ভূক্ত করেছেন :
ক) আদি বা মৌলিক বারোমাসি: কৃষিত্তিক- বারোমাসিগুলো সাধারণত আদি বা মৌলিক বারোমাসি:
চৈতে থর থর-বৈশাখে ঝড়পাথর
জ্যৈষ্ঠে তারা ফুটে-তবে জানবি বর্ষা বটে।।
পৌষে গরমি, বৈশাখে জাডা।
প্রথম আষাঢ়ে ভরবে গাডা।।
বৎসরের প্রথম ঈশানে বয়।
সে বৎসর বর্ষা হবে খনায় কয়।।
চৈতে হেরানি, বৈশাখে জাডা।
প্রথমে জ্যৈষ্ঠে ভরবে জাডা
ডাক বলে এই তিন বাণী, আষাঢ় শ্রাবণ নাইকো পানি।।
[ডাক ও খনার বচন]
(খ) মধ্যযুগীয় বা সাহিত্যিক বারোমাসি: কালক্রমে এই কৃষি- বারোমাসি বা আদিপর্বের বারোমাসির নিদর্শন বৈষ্ণব নাথ সাহিত্য, শাক্ত সাহিত্য শৈব সাহিত্যসমূহে লিখিতরূপে দেখা যায়;
বৈশাখে বিষম ঝড় এ হিয়া আকাশে।
কে রাখে এ তরি পতি-কাণ্ডারী বিদেশে।।
জৈষ্ঠে রসাল-রস সবে পান করে ।
বিরস আমার হিয়া পিয়া নাই ঘরে।।
[রাধার বারোমাসি লোচনদাস]
(গ) আধুনিক বারোমাসিঃ এ কালের বারোমাসি, না চাষীর জীবন গান, না সেদিনের গতানুগতিক প্রেমগীত। নায়ক নয়িকার মিলন বা বিরহাত্মক প্রেম-চিত্র একালের বারোমাসিতেও আছে, তবে তেরো পার্বণের ছটা এখানে নগন্যঃ
ভেসে যায় হাওয়ায় হাওয়ায় তারা
তারা বুঝি বৃষ্টিহারা বৈশাখীর ঢেউ, হাওয়া মেঘ
তারা গানের পাখির সুর অগোচর
("নাম রেখেছি কোমল গান্ধার", বিষ্ণু দে)
(ঘ) আখ্যান বা বর্ণনামূলকঃ এ বারোমাসিগুলো নিছক বর্ণনামুলক;
বৈশাখে এ দেশে বড় সুখের সময়।
নানা ফুল গন্ধে মন্দ গন্ধবহ বয়
বসাইয়া রাখিব হৃদয় সরোবরে।
কোকিলের ডাকে কামে নিদাঘে কি করে।।
[বিদ্যার বারোমাসি, অন্নদামঙ্গল- ভারতচন্দ্র]
(ঙ) ব্যক্তিগত দুঃখ-দারিদ্র্যমুলক বারোমাসিঃ এধরনের বারোমাসি কতকগুলি একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখ-দারিদ্র্যমুলক বর্ণনা:
প্রথম জৈষ্ঠেতে গেলা গড়াতে পিঞ্জর।
প্রবলা সতিনী মোর হৈল স্বতস্তর।।
ছাগল রাখিতে পত্র আইল যেই দন্ডে।
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়ে খুল্লনার মুণ্ডে।।
(খূল্লনার বারোমাসি, চণ্ডীমঙ্গল - মুকুন্দরাম।)
বৈশাখে বসন্ত ঋতু খরতর খরা।
তরুতল নাহি মোর করিতে পসরা।।
[ফুল্লরার বারোমাসি, চন্ডীমঙ্গল কাব্য-কবিকঙ্কণ মুকুন্দ রাম]
(চ) পূজা বা অর্ঘ্যমূলক বারোমাসিঃ মানবলীলার পরিবর্তে দৈবলীলা কীর্তনই এ জাতীয় বারোমাসির বৈশিষ্ট্য।
কার্ত্তিক মাসেতে দেখ কার্ত্তিকের পুজা
পরদিমের ঘট আকি বাতির করে সাজা।।
[কমলা- ময়মনসিং গীতিকা]
(ছ) মিলনমূলক বারোমাসিঃ এ ধারা সম্ভোগ-শৃঙ্গাররের চিত্ররুপ যেমন মঙ্গলকাব্যের সুশীলার চিত্র:
ফাল্গুণে ফুটিবে পুষ্প মোর উপবনে।
তথি দোলমঞ্চ আমি করিব রচণে।।
(সুশীলার বারোমাসি -চন্ডীমঙ্গল - মুকুন্দরাম)
(জ) বিরহমূলক বা ভাবাত্মক বারোমাসিঃ প্রাণপ্রিয় এর বিচ্ছেদে মানব-মানবীর মনের ভাবগাঁধা এ বিরহ বারোমাসি।
আষাঢ় মাসেতে নদীর কূলে কূলে পানি।
বাপেরে আনিতে মাধব সাজায় পানসীখানি।।
একেলা ঘরেতে রইল সুনাই যুবতী
সুনাই কান্দিয়া কয় শুন সল্ল্যা দূতী।।
ভাদ্র মাসেতে দূতী গাছে পাকনা তাল।
ভাবিয়া চিন্তিয়া দূতীরে (সুনাইর) গেল যৈবন কাল।।
[সুনাইর বারমাসী, দেওয়ান ভাবনা-ময়মনসিং গীতিকা]
চৈত্র চাতক পক্ষ পিউ পিউ ডাকে।
শুনিঞা জে প্রাণ করে তা কইবো কাকে।।
[বিষ্ণুপ্রিয়ার বারোমাসি, চৈতন্য মঙ্গল জয়ানন্দ]
এছাড়াও এ দেশে নারীর সতীত্বের পরীক্ষার আখ্যানমুলক বারোমাসি অথবা Chastity Test এর আর এক ধরনের বারোমাসি পাওয়া যায়;
এই তো পোষরে মাস দ্বিতীয়ায় উঠে চান।
কেমনে রাখিমু আমি নাগরের পরান।।
যেমনে পারো রাখো পরান আমার কিবা তায়।
পর নারীর আশা সাধু করো কি আশায়।।
[সিলেট জেলার কমলগঞ্জ থানা হতে চৌধুরী গোলাম আকবর কতৃক সংগৃহীত বারোমাসি]
পূর্বভারতীয় মহাকাব্য বা লোক-কাহিনীতে এধরনের বারোমাসি একটা বিশেষত্ব: কাজেই বিচিত্র নয় যে কোন কোন কৃষিজীবী প্রাচীন সমাজে সতীত্বের সাধনা এবং পরীক্ষা একটি বিশেষ ritual হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর পরবর্তী বারোমাসিতে তার স্পষ্ট চিত্র ফুঠে উঠে [আশরাফ সিদ্দিকী, পূর্বাচল, ১৩৮২, কার্তিক, পৃষ্টা ৬৮-৬৯ দ্রষ্টব্য]। মুলত বারোমাসিগুলো স্বতন্ত্র গীতের চেয়ে সাহিত্যের অন্য ধারায় (যেমন গীতিকা, মঙ্গল সাহিত্য) ব্যবহৃত হয়ে সে সাহিত্যের বিরহী নায়িকার স্বামী বিচ্ছেদ সময়ে যাপিত জীবনের বর্ণনা, ভাবে, ভাষায় ও সুরে স্বচিত্র হয়ে উঠেছে।
বারোমাসির অন্তর্নিহিত মানবচরিত্র বলতে বোঝায় নারী চরিত্র। বাংলা লোকসাহিত্যযে নারীপ্রধান। পুরষের বুদ্ধিমত্তা শৌর্য-বীর্যের অপেক্ষা নারীর হৃদয়বত্তা এবং প্রেম ও সেবাধর্মই আবহমানকাল নারীর বৈশিষ্ট্য বরেণ্যে হয়ে এসেছে। এখানকার ফুল্লরা, খুল্লনা, পদ্মাবতী, নাগমতী, বিষ্ণুপ্রিয়া অথবা সীতা বা বেহুলা শাশ্বত ও সনাতন নারীত্বের সার্থক প্রতিভূ। বারোমাসির এ সকল নারী চরিত্র সার্থক উপন্যাসের চরিত্র। বারোমাসিগুলোতে নারীত্বের যে অনবদ্য আলেখ্য মূর্ত হয়ে উঠেছে তা পরম গৌরব ও গরিমার। বারোমাসির সাহিত্যমূল্যও এখানেই। এ সাহিত্যের ভাষা, ছন্দ বা শিল্প সুষমাগত পরিচয়ে আপাতত একান্ত গ্রাম্য প্রকৃতির হলেও নারীচরিত্রের মাধুর্য ও ঐশ্বর্য নারীজীবনের অপূর্ব পতিব্রত্য আত্মবিস্মৃতিমূলক সেবা ও শুশ্রুষা সাহিত্য মূল্য মর্যাদার অন্যতম নিদান।
সার্থক সাহিত্যের অন্তনির্হিত মানব-মানবী চরিত্র জাতীয় জীবনের অতীত ও বর্তমানকে মুখোমুখী করে দেয়, সরিয়ে দেয় তাদের মধ্যকার হাজার বছরের ব্যবধানের পর্দাকে। সমাজ, প্রাচীন সাহিত্যের এ জাতীয় চিরকালীন চরিত্র গুলোকে ভর করে দুই কালের জীবন রুপকে একসুত্রে গেঁথে নেয়, খুঁজে পায় তার জাতীয় চরিত্র, জাতীয় ঐতিহ্যের যাবতীয় রহস্য ও গোপন মন্ত্রকে। বারোমাসির অন্তর্নিহিত বিচিত্র নারীচরিত্র অতীত ও বর্তমান সমাজ ও জীবনের সংযোগ সুত্ররূপে চিরস্মরণীয়। নারী ও পুরুষের বজ্র-দৃঢ় যে প্রেম ইতিহাস রচনা করতো, ঐতিহ্যের ধারা প্রবাহমান বজায় রাখতো তা থেকে আমরা আজ বড় দূরে সরে এসেছি, নকলে মজেছি। লোক সাহিত্যের এ প্রেম থেকে প্রেরণা নিয়ে বাঙ্গালি কি সাহিত্য ডালি সাজাতে পারে না?
গ্রন্থসূত্রঃ
১। Peter Claus, Diamond, Margaret Mills, South Asian Folklore: An Encyclopedia, 2003
২। Charlotte Vaudeville, Barahmasa in indian Literatures,
৩। Dusan Zbavitel, The Development of the baromasi in the Bengali Literature Folklore, III, Calcutta, 19620]
৪। Dr. Dinesh Chandra sen, Eastern Bengal Ballads: Mymensingh (Calcutta, 1923), ii-iii]
৫। ডক্টর শিব প্রসাদ ভাট্টচার্য, ভারতীয় সাহিত্যে বারমাস্যা, কলিকাতা, ১৯৫৯
৬। ডক্টর শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য্য, বাংলার লোক সাহিত্য, কলিকাতা, ১৯৫৪
৭। ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী, লোক-সাহিত্য, দ্বিতীয় খণ্ড, জুলাই ১৯৯৫
৮। ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী, পূর্বাচল, কার্তিক, ১৩৮২