12/09/2025
প্রবাস জীবন অনেকটা সমুদ্রের মতো—বাহ্যিকভাবে শান্ত, কিন্তু ভেতরে অসংখ্য ঢেউ, অসংখ্য ঝড়। বাইরে থেকে যাঁরা দেখে, তাঁরা শুধু বোঝেন আমরা অর্থ উপার্জন করি, দেশে টাকা পাঠাই, পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি। কিন্তু ভেতরে জমে থাকা কষ্টের পাহাড় তারা কেউ অনুভব করে না। আমি আলহামদুলিল্লাহ বলি, কারণ জীবিকার জন্য কাজ পেয়েছি, হাত-পা সচল আছে, নিজের পরিশ্রম দিয়ে রোজগার করতে পারছি। কিন্তু অভিযোগ না থাকলেও বুকের ভেতরে জমে থাকা কষ্টগুলো এত বড়, এত ভারী, যে মনে হয় পুরো একটি গ্রন্থালয় ভরে দেওয়া যায়। অথচ সুখের অধ্যায়গুলো এত ছোট, এত অল্প সময়ের জন্য আসে, যে হয়তো কয়েক পৃষ্ঠা লিখলেই শেষ হয়ে যায়।
সবচেয়ে বড় কষ্টটা টের পাই যখন অসুস্থ হই। শরীর ভেঙে যাচ্ছে, জ্বর কাঁপাচ্ছে, মাথা যেন ভারে নুয়ে পড়ছে—তবুও পাশে কাউকে পাওয়া যায় না। দেশে থাকলে মা হয়তো গরম ভাত আর আদা-চা বানিয়ে দিতেন, বাবা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, ভাই-বোনরা ঘিরে সান্ত্বনা দিত। কিন্তু এখানে অসুস্থতা মানেই নিঃসঙ্গতা। চারপাশে কেউ নেই যে এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দেবে। অচেনা দেশে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বুক ভরে ওঠে অশ্রুতে, কিন্তু সে অশ্রুর সাক্ষী থাকে শুধু চার দেয়াল। তবুও পরদিন সকাল হলে দুর্বল শরীর নিয়ে কাজে যেতেই হয়। কারণ প্রবাস জীবনে অসুস্থ হওয়ার বিলাসিতা নেই। আজ যদি কাজে না যাই, তবে হয়তো একদিনের বেতন কেটে যাবে, আবার মাস শেষে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে সমস্যা হবে।
শরীর যখন সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়ে, তখনও বাধ্য হয়ে কষ্ট সহ্য করতে হয়। কখনো জ্বরের মধ্যে গরম রোদে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছে, কখনো হাড় কাঁপানো শীতে ঘামে ভিজে যাওয়া শরীর নিয়ে কাজ চালাতে হয়েছে। কষ্টের সীমা তখন দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর কফিলের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার কথা ভুলেও আশা করা যায় না। বরং অনেক সময় সামান্য ছুটির আবেদনও নাকচ হয়ে যায়, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের জন্য বারবার ঘুরতে হয়, আর মনে হয় যেন আমরা কেবল শ্রম মেশিন, মানুষ নই।
দেশের মানুষ থেকেও টেনশান কম নয়। পরিবারের জন্যই এই দৌড়ঝাঁপ, এই আত্মত্যাগ। তবুও ছোট ছোট বিষয় নিয়েও তারা বিরক্তি প্রকাশ করে। কখনো সময়মতো টাকা পাঠাতে না পারলে অভিযোগের পাহাড়, কখনো পরিবারিক সমস্যায় দূরে থেকেও দায়-দায়িত্বের বোঝা এসে পড়ে কাঁধে। ফোনের ওপাশে তাদের অশান্তি শোনার পর নিজের নিঃসঙ্গতা আরও ভারী হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, আমি হাজার মাইল দূরে থেকেও যেন বোঝা বইছি দু’দিকের—একদিকে প্রবাস জীবনের নির্দয় বাস্তবতা, আরেকদিকে দেশের টেনশান।
প্রবাসের প্রতিটি দিন তাই একেকটা অধ্যায়। অসুস্থ শরীরে কাজে যাওয়া, নিঃসঙ্গতার সঙ্গে লড়াই করা, কফিলের অবহেলা সহ্য করা, দেশের অযাচিত চাপ বইতে থাকা—এসবই মিলেমিশে এক দীর্ঘ কষ্টের উপন্যাস। সুখের মুহূর্ত আছে ঠিকই, তবে তারা ক্ষণস্থায়ী—কখনো হয়তো সময়মতো টাকা পাঠাতে পারার আনন্দ, কখনো ঈদের দিনে পরিবারের হাসিমাখা মুখ ভিডিও কলে দেখতে পাওয়া। সেই ছোট্ট ছোট্ট আনন্দগুলোই কিছুক্ষণের জন্য বাঁচার শক্তি দেয়, কিন্তু খুব দ্রুতই তারা মিলিয়ে যায়।
সত্যি বলতে, সুখ এখানে আলোর ঝলকানির মতো ক্ষণিকের, আর কষ্ট হলো অন্তহীন রাতের মতো দীর্ঘ। তবুও আলহামদুলিল্লাহ—কারণ এই দীর্ঘ অন্ধকারের ভেতর দিয়েই আমি এখনো টিকে আছি, লড়াই করছি, এবং আশা নিয়ে বেঁচে আছি।
#প্রবাসেরজীবন #কষ্ট