04/09/2024
দি লষ্ট প্যারাডাইস!
৮০ ও ৯০ দশকে আমরা যারা জন্মেছি, তাদের হারানো আর পাওয়ার হিসাব নিকাশ।
আমরাই সেই শেষ জেনারেশন, যাঁরা জীবনের স্বর্গ দেখেছি ও হারিয়েছি! আর কোনো জেনারেশনই আর তা দেখতে পাবে না।!
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা গরুর গাড়ি থেকে সুপার সনিক কনকর্ড জেট দেখেছি। পোস্টকার্ড, খাম, ইনল্যান্ড লেটার, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, এ্যানালগ টাইপরাইটার থেকে শুরু করে আজকের হোয়াটস্যাপ চ্যাটিং, ফেসবুক, ই-মেইল পর্যন্তও করছি। অসম্ভব মনে হওয়া অনেক জিনিসই সম্ভব হতে দেখেছি।
আমরা সেই জেনারেশন, যারা টেলিগ্রাম এসেছে শুনলেই, ঘরগুষ্টির মুখ শুকিয়ে যেতে দেখেছি…!
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা মাটিতে বসে মাদুর পেতে ভাত খেয়েছি, আর পিরিচে ঢেলে চা খেয়েছি সুরুৎ শব্দে, পরে জেনেছি ওটা বদ-অভ্যাস ।
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি, বাঘবন্দি, ডাঙ্গুলি, দাড়িয়াবাধা, ডাঙ্গুলী, গোল্লাছুট, মার্বেল, লাটিম খেলেছি, বলার আঠায় বাঁশপাতা কাগজের ঘুড়ি বানিয়ে আকাশে উড়িয়েছি। নারকেল পাতা দিয়ে ঘড়ি ও চশমা বানিয়ে ওয়েষ্টার্ণ সেঁজেছি!
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা হ্যারিকেন আর কূপির আলোতে পড়াশুনা করেছি, বেত, কলমী লতার ডাল ও পাখার ডাঁটের বাপাঝাপ শো শো শব্দের বারি খেয়ে পাছা লাল করেছি। আর চাদরে উপুড় হয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে Adventure সিরিজ পড়তে গিয়ে মায়ের হাতের ধুপধাপ কিল খেয়েছি। মধুর ব্যাথা ছিলো, কিন্তু মা চলে যাওয়ার পরে ভাই বোনের কে কয়টা খেলো, সেটা নিয়ে হিসেব কষে মখবন্ধ করে ফোসফোস করে হেসেছি চোখে জল নিয়ে!
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা মোবাইল, কম্পিউটার, ফ্যান, এসি, হিটার, ফ্রীজ, গ্যাস, মাইক্রো- ওভেনের অস্থাবর সুখ ছাড়াই ছোটবেলা কাটিয়েছি ।
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা ঈগল পেন থেকে বমি করা সুলেখা কালি হাতে মেখে মাথায় মুছে ‘বাবরের যুদ্ধবৃত্তান্ত’ লিখেছি, বড়দের পকেটে বড় নিবের উইংসাঙ পেন দেখেছি, আর নতুন বই-খাতার একটা আলাদা গন্ধ আর আনন্দ উপভোগ করেছি। কাঠের হলুদ স্কেলের টাসটাস মারের শব্দে স্কুলের স্যারের বকুনি খেয়েছি। আমদের দিকে ছুড়ে দেয়া ডাষ্টার আর চক ক্যাচ ধরতে ধরতে আমরা ক্রিকেট শিখেছি। নারকেল ও তাল গাছের পাতার ডাট দিয়ে তৈরী ব্যাট হাতে আমরা চার ছক্কার ঝড় তুলেছি।
আমরাই সেই জেনারেশন যারা বিনা টিফিনে স্কুলে গেছি, স্কুলে দোষে বা বিনাদোষে টিচারের হাতে মার খেয়ে, বাড়ি এসে নালিশ করাতে, বাবা ও মায়ের হাতে সেকেন্ড-রাউন্ড বেদম ফ্রি-ষ্টাইল ওয়ান-ওয়ে চরম ক্যালানী সহ্য করেছি।
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা বড়দের এবং শিক্ষকদের সন্মান করেছি এবং আজও করে যাচ্ছি।
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা দুপুরে ও জোৎস্না রাতে ছাদে রেডিওতে বিবিসি’র খবর, মনিহার সিনেমা হলের নতুন ছবির ঢিসুম ঢাসুম এবং সৈনিক ভাইদের চিঠির মাধ্যমে গানের অনুরোধের আসর "দূর্বার" উপভোগ করেছি।
আমরা সাদাকালো টেলিভিশনে কোথাও কেউ নেই, বহুব্রিহী, সংসপ্তক, বারো রকমের মানুষ নাটক, ও নাইট রাইডার, ম্যাকগাইভার ইংরেজী সিরিজ, নিনজা টার্টেলস, স্পাইডার ম্যান কার্টুনসহ বাংলা সিনেমার গানের আসর ছায়াছন্দ এবং ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদী দেখেছি।
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা টেলিভিশনে খেলা দেখার জন্য ছাদে উঠে এ্যন্টেনা এডজাস্ট করে স্যিগনাল ধরে ছঁবি ক্লিয়ার করার জন্য ছাদের উপরে একজন, নিচের সিড়িতে একজন ও টিভির সামনে একজন করে ভয়েস রিলে ম্যান দাড় করিয়ে চিৎকার করে বলেছি " আইছে"। তিন লাঠির এন্টেনা, টিভি স্ক্রিনে পার্মানেন্ট ঝিলমিলানি, তাতে কোনও প্রব্লেমই হোত না আমাদের, ওটা জীবনের অঙ্গ ধরাই ছিল। গন্ডগোল পাকাতো ঐ লোডশেডিং।
মাঝে মাঝে ভোল্টেজ কম থাকার কারনে, টিভিতে দাড়ানো ছঁবিগুলোকে হুদাই স্লোমোশনে মাজা বাঁকিয়ে ড্যান্স দিতে দেখেছি, তাতেও আমাদের কোন সমস্যা ছিলো না। আমরা টিভিতে টু উ উ উ উ শব্দে লম্বা দাগের চেক পড়তে দেখেছি! পরবর্তীতে বলতে শুনেছি "প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় আমরা দু:খিত'!
প্রতি শুক্রবার বিকাল সাড়ে তিনটায় শুরু হওয়া বাংলা সিনেমাটি দেখার জন্য ঘরটাই পাড়া প্রতিবেশিদের ভিড়ে সিনেমা হল হতে দেখেছি। একেকবার এ্যাড দেয়া শুরু হলে ২০/২৫ মিনিট শুধু এ্যাডই চলতো " কসকো" সাবান, তিব্বত পাউডার, স্নো, স্টার ও সিজার সিগারের, ফিলিপস্ বাতির সেই ঐতিহাসিক ডায়লগ " ও মানিক, কি বাত্তি লাগাইলি! মাছের রাজা ইলিশ, আর বাত্তির রাজা ফিলিপস্"! দেখেছি। বিকাল সাড়ে তিনটায় শুরু হওয়া বাংলা সিনেমা স্বন্ধ্যা ৭ টায় শেষ হতে দেখেছি।
আমরাই সেই জেনারেশন, যারা আত্মীয় স্বজন বাড়িতে আসার জন্য অপেক্ষা করেছি। বাড়ীতে আত্মীয় স্বজন এলে, পুরো বাড়ীতে ঈদের আনন্দ বইতে দেখেছি। ইচ্ছে করে বৃষ্টি ভিজ, কাঁদা মাটিতে আছার খেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ঢুকেছি।বিকেলে বড় মাঠে একেক দলে ২০/২৫ জন করে খেলোয়াড় নিয়ে ধুন্দুমার গায়ের জোরের ফুটবল খেলে পাশের জঙ্গলে শিয়াল ডাকার আগেই বাড়িতে ঢুকেছি। খেলতে গিয়ে ব্যাথা পেয়ে পয়ায়ে ফুটো ফুটো জাম্ব্যাক প্লাষ্টার লাগিয়েছি।
স্কুল ফাকি দিয়ে নারকেল চুরি করে খেয়ছি, শীতের রাতে খেজুরের রস চুরি করে পায়েস পিকনিক করেছি। পরের দিন বাবার কাছে নালিশ আসার পরে সেই ঐতিহাসিক খাজুরের পাতার লাঠির চরম প্যাদানী খেয়েছি, মায়ের আশ্রয়ে গিয়েও এ্যাগাইন ডাল ঘুটনীর রিমান্ড ক্যালানী খেয়েছি। তখন জিবনটাকে মনেহতো তেজপাতা, আর নিজেকে মনেহতো ঝোলের লাউ কদু!
আমরা সেই জেনারেশন, যারা ঈদ ও পূজোর সময় শুধু একটা নুতন জামার জন্য অপারগ অভাবি বাবার দিকে অসহায় হয়ে চেয়ে থেকেছি। ঈদের দিক সকালে নতুন টাকার জন্য এ বাড়ী, ও বাড়ীতে মুরব্বীদের সালাম করে সালামী পাওয়ার আসায় ঘুরেছি। বিকেলে সব মিলিয়ে সামালী ২০/৩০ টাকা হলেই মনেহতো, আমি বড়লোকস্!
আমরা সেই প্রজন্ম, যারা রাস্তাঘাটে স্কুলের স্যারকে দেখামাত্র রাস্তাতেই নির্দ্বিধায় প্রণাম/সালাম করেছি এবং এখনো করি। আমরা কলেজে ওঠার পর সিগারেট টানা অবস্হায় এলাকার কোন মুরব্বী, বড়ভাই বা শিক্ষকদের দেখলে, হাতের মুঠোতে সিগারেট লুকিয়ে, কতোবার যে হাতে ঠোসকা ফেলেছি, তা গুনে বলা সম্ভব নয়। কতো শতবার যে সিগারেটের ধোয়া মুখে আটকে রেখে দমবন্ধ করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি! তারও হিসেব নেই।
আমরাই সেই সর্বশেষ জেনারেশন, যারা এখনও বন্ধু খুঁজি। এখনো আমাদের স্কুল কলেজের বন্ধুদের কাছে পেলে, আমরা বয়সটা ভুলে গিয়ে, সেই সোনালী ছোট্টবেলায় ফিরে যাই! ভুলে যাই পরিবারের কথাও! আর এসব দেখে, এখনকার জেনারেশন হাসে, তাকিয়ে থাকে। হয়তো ভাবে, আমরা Zen X রা আসলেই পাগল! হ্যা, আমরা আসলেই পাগল!
কারন আমাদের জীবনের চলার স্রোত, আধুনিকতা ও ডিজিটাইলাইজেশনের কারনে আমরা হারিয়েছি আমাদের জীবনের সোনালী স্বর্গ!
দি লস্ট প্যারাডাইস!