02/11/2025
ত্যাগী নেতাকর্মীদের সাথে ইউপিডিএফ কেন বিশ্বাসঘাতকতা করে?
পার্বত্য চট্টগ্রামের রুক্ষ ভূমি, যেখানে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকেই লুকিয়ে আছে অসংখ্য স্বপ্ন এবং যন্ত্রণা, সেখানে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামক সংগঠনটি জাতির মুক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই সংগঠনের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, প্রকাশ পেয়েছে তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাসঘাতকতা, স্বজনপ্রীতি এবং ত্যাগী কর্মীদের প্রতি অকৃতজ্ঞতা। গত দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে, ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা এবং জাতিগত বিভেদ সৃষ্টির মতো অন্যায়কর্মের কারণে অসংখ্য ত্যাগী নেতাকর্মী সংগঠন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই প্রতিশোধের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ কেউ জীবন রক্ষার্থে পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে শহরে পলায়ন করেছেন, আবার কেউ অপহরণের পর মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসে 'জাত বিরোধী' ট্যাগ নিয়ে সমাজে অপমানিত জীবন যাপন করছেন। এই প্রতিবেদনটি এমনই একটি কাহিনির মাধ্যমে ইউপিডিএফের অন্ধকার দিকগুলো উন্মোচন করবে, যা 'হিল নিউজ বিডি ডটকম'-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি। উৎপল চাকমা নামক এক ত্যাগী কর্মীর জীবনকাহিনীকে কেন্দ্র করে এই প্রতিবেদন বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যাতে পাঠকরা বুঝতে পারেন কীভাবে একটি সংগঠন তার নিজস্ব সদস্যদের সাথে বেইমানি করে জাতির স্বার্থকে কলঙ্কিত করছে।
ইউপিডিএফের উত্থান এবং অধঃপতন, একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
ইউপিডিএফের জন্ম হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতায়, যেখানে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পাহাড়ি জনগণের অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। সংগঠনটি জাতির মুক্তির নামে গঠিত হলেও, তার কার্যকলাপে প্রকাশ পেয়েছে একটি ভিন্ন চিত্র। চাঁদাবাজি, চাঁদার ভাগবাটোয়ারা, অন্যায়ভাবে হত্যা, অপহরণ, খুন-গুম এবং জাতিগত ভেদাভেদ সৃষ্টি এসব কার্যকলাপ সংগঠনের মূল চরিত্রে পরিণত হয়েছে। দুর্বলের বিপক্ষে রায় প্রদান, দলীয় পদবীতে প্রমোশনে স্বজনপ্রীতি এবং অনিয়মের কারণে ত্যাগী কর্মীরা অবহেলিত হয়েছেন। ফলে, গত দুই যুগে অসংখ্য কর্মী সংগঠন ত্যাগ করেছেন, এবং তাদের অধিকাংশই প্রতিশোধের শিকার। এই অধঃপতনের মূলে রয়েছে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের স্বার্থপরতা, যারা জাতির অধিকারের নামে পাহাড়ি যুবকদের বিপথগামী করে, চাঁদার টাকা দিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। এই নেতারা প্রায়শই ভারত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার বা থাইল্যান্ডে অবস্থান করে, যখন তাদের কর্মীরা পাহাড়ের জঙ্গলে অনিশ্চিত জীবন কাটান।
সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে জানা যায়, ইউপিডিএফের দুটি সংবিধান রয়েছে: একটি প্রকাশ্য, যা জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, যাতে অধিকারের চবক, মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা এবং ভূমি অধিকারের নামে বাঙালি ও সেনাবাহিনী বিরোধী বিদ্বেষ ছড়ানো হয়; এবং অন্যটি গোপন, যা শুধুমাত্র শীর্ষ নেতাদের কাছে থাকে। এই গোপন সংবিধানে চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষ দমন, বাঙালি বিদ্বেষ, নিত্য নতুন ইস্যু সৃষ্টি এবং দলছুট কর্মীদের হত্যাকে 'ধর্ম' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই দ্বৈততা সংগঠনকে টিকিয়ে রেখেছে, কিন্তু ত্যাগী কর্মীদের জীবনকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। যেমন, চাঁদা আদায়কারী কর্মীদের মাসিক ভাতা মাত্র ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা, যখন শীর্ষ নেতারা লক্ষ লক্ষ টাকা ভোগ করেন। এই অসমতা কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়, এবং প্রতিবাদ করলে তাদের নজরদারি করে হত্যা করা হয়।
উৎপল চাকমার মত ত্যাগী কর্মীর জীবনকাহিনী:
এই অধঃপতনের জীবন্ত উদাহরণ হলেন উৎপল চাকমা, যিনি ২০ বছরেরও অধিক সময় ইউপিডিএফের সাথে যুক্ত ছিলেন। রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার ২ নং ফটিকছড়ি ইউনিয়নের মানিকছড়ি পাড়ায় বাসিন্দা শশী ভূষণ চাকমার পুত্র হচ্ছেন উৎপল চাকমা। তাঁর শিক্ষাজীবন কাউখালী পোয়াপাড়া হাইস্কুলে কাটলেও, পার্বত্য অঞ্চলের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে তিনি ২০০৫-২০০৬ সালে ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এ যোগ দেন। এরপর তিনি চাঁদা সংগ্রহ গ্রুপে যুক্ত হন, এবং ২০১১ সালে স্থানীয় বাঙালিদের হাতে ধরা পড়ে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পুলিশে হস্তান্তরিত হন। অস্ত্র মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি লক্ষীছড়িতে চলে যান এবং গণতান্ত্রিক যুব ফোরামে যোগ দেন, যেখানে তিনি খাগড়াছড়ি জেলার সাধারণ সম্পাদক হন। পরবর্তীতে তিনি ইউপিডিএফের সশস্ত্র গ্রুপে যুক্ত হন, লক্ষীছড়ির যতীন্দ্র কার্বারি পাড়া, মরাচেঙ্গী, মরণছড়ি, কদুকছড়ি এবং রাজগিরি এলাকায় সক্রিয় ছিলেন।
উৎপল চাকমা সংগঠনের জন্য অসংখ্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মিছিল-সমাবেশে জনগণকে সম্পৃক্ত করা, চাঁদা সংগ্রহ, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় এবং নির্যাতন এসব কার্যকলাপে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বাঙালি ও সেনাবাহিনী বিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে প্রতিপক্ষ জেএসএস, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ মুখোশ এবং জেএসএস সংস্কার বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। প্রতিপক্ষদের হত্যা করার জন্য তিনি হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, সবকিছু জাতির মুক্তির নামে। কিন্তু এই ত্যাগের বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন অবমূল্যায়ন। সংগঠনে পদবণ্টনে স্বজনপ্রীতি এবং শীর্ষ নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, যখন সিনিয়র কর্মীরা অবহেলিত হন। উৎপলের মতো ত্যাগীরা জঙ্গলে বৃষ্টি-বাদল, শীত-বর্ষা মোকাবিলা করে, কিন্তু দিনশেষে তাদের ছুড়ে ফেলা হয়।
বিশ্বাসঘাতকতার চিত্র ও উৎপলের ত্যাগ এবং ইউপিডিএফের প্রতিশোধ:
২০২৪ সালের শুরু থেকে ইউপিডিএফ উৎপলকে নজরদারি করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে যে, প্রথম স্ত্রী-সন্তান রেখে দ্বিতীয় বিবাহ করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু উৎপলের দাবি, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তার পরিবারে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে তাকে অস্থির করা হয়েছে। ফলে তিনি সংগঠন ত্যাগ করেন, এবং তখন থেকে তার বিরুদ্ধে 'জাত বিরোধী' এবং 'মুখোশ' ট্যাগ দেওয়া শুরু হয়। সাম্প্রতিক ঘটনায়, গত ১৩ অক্টোবর লক্ষীছড়ি সেনা জোন থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল যতীন্দ্র কার্বারি পাড়ায় অভিযান চালায়, এবং ইউপিডিএফের পরিচালিত নিউজ পোর্টালে দাবি করা হয় যে উৎপল চাকমা সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন। এতে তার নামের সাথে দূর্জয় চাকমা এবং অজ্ঞাত একজনের নাম যুক্ত করা হয়।
উৎপল এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, "আমাকে সরাসরি না দেখে প্রমাণ ছাড়া মনগড়া অভিযোগ আনা হয়েছে। আমি লক্ষীছড়িতে ছিলাম কিনা, সেনাবাহিনীর সাথে অভিযানে ছিলাম কিনা এসবের প্রমাণ ছাড়া এটি নিছক ষড়যন্ত্র। ইউপিডিএফের নিজস্ব পেইজ দিয়ে যার তার বিরুদ্ধে লিখলে কী হলো? মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেওয়া ভালো নয়। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে দাঁড়িয়ে যায়।" তিনি আরও বলেন, ইউপিডিএফের মধ্যে পাগল এবং বিবেকহীন মানুষ থাকলে সংগঠন কীভাবে টিকবে? তার এই প্রতিক্রিয়া সংগঠনের চাঁদাবাজি, দমনপীড়ন এবং অধিকারের নামে ভাঁওতাবাজির মুখোশ উন্মোচন করেছে।
ইউপিডিএফের ভয়ের মূলে রয়েছে উৎপলের জ্ঞান তিনি সংগঠনের সশস্ত্র কার্যক্রম, অস্ত্র-গোলাবারুদ, অবস্থান এবং গোপন কৌশল জানেন। সম্প্রতি তিনি সামরিক ইউনিফর্ম, একে-৪৭ এবং ওয়াকিটকি ছেড়েছেন, কিন্তু লক্ষীছড়ি, মানিকছড়ি, গুইমারা এবং কাউখালী এলাকার 'হাঁড়ির খবর' তার জানা। ফলে, সংগঠন তাকে 'বিষফোড়া' হিসেবে দেখছে এবং যেকোনো সময় তার জীবন নাশের চেষ্টা করতে পারে। 'প্রবেশ' গ্রুপের প্রবেশ এবং জয় বসু তার বিরুদ্ধে, যা প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
সামাজিক প্রভাব এবং হাজারো উৎপলের যন্ত্রণা:
উৎপল চাকমা একা নন; হাজারো ত্যাগী কর্মীর জীবন ইউপিডিএফের নীতির কারণে দুর্বিষহ হয়েছে। সংগঠন জেলে যাওয়া কর্মীদের জামিনে গড়িমসি করে, তাদের পরিবারকে ভরণপোষণ করে না, এবং মুক্তির পর নজরদারি করে। পিসিপি, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের মতো অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা সংগঠনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কিন্তু তাদের ত্যাগকে স্মরণ করা হয় না। বরং, তাদের অবমূল্যায়ন করে বিভিন্ন মাইনাস করা হয়। এই বিশ্বাসঘাতকতা কর্মীদের ক্ষোভ বাড়াচ্ছে, এবং ইউপিডিএফ এর খপ্পরে পড়ে পাহাড়ি যুবকরা আলাদা রাষ্ট্রের মিথ্যা স্বপ্নে যৌবন নষ্ট করছেন।
সামাজিকভাবে, ইউপিডিএফ পাহাড়ি-বাঙালি বিভেদ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়েছে, যা এ অঞ্চলের শান্তিকে বিপন্ন করছে। চাঁদার টাকা অস্ত্র ক্রয়, সাংগঠনিক খরচ এবং মিডিয়া কভারেজে ব্যয় হলেও, বেশিভাগ অর্থের হিসাব নেই এই টাকা শীর্ষ নেতাদের পকেটে যায়। এই ধোঁকাবাজি যখন কর্মীরা বুঝতে পারেন, তখন তাদের 'জাত বিরোধী' ট্যাগ দেওয়া হয়। ফলে, অনেকে জীবন রক্ষায় পলায়ন করেন বা অপহরণের পর মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসে অপমানিত জীবন যাপন করেন।
ইউপিডিএফের এই বিশ্বাসঘাতকতা শুধু ত্যাগী কর্মীদের নয়, সমগ্র পাহাড়ি জাতির স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। উৎপল চাকমার মতো ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দুই কুল হারিয়েছেন, সংগঠনের অবমূল্যায়ন এবং সমাজের অপমান। এই প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট যে, সংগঠনকে তার গোপন নীতি পরিত্যাগ করে সত্যিকারের জাতীয় মুক্তির পথে ফিরতে হবে। অন্যথায়, হাজারো উৎপলের যন্ত্রণা অব্যাহত থাকবে, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চিরতরে বিপন্ন হবে। এই যন্ত্রণার মানবীয় দিকটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, রাজনৈতিক সংগ্রামে ত্যাগীরা নয়, স্বার্থপর নেতারা সর্বদা বিজয়ী হয় না, সময়ের সাথে সত্য উন্মোচিত হয়।