18/06/2025
তেহরানের ভেতরে বসেই মোসাদ এমন এক অপারেশন চালিয়েছে, যা শুধু ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অচল করেনি, বরং গোয়েন্দা ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী প্রযুক্তিনির্ভর অভিযান হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। অপারেশনটির কোডনেম ছিল Operation Rising Lion। এর প্রস্তুতি শুরু হয় কমপক্ষে ১৮ থেকে ২৪ মাস আগে, যেখানে গোটা অভিযান ধাপে ধাপে গড়ে তোলা হয়েছিল স্থানীয় রিক্রুটমেন্ট, প্রযুক্তি, এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রতারণার মাধ্যমে।
প্রথম ধাপে, মোসাদের Tzomet ইউনিট চুপিচুপে রিক্রুট করতে শুরু করে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি, যারা হয়তো আগে বিদেশে ছিল, ব্যবসা করত, অথবা প্রশাসনের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল। কাউকে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল টাকার লোভে, কাউকে ব্ল্যাকমেইল করে, আবার অনেকেই বুঝতেই পারেনি তারা কীভাবে একটা বড় জালে ঢুকে পড়েছে। কেউ হয়তো শুধু ভেবেছে, তারা কোনো বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রকল্পে কাজ করছে। এদের কারও পাসপোর্ট ছিল লেবানিজ বা তুর্কি, কেউ বা স্থানীয়ভাবে মিশে গিয়েছিল গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানির ব্যবসায়।
তেহরানের কেন্দ্রস্থলে একটি তিনতলা ভবন ভাড়া নেওয়া হয়। নিচের তলায় গ্যারেজ চালু করা হয়, ওপরে গড়ে তোলা হয় অ্যাসেম্বলি হাব। ভেতরে চুপিচুপে মোসাদের প্রযুক্তি ইউনিট AI–চালিত, GPS–ট্রিগারযুক্ত ড্রোন অ্যাসেম্বলি শুরু করে। এসব ড্রোন পার্টস আনা হয় ছোট ট্রাক আর পার্সেলের মাধ্যমে—নথিতে লেখা থাকত “অটোমোটিভ স্পেয়ার পার্টস”।
প্রতিটি এজেন্ট বা সহযোগী আলাদা আলাদা রোলে ছিল—কেউ নিরাপত্তা ক্যামেরা ঘোরানোর দায়িত্বে, কেউ কাস্টমস প্যাকেজ রিসিভ করত, কেউ ভবনের আশেপাশে প্রহরীর গতিবিধি লক্ষ রাখত। সবাই জানত না পুরো চিত্র। কেউ ছিল ‘ডিপ কাভার’—যাদের চিনতে ইরানের গোয়েন্দারাও হিমশিম খেত। অনেকে শুধু “রোবোটিক্স ওয়ার্কশপ”-এর নামে নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতি জোড়া লাগাতো, জানত না কী কাজে ব্যবহৃত হবে।
সিগন্যাল ও সাইবার দিকটা সামলাচ্ছিল Keshet ইউনিট। তারা ইরানের অভ্যন্তরীণ রাডার, স্যাটেলাইট লিংক এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। সাবেক ইরানি এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারদের মাধ্যমে তারা পায় অভ্যন্তরীণ গেটওয়ে ও আইপি লগ—ডেটা বিশ্লেষণ করে ঠিক করে কোন সময়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল থাকে।
এরপর, ১৩ জুন রাত। ঠিক সেই মুহূর্তে ড্রোনগুলো ছাড়া হয়। একে একে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হানে—
১. স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন নোড,
২. Esfajabad ক্ষেপণাস্ত্র কন্ট্রোল সেন্টার,
৩. একটি সেনা রিলে স্টেশন।
ড্রোনগুলো এতটাই ছোট, কম শব্দযুক্ত এবং রাডার-প্রতিরোধী ছিল যে সেগুলো চুপচাপ লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। আঘাতের ফলে ইরানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
ঠিক এরপরই শুরু হয় ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর “Iron Sweep” অপারেশন—২০০টি যুদ্ধবিমান এবং ৩০০টিরও বেশি নির্ভুল বোমা নিয়ে তারা প্রবেশ করে ইরানের বায়ুসীমায়। প্রতিরোধ তখন আর কার্যকর ছিল না, কারণ মোসাদ আগেই ভিতরের সিস্টেম দুর্বল করে দিয়েছিল।
সবচেয়ে প্রযুক্তিনির্ভর ও নাটকীয় অংশ ছিল ইরানি পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ–এর হত্যাকাণ্ড। মোসাদ একটি নিসান পিকআপে লুকানো একটি AI-চালিত রিমোট মেশিনগান ব্যবহার করে। অস্ত্রটি যুক্ত ছিল ফেস রিকগনিশন ও স্যাটেলাইট-নিয়ন্ত্রিত ফায়ারিং সিস্টেমের সঙ্গে। AI সিস্টেম পূর্ব থেকে প্রশিক্ষিত ছিল ফাখরিজাদেহের মুখ শনাক্ত করার জন্য। গাড়ি রাস্তার পাশে পার্ক করা ছিল। মুখ শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র গুলি চালায়—তাঁর স্ত্রী পাশে ছিলেন, কিন্তু একটি গুলিও তাঁকে স্পর্শ করেনি। গুলি শেষ হলে গাড়িটি নিজেই বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়।কোনো এজেন্ট ছিল না।
অভিযান শেষে ভবনটি পরিত্যক্ত করা হয়, কিন্তু তার আগে এজেন্টরা ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলে যায় একগাদা বিভ্রান্তিকর প্রমাণ:
বৈধ ব্যবসার লাইসেন্স,
কর্মচারীদের হাজিরা রেকর্ড,
আরবি ভাষায় লেখা কিছু ভুয়া অস্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইমেইল যোগাযোগ,
DVR ফুটেজে গ্যারেজে কর্মরত কর্মচারীদের দৃশ্য।
এমনকি সার্ভারের ভিতরে ইনপুট রাখা হয় কিছু সাজানো সফটওয়্যার লগ—যাতে মনে হয় ভবনটি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কালোবাজারি গ্রুপ পরিচালনা করছিল, এবং এর সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব তথ্য দেখে ইরান ৩–৪ দিন ধরে ভুল পথে তদন্ত চালায়। কিছু স্থানীয় সহযোগী ধরা পড়লেও, যাদের তথ্য সীমিত ছিল—মূল পরিকল্পনাকারীরা ততক্ষণে নিরাপদে ইরান ত্যাগ করেছে।
পুরো অপারেশনে একেকটা ইউনিট নিখুঁতভাবে কাজ করেছে—Tzomet লোকাল লোকজন নিয়ন্ত্রণ করেছে, Caesarea ফিল্ড অপারেশন পরিচালনা করেছে, Keshet সাইবার সিস্টেম হ্যাক করেছে, আর আইডিএফ-এর বিমান বাহিনী শেষ ধাপে আঘাত হেনেছে।
এটি ছিল যুদ্ধের সেই স্তর, যেখানে গুলি না চালিয়েও যুদ্ধ জেতা যায়—তথ্য, প্রযুক্তি, ধৈর্য, আর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ দিয়ে। এই অপারেশন দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে গোটা একটি রাষ্ট্রকে তার ভিতর থেকেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলা যায়—বুঝে ওঠার আগেই।
(Tehsin Hasan)